খোরশেদ আলমের গল্প নিয়ে পাঠকের ভাবনা

খোরশেদ আলম ৪ মে ১৯৮০ সালে গাইবান্ধার দারিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দারিয়াপুর আমান উল্যাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি, সরকারী বিজ্ঞান কলেজ, ঢাকা থেকে এইচ.এস.সি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচ.ডি অর্জন করেন। তাঁর লেখালেখির আগ্রহ গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদ ইত্যাদি। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি প্রকাশিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা১৬ তে। তাঁর এই গল্পগ্রন্থের এগারটি গল্প নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন-এর সঙ্গে পাঠ অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সুব্রত দত্ত পাঠের লিঙ্কএকজন পাঠকের ভাবনা বাংলা ট্রিবিউন


এটা সত্য জীবন ঘটনাবহুল। কিন্তু এর সবটাই গল্প নয়। জীবন এখন বিদগ্ধ-বিচ্ছিন্ন-বিপন্ন। এগিয়ে যাওয়া পৃথিবী জীবনের কাহিনিগুলো একঘেয়ে করে তুলছে। আমরা ক্রমশই ঘটনা হারাচ্ছি। এ-কালে এই ঘটনাহীনতাই গল্পের ভেতরভাগ।
এইভাবে গল্পহীনতার সম্ভাবনার কথা বলে লেখক শুরু করেছেন তার উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি গ্রন্থটি। এগারোটি গল্পসমেত এই গল্পগুচ্ছ উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি নিয়ে এলো কি এলো না তা বিবেচনার পূর্বে বলে নেয়া ভালো লেখক তাঁর জীবনদর্শনে নেতির যে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করছেন তা তাঁকে বিদ্রোহী, বিধ্বংসী না করে বরং ব্যথিত, দুঃখভারাক্রান্ত করে তুলেছে, যা সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতির শিখড়ে নিয়ে যাক বা না যাক, একজন অসামান্য মানুষ করে তুলবে। অবশ্য একজন লেখক লিখতে বসে মহৎ মানুষ কিংবা ঋষি হতে চান না, হতে না সত্যিকারের লেখক। এসব আমার বলার জন্য বলা কথা। আসল কথা হলো চমৎকার কয়েকটি গল্প নিয়ে উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি গ্রন্থটির জন্ম। সবগুলো গল্পই যে সুসম্পন্ন, ত্রুটিহীন এবং এক বাক্যে অসাধারণ তা বলা নেহাৎ তোষামুদে ব্যাপার ব্যতীত অন্যকিছু হবে না। তবে গল্পগুলো ঘটনাহীন নয় এবং গল্পের আঙ্গিকগত দিকটি বেশ বিশ্লেষণযোগ্য।

সাহিত্যের ছাত্র যেকোন লেখার আঙ্গিকটাই বোধ হয় আগে লক্ষ করে। অন্তত আমি তো করি। আমার ভাবনার প্রথম জায়গাটা তাই আঙ্গিকে। ছোটগল্প কাকে বলে? এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় সাহিত্যের সব ছাত্র বা শিক্ষককেই। প্রথম বাক্যটি বের হয় নির্দিষ্ট এক বাক্যে বলা সুকঠিন। তারপর কথার ভাজে কথা ভাজ করতে করতে একটা সংজ্ঞা দাঁড়িয়ে যায়। কেউ আকার-আকৃতির মারপ্যাঁচকে প্রাধান্য দেন, কেউ দেন এর ভেতরের মর্মবস্তুকে। কেউ সময় মাপেন, কেউ মাপেন জীবনকালের ব্যাপ্তিকে। কেউ চরিত্রগুলোর প্রকাশভঙ্গি দেখেন, ভাষা-কাঠামোও কারও কারও কাছে জরুরি বিষয়। তবে সব মিলিয়ে কথাসাহিত্যে ছোটগল্পের প্রধান যে দিকটা সবাই মেনে নেন, তা হলো গল্পের বিষয়বস্তুগত সীমানা ও পরিসরগত স্বল্পতা। বর্তমান বিশ্বে অবশ্য সংজ্ঞায়নও বিতর্কিত বিষয়। উত্তরাধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা সংজ্ঞায়নকেও ভয় করি। তাই যার যেভাবে খুশি গল্পের আকার দেই, আকৃতি আনি। কয়েকটি শব্দ, বাক্য এলোপাতাড়ি বসিয়েও আমরা গল্প তৈরি করে ফেলি। তা মেনে নেয়া বা মনে নেয়ার বাছবিচারও করি না। আর সমালোচক, সে তো নিন্দুকের খ্যাতি নিয়ে ছাতি হাতে রওনা হন বাড়ির দিকে। উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি-র লেখক কিন্তু মোটেই সে ধাঁচের লেখক নন। তিনি বরং ক্ল্যাসিক ঘরানাতেই গল্প লিখতে পছন্দ করেন, অন্তত তাঁর এই এগারোটি গল্প তা-ই বলে। আর এমন ক্ল্যাসিক লেখককে নিয়ে দুচারটা সমালোচনার বাণী ছুড়লেও তেমন বিপদ নেই বলেই মনে হয়।
প্রশ্ন আসে তাহলে উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি কী ক্ল্যাসিক গল্পগুচ্ছ? আমার দৃষ্টিতে তা-ই। গল্পের যেমন একটা আখ্যানভাগ থাকে, থাকে চরিত্র, ঘটনার ক্রমবিকাশ এবং একটা পরিণতি (অবশ্য ছোটগল্পের পরিণতি সম্পূর্ণ হয় না অনেকক্ষেত্রেই)-এর সবগুলোই গল্পে সুস্পষ্ট। অনুপমা রূপ বেঁচে খাওয়া মেয়ে। সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষ তার খরিদ্দার। তাদের দেহের ক্ষুধা মিটিয়ে সে জীবনের রশদ জোগায়। বাহির থেকে সে সমৃদ্ধ অথচ ভেতরটা তার ভয়াবহ শূন্য। এই কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক নির্মোহ থেকেছেন এবং ক্ল্যাসিক ধাঁচেই কাহিনিকে এগিয়ে নিয়েছেন। যেখানে তিনি আরেকটি প্রাণের আগমন ঘটিয়ে ভয়ঙ্কর আঘাত করেছেন পাঠককে। আচ্চা, ঐ ভ্রুণটাও কি নষ্ট ভ্রুণ গল্পের পাগলীর পেট থেকে ঝরে পড়ার মতো করে ঝরে পড়বে? এ প্রশ্ন আসেই। এই প্রশ্নের অনিশ্চয়তা নিয়েই রূপজীবী গল্পের যবনিকা। ভাষার ব্যবহারে লেখক একেবারে প্রমিতঘেঁষা পণ্ডিতবর্গীয় না থেকে বরং সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনে ব্যবহৃত ভাষাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অবশ্য ভাষার একটা শুদ্ধতা বলতে বিষয় আছে বলে লেখক বিশ্বাস করেন বলে বোধ হয়, মুবিনের বুল বুলি’’ গল্পে লেখক যদিও এই শুদ্ধতাকে ব্যঙ্গ করছেন কিছুটা অগোচরে।
ছেরাজ আলী ও তার বৌ নবিতুনকে নিয়ে লেখা ‘অধিকার’ গল্পটি আরেকটি ব্যঞ্জনা নিয়ে ধরা দেয়। লেখকের কোন গল্পেই রোমান্টিকতার আধিক্য দেখা যায় না বরং রোমান্টিকতার বিপরীতে বাস্তবতাকে তিনি বারবার তুলে ধরতে চেয়েছেন, কখনো নিরেট সোজা কথায়, কখনো কাব্যময় করে, কখনো আবার ইঙ্গিতে। সেক্ষেত্রে ‘অধিকার’ গল্পটি আমার কাছে কিছুটা ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। এখানে লেখক হয়তো কোন ‘শাশ্বত প্রেম’-এর সন্ধান পেয়েছেন (আদৌ শাশ্বত প্রেম আছে কিনা, তাতে সন্দেহ রয়েছে)। সেই প্রেমেই ছেরাজ আলীর মৃত্যু সংবাদ হাউমাউ করে কাঁদিয়ে তোলে নবিতুনকে। নবিতুন তো বহু বছর আগেই ছেরাজের ঘর ছেড়ে অন্যের ঘরণী হয়েছিল। কোথায়? ঠিক কোথায়? তার হৃদয়তন্ত্রীতে বীণার ঝংকার তুলেছিল, তা কিন্তু লেখক স্পষ্ট করেননি। পাঠক যে যার মতো করে বুঝে নেবে। নতুবা এটা সেই শাশ্বত প্রেমের প্রস্রবণধারা। অন্যদিকে ‘প্রেম ও বৈঠা’ গল্পে প্রেমের উপস্থিতি গল্পের নামে পাওয়া গেলেও জীবন নদী পার হওয়ার জন্য যে বৈঠার আবশ্যকতাই লেখক বেশি করে মূর্ত করেছেন। সুজন ভাইয়ের কাছে নজিফা বা ওজিফার থেকে ঐ কালো মোটা মেয়ে-মানুষটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। লেখকের এই সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়ে যেন লেখক নিজেই সুজন ভাইয়ের মুখ দিয়ে বলে ওঠেন, ‘পৃথিবীতে ভালবাসা বলতে কিছু নাই।’ এবং কোন রকম শাশ্বত প্রেমের ধারণার সঙ্গে তিনি একমত নন। এটাকে কিন্তু কোন অবস্থাতেই লেখকের দ্বিধা-বিভক্ত সত্তা বলা যাবে না বরং লেখকের হাতড়ে বেড়ানো ‘শান্তির নীড়’ যে কোথায় আছে? তা খুঁজে বের করার একটা প্রয়াস মাত্র। নবিতুন অধিকার হারিয়ে ছেরাজ আলীর বাড়িতে ঢুকতে না পারলেও লেখক অনায়াসে ঢুকে যান কছুরুদ্দির জীবনে। ‘অনিকেত’ গল্পের প্রধান চরিত্র এই কছুরুদ্দিও প্রেমে পড়েছে। একবার না বারবার কিন্তু সেসবের ভেতর আছে মানুষের আদিম ক্ষুধার তাড়না আর অর্থনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার। সত্যি বলতে গল্পটা মনে করিয়ে দেয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসামান্য গল্প ‘প্রাগৈতিহাসিক’-কে। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ আর ‘অনিকেত’ নামেও পাওয়া যায় জীবনস্রোতের সাদৃশ্য। নিম্নবিত্ত বললে ভুল হবে, একেবারে বিত্তহীন মানুষের জীবনকাহিনি ও বেঁচে থাকার এক আদিম বাসনার চিত্র লক্ষ করা যায় ‘অনিকেত’ গল্পে।
‘......একা ছেলের হাত ধরে হেঁটে চলছে কানা কছুরুদ্দি। জন্মাষ্টমির ওকড়াবাড়ির মেলা বসেছে আবার। মেলায় পৌঁছে নানারকমের জিনিসপত্র, ঘোড়দৌড়, খেলাধূলা, ভেলকিবাজি প্রভৃতির মধ্যে মার্বেল খেলা নজরে পড়ে কানা কছুরুদ্দির ছেলেটার।

— ‘অ আব্বা, মাড্বল খেলমো।’
কানা কছুরুদ্দি জন্মান্ধ নয়। ছোটবেলাকার সেই মেলার কথা মনে পড়ায় ছেলেকে সে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়।
প্রত্যেকটা মার্বেল পটপট করে তার ব্রহ্ম তালুর ওপর গিয়ে পড়ে যেন। পটপট শব্দে সেগুলো তার মগজের ভেতরে ঢুকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুরু করে। ক্ষুধায় কোঁকড়ানো মা-বাপ-ভাইদের কথা মনে ভাসে।
হাতের লাঠিটা ঠকঠক করে কেঁপে ওঠে তার। এই বুঝি তার ছইলটাও হাত ফস্কায়া হারায়ে যাবার চায়!’

‘অনিকেত’ গল্পের শেষটা এরকম। অন্যদিকে ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ভিখু যখন পাঁচীকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে হেঁটে চলে এবং পাঁচীর পেটের ভেতর কোন ভ্রুণ বাড়তে থাকে তখনও কছুরুদ্দির ছেলেটাও হাত ফসকে যেতে চায়। কোথাও যেন সাদৃশ্য রয়েছে। সে সাদৃশ্য বাইরের নয়, ভেতরের।
‘নষ্ট ভ্রুণ’ গল্পে নেতির আধিক্য লক্ষ করা যায়। একেবারে পৃথিবীর নোংরা ইতিহাসকেই লেখক এর প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পাগলীর দেহে বারবার বেড়ে ওঠা ভ্রুণগুলো বারবারই নষ্ট হয়। ওর কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা মেলে না। তবে গল্পের ভেতর লেখকের শিল্পনৈপুন্যের সাক্ষাৎ মেলে একটু বেশি। বিশেষত পুলিশ আর কুকুরের ঘটনাটা কিছুটা যাদু-বাস্তবতাঘেঁষা। লেখক চমৎকার ভঙ্গিতে অপরাধী সনাক্ত করেছেন এবং তা পাঠকের নিকট পেশ করেছেন।
কলিম মিয়ার দাপট ও কালের বিবর্তনে করুণ পরিণতি নিয়ে লেখা গল্প ‘দাপট’। জীবনের মুহূর্তগুলো যে কত রকমফের করতে পারে তার একটি আংশিক উপস্থাপন করেছেন লেখক। লেখক যেন বিশ্বাস করতে চান— পৃথিবীতে বদল আসবেই। দাপট শেষ হবে অন্যায়ের এবং একদিন অন্যায়কারীরা ঠকাঠক লাঠি ফেলে থালা নিয়ে হাত পাতবে। মানুষের জন্য লেখকের আবার দরদও কম নয়। তাই তিনি সে দৃশ্যের ভেতর দিয়ে ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ কথাটির সত্যতা পেয়ে হাসবেন না বরং দাপটকারীর দুঃখে ব্যথিত হবেন। লেখকের ভালো মানুষী মনটা এখানে একেবারে ধরা খেয়ে যায়। কলিম মিয়া কেমন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন সেটা লেখক উল্লেখ করেছেন। তাতে তার দাপটের পেছনকার ইতিহাসটা স্পষ্ট হয় পাঠকের নিকট। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লয়প্রাপ্ত দাপটের অধিকারী কলিম মিয়ার প্রতি লেখকের কোন ভৎসর্না লক্ষ করা যায় না, এবং তিনি এমন কোন কথাও বলেননি যাতে বলা যায় কলিম মিয়ার পরিণতি লেখকের প্রতিশোধ প্রবণতার জায়গা থেকে। লেখক জীবনের অন্যরকম কোন ব্যঞ্জনা এখানে লক্ষ করেছেন। ব্যথিত হয়েছেন কলিম মিয়ার প্রতিও। ঐ অন্যরকম ব্যঞ্জনা হলো— ভালো মানুষী বৈশিষ্ট্য। যেটা লেখক ব্যক্তিগতভাবে নিজেই ধারণ করেন।
হাবিজার রহমান অন্যরকমের মানুষ। তিনি কবরেজি ঔষধ দেন, ঝাড়ফুক করেন আর নবি-রাসুলের গল্প করেন, ইসলামী মারফতি জগতের গল্প করেন গাঁজা সেবন করতে করতে। সাধারণ একজন মানুষ তিনি কিন্তু অসাধারণ তার বয়ান ভঙ্গি। তার গল্পে গল্পেই শুরু হয় ‘ইয়াকুত পাথর’ গল্পটি। একেবারে নিম্নবিত্তের জীবনে তিনি ব্যক্তি হিসেবে সৎ। মানুষকে প্রতারিত করেন না কিন্তু একবার একজন তার কাছে ইয়াকুত পাথর চাইলে তিনি রেললাইন থেকে কয়েকটা পাথর তুলে পুটুলির ভেতর ভরে নিয়ে যান। পঞ্চাশ টাকাও গ্রহণ করেন। তবে তা গাঁজার সংস্থানের নিমিত্তে। এখানে গল্পকার মানুষের বিশ্বাসের একটি দিক যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি তার পেছনে অন্ধত্বকে ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও লেখক ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে মানুষের বিশ্বাসকে আঘাত করেননি, এমনকি হাবিজারও তাঁর কাছে ভণ্ড কোন ব্যক্তি নয়। বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত বাংলাদেশের সাহিত্যে লক্ষ করা যায়, অনেক সাহিত্যিকই ঝাড়-ফুক, তন্ত্র-মন্ত্র এবং মানুষের এর প্রতি বিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন, প্রমাণ করতে চেয়েছেন এগুলো ভেল্কিবাজি, ভণ্ডামী। লেখক সে পথে না হেঁটে, নিম্নবিত্ত-বিত্তহীন মানুষগুলোর ছোট ছোট প্রতারণার ভেতর দিয়ে তাদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যকে সুস্পষ্ট করে তুলেছেন। হাবিজারও তাই বারবার হলফ করে বলেন, ‘— কোনোদিন হারাম খাই নাই রে বাপ।’ তার এই স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে লেখক আবহমানকালের মানুষের ছোটখাটো প্রতারণা আমলে না নিয়ে বরং তাদের জীবনের সূত্রটির সন্ধান করেছেন। সব মিলিয়ে ‘ইয়াকুত পাথর’ গল্পটি অন্যরকম একটি মাত্রা যোগ করেছে ‘উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি’ গ্রন্থে।
রাহেলা কবরে শুয়ে শুয়ে হাসে। তার জীবনের প্রতি তার নিজেরই পরিহাস। মৃত্যুর পূর্বে একটু চিকিৎসা চেয়েছিল সে কিন্তু ছেলেরা তা করেনি অথচ মৃত্যুর পর অনেক খরচ করে তার চল্লিশার আয়োজন। লেখক যেন জীবন-ব্যবস্থার কিছু রীতি রেওয়াজকেও ব্যঙ্গ করতে চান রাহেলার মতো করে। ‘কবরের হাসি’ গল্পে খুব সংক্ষেপে ভাগ্য-বিড়ম্বিতা রাহেলার জীবনকাহিনি তুলে ধরেছেন লেখক। গ্রাম-বাংলার শত শত নারীর জীবনেই যেন এমনটা ঘটে, ঘটে চলেছে। তারই একটি চমৎকার চিত্র ‘কবরের হাসি’।
‘টাই-সাহেব’ গল্পটি কিছুটা যেন ছন্নছাড়া। ঠিক টাই-সাহেবের মতোই। আমার কাছে গল্পে মর্মবস্তু খুব বেশি স্পষ্ট না হলেও এটি বুঝতে পেরেছি— অনিকেত জীবন-প্রবাহে কিছু খাপছাড়া প্রাণ থাকে। তার কোন সুনির্দিষ্ট বিকাশ-প্রকাশ নেই। লেখক যেন সে দিকটাকেই তুলে ধরেছেন এ গল্পে।
‘মুবিনের বুল‘বুলি’’ একটু অন্যধারার গল্প। কাহিনিভাগে দুটি গল্পের সমান্তরাল প্রবাহ লক্ষ করা যায়। একদিকে মুবিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অন্যদিকে তার গ্রামের গল্প, তার মায়ের গল্প। কাহিনি নির্মাণে লেখক কিছুটা সরলরৈখিকতা বর্জন করেছেন। ভাষা বিষয়ক তাঁর ভাবনার চিত্রায়ন করেছেন চমৎকারভাবে। মানুষের মাতৃভাষা কোনটি? এমন প্রশ্নের একটা যথার্থ উত্তর তিনি খুঁজেছেন। প্রমিত বাংলা বনাম আঞ্চলিক বাংলার দ্বন্দ্বটা দীর্ঘকালের। কালের সুদীর্ঘযাত্রায় ভাষার বির্তকও বদলে যায় কিন্তু মুবিনের নিয়তি তার সঙ্গে খেলা করে চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও তার জীবনে পালের হাওয়া লাগে না বরং শহর আর গ্রামের মাঝে বেমানান সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গল্পটিতে রূপক-প্রতীকের ব্যঞ্জনাও লক্ষ করা যায়। ‘বহরম দস্যু’র গল্প বা অর্থনীতিবিদের চুরি করার মতো খণ্ড গল্পাংশগুলোতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সমাজনীতির বিভিন্ন দিককে লেখক তীর্যক ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুঃসাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে গল্পকার সমাজ ও রাষ্ট্রজীবন সম্পর্কে অতিরিক্ত সহানুভূতি সম্পন্ন হওয়ার তাঁর প্রতিটি ব্যক্তি জীবনের গল্পের ভেতর ফুরৎ করে ঢুকে পরে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সমাজ নীতি এবং দর্শনের নানা তত্ত্ব। তবে তিনি একজন গল্পকার হিসেবেই গল্পের পর গল্পের বয়ান করে যান, দার্শনিক বা সমাজনীতিবিদ বা অর্থনীতিবিদের চরিত্রে অবতীর্ণ হন না।
অন্যদিকে সবচেয়ে ব্যতিক্রম গল্প মনে হয়েছে ‘বঙ্গবিদ্যাগৃহ’ গল্পটিকে। আগাগোড়া রূপক-প্রতীকে সজ্জিত গল্পটা সব ধরনের পাঠকের জন্য নয়। এ গল্পের পেছনে রয়ে গেছে আরো অনেক গল্প। তার সন্ধান করাও সবার পক্ষে সম্ভবপর নয়। তাই গল্পটা সবাই বুঝে উঠতে পারবে না। তবে গল্পটির আঙ্গিক ভিন্নতর এবং উপস্থাপন কৌশলও অপূর্ব। রাষ্টযন্ত্র থেকে শুরু করে সমাজবিধির অনেক কিছুকেই তিনি মৃদু আঘাত করেছেন। ব্যাপারটা যেন ঐ গল্পের মতো— এক লোককে পঞ্চাশটা জুতোর বাড়ি দেয়ার পর অন্য একজন তার অনুভূতি জানতে চাইলে সে বলে ভাই মারছে তো কি হয়েছে? জুতোটা তো কাপড়ের ছিল। ব্যথা লাগে নাই। লেখকের এই আঘাতও অনেকটা কাপড়ের জুতোর মতো। লেখক বিদ্রোহী নন, তিনি বিধ্বংসী বাণী নিয়েও জনতার সম্মুখে দাঁড়াননি। তবে তিনি মানবদরদি, জীবনবাদী— তাই জীবনের খুঁটিনাটি অনেক কিছুই তাকে ভাবায়, ভোলায়, ব্যথিত করে, হতাশ করে কিন্তু অনুপ্রেরণাও জোগায়। তাই তিনি লিখে চলেন একের পর এক গল্প।
গল্পের আঙ্গিক নিয়ে কথা বলব বলে একেবারে গল্পের বিষয়বস্তুতে চলে গিয়েছে। আসলে গল্পে আঙ্গিক আর বিষয়বস্তুকে বারবার আলাদা করতে চাওয়াটা নিরর্থক। একটা গল্পে অবিচ্ছেদ্য অংশ তার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু। দুটো মিলেমিশে তৈরি হয় গল্প। তাই আলাদা করে বিশ্লেষণ করাটা কঠিন। বিজ্ঞ সমালোচক পারেন তা, আমার মতো সাধারণ পাঠকের ক্ষেত্রে তা একটু কঠিন হয়ে ওঠে। তবু আমার সকল কথার একটা সারবস্তু দাঁড় করাতে গিয়ে আমি সাহিত্যিক ঘরানা বাদ দিয়ে একটু বৈজ্ঞানিক বা হিসাববিদের পদ্ধতি অনুসরণ করছি। নিচে পয়েন্ট করে কয়েকটি কথা লিখছি ‘উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি’ গল্পগ্রন্থটি সম্পর্কে।
·          সবগুলো গল্পই গল্পের আঙ্গিকগত ক্ল্যাসিক সূত্রটি অনুসরণ করেছে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট আখ্যানকে কেন্দ্র করে প্রারম্ভ-মধ্য-অন্ত পদ্ধতিতে কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
·          চরিত্রের সুনির্দিষ্ট উপস্থাপন ঘটেছে এবং ছোটগল্পের সূত্র অনুসারে চরিত্রগুলোর বহুরৈখিক বা বহুকৌণিক দিক ফুটে না উঠে, কাহিনির সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় দিকগুলো বিশ্লেষিত হয়েছে।
·          গল্পগুলো শেষ হয়েও শেষ হয়নি। একটা অতৃপ্তি পাঠককে ভাবিত করেছে।
·          ভাষা-শৈলির ক্ষেত্রে লেখক প্রমিত বাংলাকেই একমাত্র সত্য মনে করেনি কিন্তু তাই বলে কেবল আঞ্চলিকতার দামামা বাজাননি বরং দুটোর একটা সুসাম্য বজায় রেখেছেন।
·          উত্তরমেঘে শিলাবৃষ্টি যতটা না হয়েছে, তার থেকে বেশি মানুষের চিন্তার ভেতরে জীবন-প্রবাহের নানা দিক বর্ষিত হয়েছে।
·          নগর-গ্রামের বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন ঘটনা গল্পগুলোতে এলেও সমাজের আম-জনতা বলতে ঠিক যে শ্রেণিকে বোঝানো হয়, তাদের প্রাধান্য বেশি লক্ষিত হয়েছে।
·          আশাবাদের ছোঁয়া যৎসামান্য পরিলক্ষিত হলেও জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা কিংবা ঘৃনার প্রকাশ করেননি লেখক। লেখক বরং জীবনকে শ্রদ্ধার সঙ্গেই চিত্রিত করেছেন।
সর্বাপরি, এইটুকুই বলার যে লেখক খোরশেদ আলমের এই প্রথম গল্পগ্রন্থে তাঁর লেখকসত্তার বৈশিষ্ট্যগুলোকে যেমন মূর্ত করেছেন তেমন ইঙ্গিত করেছেন একটি বিশাল সম্ভাবনার। বাংলাদেশের লেখক গোষ্ঠী যখন আধুনিকতা-উত্তরাধুনিকতার বাগ্-বিতণ্ডার ভেতর দিয়ে গল্পহীন হয়ে উঠছেন, তখন এই লেখক অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে নিতান্ত সাধারণ ঘটনাগুলোর ভেতর অসাধারণ মূর্ছনাকে চিরায়ত ধারায় বিনির্মাণে সচেষ্ট। তাঁর জন্য এক সাধারণ পাঠকের পক্ষ থেকে শুভকামনা রইল। আরো অনেক অনেক গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।

আরো পড়ুন 
খোরশেদ আলমের গল্প : কিছু ভাবনা : মোহাম্মদ আব্দুর রউফ

1 টি মন্তব্য: