কুন্তী চরিত্র : রহস্য ও সত্য

শিশিরের শব্দে প্রকাশিত। লিঙ্ক : কুন্তী চরিত্র : রহস্য ও সত্য 
কুন্তী চরিত্র : রহস্য ও সত্য

কুন্তীকে আমরা চিনি—একজন মহীয়সী নারী যিনি পঞ্চপাণ্ডবের মাতা। তিনি কর্ণেরও মাতা। দ্রৌপদীকে তিনিই যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুন-নকুল-সহদেবের মধ্যে বিভক্ত করেছিলেন। বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের তিনি পিসীমাতা। তিনি রাজা শূরসেনের কন্যা কিন্তু রাজা কুন্তীভোজের পালিতা। মহাভারত যুদ্ধে তিনি চেয়েছিলেন রক্তপাতহীন শান্তি; ভাইয়ে ভাইয়ে মিলন, কর্ণ ও পঞ্চপাণ্ডবের একতা।  কিন্তু সূর্যপুত্র কর্ণ অভিমানীই থেকে গেলেন। ব্যর্থ হল মাতৃ-আদেশ। কুন্তী পুত্র কর্ণের কাছে নিজের মৃত্যু-প্রার্থনা করলেন। কেবল মাতৃশ্রদ্ধা অর্পিত হলো—তিনি অস্ত্র ধারণ করবেন, ভ্রাতৃহত্যা করবেন না।

অর্জুনকে বাগে পেয়েও হত্যা করতে পারলেন না কর্ণ। এর আগে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণও কর্ণকে পাণ্ডবপক্ষে থাকতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনিও বোঝাতে ব্যর্থ হলেন। কর্ণ থেকে গেলেন কৌরব পক্ষেই। কর্ণের মৃত্যুতে বিগলিত হয়নি কি মাতৃহৃদয়? এমনকি কর্ণের শেষকৃত্যের জন্য অর্থ দেয়নি পাণ্ডবপক্ষ। কুন্তী পেয়েছিলেন তীব্র মনোবেদনা। সন্তান তো তারই অঙ্গে ধারণ করা। শিশু কর্ণকে যেদিন লোকচক্ষুর ভয়ে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন কি মাতৃহৃদয় কান্না আর হাহাকারে নিমজ্জিত হয়নি? অন্যদিকে প্রিয়পুত্রদের ছেড়ে শেষ বয়সে কুন্তী ছেড়েছিলেন পাণ্ডবগৃহ। এসব প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

রাজা কুন্তীভোজ তাঁকে অল্প বয়সেই ঋষি সেবায় পাঠিয়েছিলেন। কুন্তী দুর্বাসা মুনির মন জয় করেছিলেন, বরও লাভ করেছিলেন। দেবসন্তান লাভ করেছেন সেই আশির্বাদেই। ইন্দ্রপুত্র অর্জুনকে তিনি হয়ত বেশিই ভালবাসতেন। যাই হোক, এই কাহিনি বলাই মুখ্য নয়। কুন্তীর জীবনের বড় বেদনা ছিল—পিতা কেন তাঁকে রাজা হওয়া সত্ত্বেও অন্য রাজার কাছে পালিতা হিসেবে দিলেন। ভেবে ভেবে তাঁর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ভেতরে ভেতরে সেই বেদনার ভার তিনি বহন করে চলেছেন।

এই অন্তর বেদনার ও বিক্ষত-হৃদয় কুন্তীকে আমরা কমই চিনি। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাকার কালকূট কুন্তীকে পৌরাণিক মহিমা নয়, মানব মহিমায় গেঁথেছেন।    

কুন্তী এমন এক চরিত্র, যাঁর মধ্যে কালের দাহ ও যন্ত্রণা নিহিত। চরিত্রটি মূলত পৌরাণিক হলেও তার মধ্যে রয়েছে মানবী প্রতিচ্ছায়া। কালকূট পৌরাণিক কুন্তীকে তাঁর বাস্তব-জ্ঞানে অঙ্কন করলেন। তাঁর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলো একজন বেদনা বিধুর নারী। পৌরাণিক নারীর মহিমা পরিত্যাগ করে তিনি হয়ে ওঠেন সমকালীন জীবন ও সত্যের প্রতীক। বস্তুত মহাভারতের কুন্তীর রূপান্তর ঘটেছে পৃথা উপন্যাসে। 

কালকূটের পৃথা এই কুন্তীরই অন্য নাম। ক্রমশ পৃথা পাঠে আমরা স্পষ্ট হই—দেবতার বর কিছু নয়। দৈবমহিমা চয়ন করেও লেখক তুলে ধরেন একান্তই রক্তমাংসের মানুষ। দৈবী সন্তান ধারণও এক মহান মিথ্যা-প্রসঙ্গ। পরতের পর পরত কাহিনির ভাঁজ খুলতে থাকলে অন্ধকার সরিয়ে আলো প্রবেশ করে। অন্ধকার সরে গেলেই তো প্রকৃত আলোর বিভা মানবিক অন্তঃকরণকে জ্ঞানে উদ্ভাসিত করে।

কুন্তীও সেই চরিত্র, যে আসলে মানুষের জ্ঞানের চক্ষু খুলে দেয়। আমরা জানতে পারি—বাস্তব এই নারীটির অন্তর্দহন আর গভীর বেদনার কথা।   

অনার্য সত্যবতীর কানীন পুত্র কৃষ্ণবর্ণ ব্যাসদেব। তারই চিন্তা আর অনার্য পুরুষ গণেশের হস্তলিখনে মহাভারত মহাকাব্যের সৃষ্টি। দুই অনার্যের মিলনসম্ভূত প্রতিভার সাক্ষর সিন্ধু-সভ্যতা। এরই কাছে একসময় আর্যরা মাথা নত করেছিল। পরবর্তীকালে আর্য-অনার্যের সংশ্লেষণে হিন্দুসভ্যতার সৃষ্টি। এ-মিলনের ভেতরে রয়েছে গ্রহণের সংস্কৃতি। তবুও তার মধ্যে সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব থাকা অসম্ভব নয়। এজন্যই অনার্য সন্তান ব্যাসদেবের অন্তরে ভারত-ইতিহাসের এই দ্বন্দ্ব কাজ করে। এই দ্বন্দ্ব-দর্শনও কুন্তী চরিত্রের অন্তর্গত সত্য হয়ে ওঠে। কুন্তী যে ধর্মপুত্ররূপী সন্তানের জন্মদাত্রী, তাতেও ধরা পড়ে এই সত্যকথন। 

কালকূট ভ্রমণ করেছেন বিচিত্র স্থানে। এই বিচিত্র যাত্রাপথে তিনি হুগলীর ত্রিবেণীর সন্নিকটে কুন্তীঘাটে এসেছিলেন। তাঁর মনে পড়েছিল মহাভারত খ্যাত কুন্তী চরিত্রের অসামান্যতার কথা।

পৃথা উপন্যাসে জাতীয় ইতিবৃত্তের বিতর্কিত, গুরুত্বপূর্ণ ও অসামান্য রাজচরিত্র কুন্তীভোজ। অশ্বনদী তীরবর্তী রাজ্যের রাজা এই কুন্তীভোজের পালিতা কন্যা পৃথা। এই পৃথারই পরবর্তী নাম কুন্তী, সেটা পূর্বেই উদ্ধৃত। কুন্তী চরিত্রকে এ-উপন্যাসে সত্যের আলোয় ভাস্বর করা হয়েছে। আসলে সময় ও মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতেই নির্মিত হয় যুগসত্য। সেই সত্য থেকে সত্যযুগের সীতা, মন্দোদরী, অহল্যা ও তারা চরিত্রের উদ্ভব। তারা কেউই প্রচলিত সমাজ-অর্থে সতী নন। কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তার ইঙ্গিতে তারাই স্মরণীয়। কালকূট এই সত্যকে অবলম্বন করেই মহাভারত-যুগের কুন্তী ও দ্রৌপদীর সময়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। সময় ও সমাজের অগ্রযাত্রা ও পরিবর্তিত মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নির্মাণ করেছেন কুন্তী চরিত্রকে। পৌরাণিক অলৌকিক-অবাস্তব বিষয়কে উপেক্ষা করে কুন্তীর চারিত্রিক দৃঢ়তা নিরূপণ করেছেন লেখক।

অন্তর্দ্বন্দ্ব, কর্তব্যপরায়ণতা ও সন্তান বাৎসল্যে কুন্তী জগজ্জয়ী। সত্যিই তাঁর চরিত্রে স্বতন্ত্র এক নারীর প্রতিষ্ঠা লেখক দিয়েছেন। সংহিতা যুগ-অন্ত্যে এবং পৌরাণিক যুগ-সূচনার কালে নারীর দৈহিক শুচিতার মূল্য ছিল অধিক। এ-যুগের সাহিত্য মহাভারত-এ পাণ্ডুর স্ত্রী কুন্তী। আমরা জানি, পাণ্ডু সন্তান জন্মদানে অক্ষম। তাই কুন্তী ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করেন। ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন তখন রাজমহলে নিষিদ্ধও ছিল না। যদিও মহাভারতের কুন্তীর ক্ষেত্রজ পুত্রসন্তান জন্মদানের ঘটনা রহস্যময় কাহিনির আড়ালে ঢাকা।

এই রহস্য-আবৃত কুন্তীর জীবন ইতিহাসকেই সত্যে উপস্থাপন করেন লেখক। লেখক দেখান—কুন্তীর কানীন পুত্র কর্ণ এবং ক্ষেত্রজ পুত্র যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনের জন্মে কোনো অলৌকিক মহিমা নেই।

ইতিবৃত্তের কুয়াশাচ্ছন্ন পাতা সরিয়ে লেখক আবিষ্কার করেন—কুন্তীভোজের রাজদরবারে অতিথি হয়েছিলেন সূর্যসম তেজস্বী পুরুষ দুর্বাসা। তিনিই ছিলেন কুন্তীর প্রথম সন্তান কর্ণের জন্মদাতা। যুধিষ্ঠিরের পিতা ধর্মের জন্মের আড়ালে আছেন কুন্তীর দেবর বিদুর। যে বিদুর শুদ্রা জননীর গর্ভে ব্রাহ্মণের ঔরসজাত। ভীমের জন্মদাতা শতশৃঙ্গ পর্বতেরই কোনো এক বলশালী ঋষি এবং পরশুরামের মত অস্ত্রবিদ্যা বিশারদের ঔরসে অর্জুনের জন্ম।

মহাভারতের পৌরাণিক যুগ তিনটি পর্যন্ত পুরুষ সংসর্গ মেনে নেয়। কিন্তু চতুর্থ পুরুষ সহবাসে নারী হয়ে যায় স্বৈরিণী। তাই এর মধ্যেই শাস্ত্রীয় মতে কুন্তী স্বৈরিণীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। কর্ণের জন্ম ইতিহাসটা চিরকালই ছিল অজানা। স্বয়ং কুন্তী জানলেও সমাজে প্রকাশ করার জো ছিল না।

এদিকে পাণ্ডুর দিক থেকে আরেকটি সন্তানের কামনা থাকা সত্ত্বেও কুন্তী পঞ্চম পুরুষের সহবাসে পতিতা হতে চাননি। স্বৈরিণী হবার অপরাধে এর মধ্যেই তাঁর মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত—পাণ্ডুর কাছে যা ছিল অজানা। কালকূট নারী-হৃদয়ের চাপা পড়া বেদনাকে প্রকাশ করে বলেন :

কুন্তীর মনে একটা বড় কষ্ট ছিলই। তিনি জানতেন, প্রথম পুরুষ সংসর্গে তাঁর কুমারীত্ব অটুট থাকলেও চারজন পুরুষের সংসর্গ তিনি করেছিলেন। অন্তরে তিনি স্বৈরিণী ছিলেন, এবং তা যতকাল প্রকাশ করতে পারেননি, ততকাল মনে কষ্ট পেয়েছেন। (পৃথা 

আজীবন পিতৃস্নেহ-বঞ্চিত ছিলেন কুন্তী। তাঁর জীবনে শৈশব-কৈশোরের চাপল্য প্রকাশ পায়নি কোনদিন। উপরন্তু নিগ্রহ একাকীত্ব আর দাস্য অতিথি সৎকার ছিল তার ভাগ্যের পরিহাস। পুত্র কর্ণ জন্মের ইতিহাস—লোকলজ্জা ও সমাজ-সংস্কারের ভয় উপেক্ষা করে সত্যকে তিনিই করেছেন উন্মোচিত। এখানেই পাপের দহন ও সত্যের উপলব্ধিতে তিনি মহিয়সী নারী। দ্রৌপদীকে তার পাঁচপুত্রের সমান অংশীদার করেও দূরদর্শী। লেখক এজন্যই বলেন :

আমি দেখেছি ইতিহাসের পাতায় কী ঐশ্বর্যময়ী রমণীচিত্র অঙ্কিত। সারাজীবনের দুঃখের মধ্যেও তিনি ভেঙে পড়েননি, এবং যোগাসনে বসে দাবানলে প্রাণ ত্যাগ করেছেন। পৃথার জীবন যেন সমস্ত সুখ দুঃখের ঊর্ধ্বে। যিনি প্রেম কী তা জেনেছেন। কিন্তু সারাজীবন দুঃখের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন। বিশেষ করে, তাঁর পাপবোধ, বিশ্বের সকল মানবীকে নতুন চেতনা দিয়েছে। পৃথা তুমি আমাদের সকলের প্রণাম নাও। (পৃথা)

কালকূট এভাবেই কুন্তী চরিত্রকে বড় করে তুলেছেন। তার অন্তর্বেদনার কারণ আবিষ্কার করেছেন তিনি। কুন্তী এমনিতেই এক বেদনাসিক্ত নারী। পাণ্ডুকে হারিয়ে তার মনোবেদনা তীব্র হয়েছে। এমনকি পাণ্ডব-কৌরব যুদ্ধে স্বীয় পুত্র কর্ণের জন্য অবস্থান ও আকুতি তাঁর ভয়াবহ। এসবই যেন বেদব্যাসের মনন-চিন্তা ও লেখক-বিবেচনাবোধের চূড়ান্ত সীমায় অঙ্কিত।

মহাভারতের কুন্তীর পরিচয় ছাড়িয়ে, যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুন ও কর্ণের মাতৃ পরিচয় ছাড়িয়ে, এমনকি পাণ্ডুর সতী-সাধ্বী স্ত্রী নামক অভিধা ছাড়িয়েও তিনি আরো সত্য হয়ে ওঠেন। একজন লেখকের কাজ তো এই সত্য মানবকেই তুলে ধরা। কালকূট প্রকৃতই এই নারীকে পৌরাণিক নির্মোক খসিয়ে চৈতন্যশীল ও বাস্তব করে তোলেন। সেই সঙ্গে তাঁর ভেতর দিয়ে সঞ্চার করে দেন এক গভীর দুঃখবোধ, যা মানুষের জীবনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িত। তিনি দেখিয়েছেন নিজের সতীত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়া কুন্তী সারাজীবন অন্তর্বেদনা অনুভব করেছেন। সেই বেদনাকে নিজের ভেতরেই লালন করেছেন। এক বিষণ্ণ বিধুরতা তাঁর ছিল নিত্যসঙ্গী। ফলে সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে উপন্যাসের এক বিচূর্ণ বিক্ষত হৃদয় কুন্তী। 

[কালকূটের পৃথা  উপন্যাস অবলম্বনে]

খোরশেদ আলম

গল্প ও গদ্যলেখক। শিক্ষক , বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 

লেখকের অন্যান্য লেখা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন