প্রবন্ধ-পাঠের লিঙ্ক
মজিদ মাহমুদের নিত্যসচল জীবনবোধ: প্রসঙ্গ ‘সিংহ ও গর্দভের কবিতা’
মানুষ তার নিত্যজীবনকেই অবিনশ্বর করে তোলে। কবিরা সেখানে অগ্রণী। হয়তো মহাজীবনের সন্ধান তখন পাওয়া যায়, মর্তেই সৃষ্টি হয় অমরালোক। মানুষ অমর নয় কিন্তু তার কর্ম ও মানবতাই তাকে অমর করে তোলার স্পর্ধা জোগায়। অমরত্ব লাভ কিংবা স্বর্গীয় অনুভব সবই কাল্পনিক বিষয়। কিন্তু জীবন যে নিরেট বাস্তব চায় না। অথবা নিরেট বাস্তবে জীবন হাপিয়ে ওঠে। ফলে কল্পিত সুখের কামনা মানব সমাজের এক অন্তস্থ বাসনা। যার বাস্তব রূপ না থাকলেও চৈতন্যে তা আকাশচারী। আর কবিরা তো উভচর। তারা জগত ও অজাগতিক অনুভব-অনুবেদ্য উপাদানকে ভাষায় রূপ দান করেন।
একজন চৈনিক ঋষির অমরত্ব দানের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। অমরত্ব চেয়েছিলেন মহা মৃত্যু-উৎপাদক চেঙ্গিস খান। শেষজীবনে পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিলেন অমরত্ব লাভের জন্য। অমাত্যরা অমরত্বের ওষুধদাতা বহু চিকিৎসককে নিয়ে আসতেন তার কাছে। বলাবাহুল্য শিরশ্ছেদই তাদের জন্য ছিল নির্দিষ্ট। চৈনিক ঋষি কবি চাংচুং ততোদিনে বেশ নামকরা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর জ্ঞানের আলো বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিলো। অবশেষে সেই চৈনিক ঋষি কবির ওপর ভার পড়লো চেঙ্গিস খানকে অমরত্ব দেয়ার জন্য। কবিকে রাজ দরবারে আনা হলো। তাঁকে অনেক প্রশ্ন করলো চেঙ্গিস খান। চৈনিক ঋষি প্রজ্ঞার আলোকে সমৃদ্ধ জবাবও দান করলেন বেশ। অবশেষে এলো সেই অমরত্ব লাভের কথা। ঋষি কবি চাংচুং চেঙ্গিস খানের কথা শুনে চৈনিক কায়দায় বিশেষ চিহ্ন প্রদর্শন করলেন। তিনি দু হাতের দুটো বুড়ো আঙুল উচিয়ে ধরলেন। মুখে কিছু কথা বললেন। সেসব কথার মর্মবাণী ছিলো—অমর হওয়ার উপায় প্রেম, জীবে দয়া, তলোয়ার কিংবা রাজ্য জয় নয়।
মানুষের অমরত্বের যতো গল্প আছে তার সবগুলোই এরকম ব্যর্থতায় পর্যবসিত। ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্যের উরুক রাজ্যের কিংবদন্তী রাজা প্রাণ ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলো বন্ধু এনকিদুর। তার জন্য কোনো এক জিয়নলতা সমুদ্রের পারে রেখে স্নান করতে গেলে একটি সাপ সেই লতা গলাধকরণ করে। ফলে মানুষের পক্ষে অমরত্ব লাভ আর সম্ভব হয় না।
তবু পৃথিবীতে মানুষ অমরত্ব চায়। এটা তার অনন্য বাসনা। কতো রাজা কতো রাজ্যদখল কতো কতো মহা আয়োজন, তবুও কোনো রাজা পৃথিবীতে অমরত্ব পেলো না। ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই রয়ে গেলেন তারা। কিন্তু কবিরা হয়ে গেলেন অমর। কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ’। কবিতা কী? এ নিয়ে বহু সংজ্ঞা বহু মহাজন দিয়ে গেছেন। বহু কবি তাঁদের কাব্যখচিত দার্শনিক ভাবনা সমুন্নত উক্তির মাধ্যমে কবিতা কী সে সম্পর্কে জানান দিয়েছেন। সেসব না হয় না-ই বলি। কারণ সত্যিকারের কবি পাখির মতোই আপন মনে সুরেলা কণ্ঠে গান উপহার দেয়। যা শুনে আমরা বিমোহিত হই, বিচলিত হই না। বরং আমাদের হৃদয় সচল হয়ে ওঠে। আমরা অমরত্ব না পেতে পারি, স্বর্গীয় সুধার আস্বাদন পাই। কবিরা জগতে অমরাবতী নির্মাণ করেন।
আমার মনে হয় ভালো কবিতা জীবনকে আড়াল করে না। বরং চির পরিচিত জীবনকেই সামনে মেলে ধরতে চায়। আধুনিক-উত্তরাধুনিকতার চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার খোঁয়াড়ে বন্দি হলে একথা মান্যতা পাবে না, সেটা জানি। কারণ একটা বিচ্ছেদ বেদনা তারা সঞ্চার করতে চান কবিতার পেশিতে পেশিতে। বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ জপ করতে করতে তা যেন জীবন থেকেই ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু কিছু কবিতা সরল হয়েও প্রদীপ্ত জীবনের কথা বলে, পক্ষান্তরে অমরত্ব লাভ করে, অমর হয়ে ওঠেন কবি নিজেও। সেখানেই কবিতার সার্থকতা। হয়তো নিরীক্ষার দেয়াল ডিঙিয়ে কোনো এক শান্তি-স্বস্তির অমরাবতী সেখানে বিরাজ করে। শান্তি-স্বস্তি কামনা ব্যর্থ হলেও জেগে থাকে মানুষের চির যৌবনদীপ্ত তাপিত যন্ত্রণা। কালে কালে তা সমগ্র মানবকে গ্রথিত করে। একেই কেউ কেউ বলতে চান চিরদিনের কাব্য, যা ক্ষণকালের হয়েও অসীমতা প্রাপ্ত, তা-ই দীর্ঘ সময়-বাসনালালিত।
কবিতা মেটাফিজিক্যাল নাকি ল্যাবরেটরিতে প্রমাণযোগ্য বিজ্ঞানসম্মত কারিগরি সে-তর্ক থাক। কবিতা যদি ভালো লাগে এটাই কবিতার শক্তি। অনেকে আবার বলবেন—ভালো তো অনেককেই লাগে, তাই বলে তারা যে ভালো তার প্রমাণ কি? অথবা ভালো লাগলেই ভালোবাসা হয়ে ওঠে না, তার জন্য তিতিক্ষা লাগে। এ সমস্তই সত্যের বিভিন্ন রূপভেদ মাত্র। যে কবিতা দৈনন্দিন অনুভবসিক্ত তা-ও কখনো হৃদয়ে আলোড়ন তোলে। বস্তুত ক্ষণিক জগৎসত্যও মহাজাগতিক হয়ে উঠতে পারে। তবে কবি কীভাবে পরিবেশন করবেন তার ওপরেও তা নির্ভর করে বৈকি। একই উপকরণ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মানুষের কাছে বিচিত্র ও প্রিয়তর হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের একজন বেশ পরিচিত কবি মজিদ মাহমুদ। এখন থেকে প্রায় তিনদশক আগে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মাহফুজামঙ্গল’ (১৯৮৯)। সেদিনই তাঁর কবিচৈতন্যের খবর পৌঁছে গেছে পাঠকের কাছে। এরপর একে একে ‘গোষ্ঠের দিকে’ (১৯৯৬), ‘বল উপাখ্যান’ (২০০০), ‘আপেল কাহিনী’ (২০০২), ‘সিংহ ও গর্দভের কবিতা’ (২০০২) ইত্যাদি পেরিয়ে ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’ (২০১২), ‘শুঁড়িখানার গান’ (২০১৯) কি ‘বায়োস্কোপ’(২০১৯)-এ পৌঁছে গেছেন তিনি। বস্তুত ‘বল উপাখ্যান’, ‘আপেল কাহিনি’, ‘ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম’ কিংবা ‘দেওয়ান-ই-মজিদ’-এর মতো অসাধারণ কাব্য-পরিক্রমা বহু আগেই মজিদ মাহমুদ সমাপ্ত করেছেন। তিনি তাঁর নিজস্ব পরিধি ভাঙতে ভাঙতে, প্রসারিত হতে হতে বহুদূর এগিয়ে এসেছেন।
এর আগে মজিদ মাহমুদকে নিয়ে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তিনি সহজ কথার কবি। এটাই সত্য—সহজতার জটিল সীমানাই তাঁকে প্রসারমান অনুভবের দিকে দিকে যাত্রা করায়। আধুনিক কালে কবিতার সঙ্গে পাঠকের মেরুদূরত্ব ঘোচাতে যাঁরা পারঙ্গম হয়েছেন মজিদ মাহমুদ তাঁদেরই সহযাত্রী। তাঁর অনেক নামকরা কবিতার বই থাকলেও প্রায় অনুচ্চারিত ‘সিংহ ও গর্দভের কবিতা’ (২০০২) সম্পর্কে লেখার ভার সম্পাদক মহোদয় বন্ধুত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার ওপর চাপিয়েছেন। তাতে একদিকে ভালোই হয়েছে। কেননা, কোনো লেখক সম্পর্কে মূল্যায়নধর্মী লেখার জরিপ করলে দেখা যায়—সাধারণত ঘুরেফিরে দু চারটি বইই আলোচিত হয়। ইদানিং লেখকের অনালোকিত বই সম্পর্কেও কথা বলবার সুযোগ তৈরি হয়েছে সেটা সম্পাদনার একটা ইতিবাচক দিক। হয়তো সেই অনালোচিত বা কম-আলোচিত গ্রন্থেও মিলে যেতে পারে পাঠকের কোনো প্রার্থিত অনুভবের কবিতা, এমন কোনো চিন্তা যা অন্য গ্রন্থে সূচিত হয়নি।
আণুবীক্ষণিক শব্দ-বন্ধনে তৈরি হয় ‘সিংহ ও গর্দভের কবিতা’। এছাড়া ‘অণুবিশ্বের কবিতা’য়ও তিনি একধরনের স্বল্পভাষ কবিতার নিরীক্ষা করেছেন। মিতবাক কবিতাগুলো দর্শনগম্ভীর হলেও জটিলতা আক্রান্ত নয়। প্রথম কবিতা ‘সঙ্গী’তেই তাঁর আণুবীক্ষণিক শব্দচৈতন্য সুপরিস্ফূট:
যে সব কীট শুয়োপোকা সরীসৃপ
আমার চারপাশে রয়েছে অবহেলায়
তাড়ায়ও না ওদের—থাকুক যত্নে
ওরাই তো আমার সঙ্গী শেষ বিছানায়।
অপরদিকে নশ্বর এই জীবনকে অবিনশ্বর করতে চান না তিনি। প্রমিথিউসের মতোই জ্ঞানজ বিশ্বের নিষিদ্ধ আনন্দ জ্ঞাপনে উৎসার তাঁর কল্পনা। স্বর্গের নিষিদ্ধ ফলটি প্রথম আদম সন্তানের মতো আস্বাদন করতে চান। ‘ঈশ্বর’ কিংবা ‘নশ্বর’ কবিতায় সেই জ্ঞানবৃক্ষের ফল:
ঈশ্বর আমারি মতন অসহায়
ধনীরা বলেন, তিনি সবকিছুর মালিক
আমিও সেকথা মানি
কিন্তু তার সকল ধন হয়ে গেছে চুরি
তিনি এখন দ্বারে দ্বারে ঘোরেন
তবুও দেয় না কেউ একমুঠো মুড়ি।
(ঈশ্বর)
অথবা, দেখা যেতে পারে--
ঈশ্বরের নাম জপার সময় তো আমি
মৃত্যুর পরেও পাবো
আগুন কিংবা উদ্যান—
সবই ঈশ্বরের মহিমা
তবে যে-সব নশ্বর বস্তুনিচয় হারিয়ে যায় নিত্য
আপাতত আমাকে করতে দাও তাদের মহিমা প্রকাশ।
(নশ্বর)
চিরসত্য নয় বরং নিত্যসত্যই প্রধান হয়ে আসে ‘ঈশ্বর’ নামক আরো একটি কবিতায়। সমনামে দুই কবিতা একই গ্রন্থে কেউ সাধারণত রাখেন না। কবি হয়তো ধরতে চান ভিন্নভাবে সেই চেনা ঈশ্বরকেই, যাকে মানববাদ করে তুলতে চান তিনি। বোঝাতে চান ঈশ্বর নিয়ে তর্ক শিশুর প্রলাপমাত্র। বহুপ্রাণ বিসর্জনেও তিনি নেই। আবার তিনি নেই-এর মাঝেও নেই। প্রকৃত ঈশ্বর যেখানে থাকে সেখানে মানুষ সহসা প্রবেশই করে না।
যারা পৃথিবীতে ঈশ্বর থাকার পক্ষে
দিয়েছিলেন প্রাণ—
তারা দেখলেন ঈশ্বর আছে
যারা নেই বলেছিলেন—
তারা দেখলেন নেই
উভয়কে মা বললেন, তর্ক থামাও
অনেক হয়েছে রাত—এবার শিশুরা ঘুমাও।
কবিতায় একটি বৈঠকি ভঙ্গি নিয়ে কবি কথা বলেন। দ্য ভিঞ্চি, পিকাসো, ভ্যানগগ আর মকবুল ফিদা হোসেন অপরিবর্তনীয় আবেগের চিত্রনির্মাতা হয়ে ওঠেন। একই কারণে কবিতায় মহামতি লালন, সক্রেটিস, রাসেল কিংবা রুশোরা অনায়াসে আসেন। তারা কেউ গম্ভীর নন। বস্তুত তাঁদের গম্ভীরতাকে কবি শব্দসারল্যে ভেঙে দেন। চিরকালীন আমিকে সঙ্গতভাবে প্রতিদিনের করে তোলেন কবি।
অন্যেরা যাকে আমি বলে জানে
না কি আমি যাদের চিনেছি অন্য নামে
আমার চারপাশে সকল দৃশ্য ও দ্রষ্টব্য
হয়তো প্রকৃত আমির স্বরূপ।
(দাইসেলফ)
আমির স্বরূপ বোঝার জন্য কবি চেনা পৃথিবীকেই আরেকবার নির্মিলিত চোখে প্রত্যক্ষ করেন।
মানুষ তো পৃথিবীতে আসে। আবার মানুষ চলে যায়। এই জগৎ-সত্য চিরকাল একই রকম। কিছু মানুষ মরার আগেই মরে যায়। প্রকৃত মানুষ বারবার মরে না, একবার মরেই অমর হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে মৃত্যু সত্য। ‘ছবি’ নামক কবিতায় কবির উপলব্ধি:
আমরা মৃতদের ছবি টাঙিয়ে রাখি দেয়ালে
কারণ তারা পুনরায় জন্মাবে না বলে।
‘একা’ কবিতায় বেজে ওঠে মৃত্যুতে জীবনের দুর্বার সত্য, একাকী মানুষের সঙ্গ পাবার ভিন্নতর চৈতন্য। মজিদ মাহমুদের কবিতায় মৃত্যু বিপন্নতা বা বিষণ্ণতা নয়।
পৃথিবীতে কেউ একা আসেনি
আবার কেউ একা যাবেও না
কিছু মানুষ তাকে সঙ্গে করে এনেছিলো
কবর কিংবা চিতায় নিয়ে যাবে তারা।
এখানে মৃত্যুতে মানুষ একা নয়, বরং কোনো কোনো কবিতায় জান্তব মানুষই মৃত মানুষে পরিণত হয়। অন্যদিকে ‘মৃতশিশু’ কবিতায় মৃত্যু হয়ে ওঠে মহীয়ান, লোকোত্তর। তিনি তো বলেন,
এই সব টুকরো টুকরো অসংখ্য মরণ
আমাকে নিয়ে যায় বৃহত্তর মরণের দিকে।
খুবই সহজ সুন্দর অথচ দীর্ঘায়িত নয় এমন সব কবিতা রয়েছে এই গ্রন্থে। জীবনের সহজ সত্যগুলো, সাধারণ দিনানুদৈনিকের ভাবনাগুলো মজিদ মাহমুদের কবিতায় দার্শনিক চৈতন্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্রতিদিনের চেনা বারান্দারও গলিঘুপচি থাকে। সেসব আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠতে থাকে। ‘ক্ষুদ্র’ কবিতায় মেলে সর্বমূল্যপ্রদায়ী জীবনদৃষ্টি।
যেসব ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ—যাদের দিকে ছিল না তাকানোর সময়
তারাই আজ আমার সবচেয়ে কাছাকাছি আসে।
অন্যদিকে তাঁর কবিতায় কর্ণকুহর তৃপ্ত হয়। শব্দে শব্দে ছন্দ-ঝংকারের অসম্ভব দুলুনি থাকে। মন ও প্রাণ উভয়ের তৃপ্তিসাধন সেখানে ঘটে। যেমন ‘রথ’, ‘স্বপ্ন’, স্পর্শ ইত্যাদি কবিতায় ছোটো ছোটো বাক্যে থাকে ঐকান্তিক অনুভব, ঝংকৃত আওয়াজ, আশা ও নিরাশার হাহাকার।
অনেক হয়েছে যাওয়া
ভুলে গেছি অভিসার পথ
যেহেতু হারিয়ে যাব
অহেতুক অন্বেষণ
এখানেই থামাও রথ।
(রথ)
যা চেয়েছিলাম ছুঁতে
তা ছুঁয়েছি বহুবার
তবু পারি না বুঝতে
কেন এই পাবার নেশা
কেন এই হাহাকার।
(স্পর্শ)
এই শব্দ-ঝংকার সুরিয়্যাল বাস্তবতার ধুম্রজাল নয়, বরং তা নিত্যগ্রাহ্য ছবিতে ভরপুর। নাগরিক জীবনের ক্লান্তধ্বস্ত, কর্মনিষিক্ত ঘর্মাক্ত রূপ সেখানে নেই। জীবনের সঘন উপস্থিতি রয়েছে কবিতার ভাঁজে ভাঁজে। ফলে রূপসী বাংলার আত্মসমাহিত স্মৃতিমাধুর্য ধরা পড়ে শহুরে জীবনেও। সাকুরা বার সোডিয়াম লাইট কি সুইমিং পুলের বন্ধনেও জেগে থাকে শ্যামল বাংলাদেশ। ‘রূপসী বাংলা’ কবিতা জীবনানন্দীয় শব্দঘোরেও ভিনগ্রহের বাসিন্দা করে তোলে। পানোন্মত্ত বারের প্রতিটি কক্ষ হয়ে ওঠে গ্রাম্যবালিকার স্মৃতি-স্বপ্নমেদুরতা।
প্রতিটি কক্ষে জেগে উঠছে প্রমত্ত রূপসী বাংলা
দোয়াতে কলম রেখে আমি শুধু লিখে যাই গ্রাম্যবালিকা।
তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী ও সুস্পষ্ট শব্দের আঙিনায় পাঠকের অভিষেক ঘটে। সে-সঙ্গে কাব্যিক সত্যের ভেতরেও থাকে অসম্ভব উইট, জীবনের আয়রনি। মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকে মানবিক সংঘাতের পরতে পরতে। চলমান জীবন কখনও দুর্বহ। মানবিক প্রলোভনের দৌঁড় মানুষকে অসুখি করে তোলে। কবি কোনো এক পথশ্রান্ত জীবনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারেন এসব দৌড় বৃথাই। কারণ দৌড়বিদেরা তো যথাস্থানেই ফিরে আসে।
কারণ জানি, একজন দৌড়বিদ
যেখান থেকে শুরু করেন, দৌড়শেষে তাকে
সেখানেই ফিরে আসতে হয়।
একটি বৃক্ষের ভেতরে লুকনো থাকে ভবিষ্যতের স্বপ্নবীজ। পরাক্রান্ত যোদ্ধারা হন্তারক হয়ে থাকেন। কিন্তু প্রাচীন পিতামহ কখনো জানতে পারে না সেই হন্তারক সম্ভাবনার কথা। ‘হন্তারক’ কবিতায় ‘পরিত্যক্ত পারদ’-এর উপমায় সেটাই অঙ্কন করেন কবি। জগৎ-সত্য স্বীকার করে এ সম্ভাবনাতেই তো জেগে ওঠে চেঙ্গিস খানেরা।
নিত্যদিনের পাঠশালায় তৈরি হয় মজিদ মাহমুদের কবিতার অভিজ্ঞান। আধুনিক মানুষের বোধ সেখানে অভীষ্ট লক্ষ্য হয়ে থাকে।
কাগজ কুড়ানো শিশুদের পলিথিনের ব্যাগের ভেতর ঘুরে ঘুরে
কবিতাগুলো আবার আমার হাতেই ফিরে আসে।
দেখা যাবে, ‘কবিতা-২ ’-এর উপলব্ধি সেই ক্ষণস্থায়িত্বের ইঙ্গিত। এই ক্ষণবোধের ভেতর মানুষের প্রতিমূর্তি আব্রুহীন সৌন্দর্যে ভাস্বর। চেনাপথের গলি পেরিয়েই তা হয়ে ওঠে মানবিক প্রতিবেদন। ‘বেশ্যা’ কবিতায় যে নারী, সে যেন কসাইয়ের দোকানে রান ও সিনার সঙ্গে ঝুলে থাকা মাংসের ফালি। তার শরীর নেই, রয়েছে কেবল পায়ূপথ ও মূত্রনালী।
কখনো ইতিহাস কখনো ধর্মতত্ত্বে অন্তস্থ সত্যে কবিতা হয়ে ওঠে স্বকাল সমাসীন। ‘বাণী’ কবিতায় প্রফেটিক ইমেজে কবি নিজেকে অঙ্কিত করেন। কবিতা যেন দেবতার মতোই। ঐশী বাণীকেই বহন করে নিয়ে চলেন তাঁরা। কেবল যারা শুনবে তারা এখনো অশ্রুতপূর্ব। কিন্তু নবীরা তো তা নন, তারা বহুশ্রুত। ওদিকে ‘চিহ্ন’ কবিতায় পাই ভারতবর্ষীয় পৌরাণিক ধর্মবিশ্বাসের পুনর্জন্ম। ফিরে আসে পুনর্জন্ম লাভ করা মানুষ।
নির্ঘাত তুমি এক বিধবার স্বামী
তোমার অবর্তমানে শাদাশাড়ি আড়ম্বরহীন
শাখা ও সিঁদুর মুছে যাবে চিহ্নবিহীন
তুমি ছিলে তার প্রমাণ
একাকীত্বে ওড়ে মৌমাছির প্রাণ।
পথচলতি জীবনেই তৈরি হয় জীবনের প্রবল প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আসে অলঙ্ঘ সত্য-উপমা। পাথর চিত্রে খোদাই করা সেসব উপাদান নিত্যসত্য হয়ে বোধের সীমানায় পৌঁছে যায়। মজিদ মাহমুদের কবিতা সহজ সরল অথচ জটিল জীবনবোধে আক্রান্ত। ‘মিথ্যা অনাথ শিশুর মতো, পুষ্টিহীন বেশ্যার মতো/ প্রকাশ্যে পরিত্যাজ্য সভ্যসমাজে।’, ‘আপনেরা এভাবেই মরে যায়/ পররাই বেঁচে থাকে চিরকাল।’ কিংবা, ‘খোদার পৃথিবীতে আমরা কয়েদ সবাই।’ অথবা ‘ভালো ঘোড়া চাবুকের ছায়া দেখলেও দৌড়ায়।’ এসব কাব্যময় সহজ-দর্শনের বাক্যবন্ধ মৌহূর্তিক আবেগে হৃদয় আবিষ্ট করে। ‘সিংহ ও গর্দভের কবিতা’য় রয়েছে সেই আবেগ, যা নিত্যসচল জীবনের প্রতিধ্বনি। অথচ কবিতা পাঠের পরও সুগভীর রেশ থেকে যায় ভেতরে ভেতরে।
- লেখক: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন