হুজুগের জাতি, করি শুধু তেলেসমাতি!
করিতে পারি না কিছু, তয় ছাগল দিয়া চষি!
আমাদের দেশে সমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারযোগ্য লোকাল টেকনোলজির দিকে কাউকে মনোযোগী করে তোলা যায়নি। অথচ এদেশে তা-ই দরকার ছিল আগে। স্বশিক্ষিত মানুষও তৈরি করা যায়নি। এই অদক্ষ জনজাতি দিয়ে আমরা কী করবো? এই শিক্ষাব্যবস্থাই বা কী কাজে লাগে? বুদ্ধিজীবীরা তো বাগাড়ম্বর করেই সই। তারা টেলিভিশন মিডিয়ায় টকশো করে ফাটিয়ে ফেলবেন, দেশোদ্ধার করবেন। কাদের টাকা/ট্যাক্সের ওপর দিয়ে এসব হয়? বাপের ঘাড়ের ওপর বসে খাওয়া যেমন সহজ, তেমনি সহজ অন্যের যোগানো ট্যাক্সের ওপর বসে স্রোতের মতো বয়ে যাওয়া।
আজ থেকে ২১৮ বছর আগে ১৮০৬ সালে নেপোলিয়ান ও প্রুশিয়ানদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। প্রুশিয়ানরা সে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। তাদের আর্মি শক্তিশালী হলেও নিজেদের কৌশলের কারণে হেরে যায়। তখন প্রুশিয়ানরা এমন ধরনের স্কুল বানালো, যেসব স্কুলে ইয়াং জেনারেশনকে সুনির্দিষ্ট কারিকুলামের চাপে ফেলা যায়। তাদের লক্ষ্য ছিল—এদেরকে দিয়ে লেফট-রাইট মার্কা শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। প্রুশিয়ান এই শিক্ষাব্যবস্থায় সেট কারিকুলাম দেওয়া হতো আর সঙ্গে সঙ্গে বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিং দেওয়া হতো। এর মধ্য দিয়ে তারা মগজহীন বাধ্য সৈনিক বা ‘মাইন্ডলেস অবিডিয়েন্ট সোলজার’ তৈরি করতে চাইল। কিন্তু সেই সব শিশুদের এবং তাদের অভিভাবকদের সামাজিক সক্রিয়তা বা জ্ঞানের স্বয়ংক্রিয়তা হারাতে থাকল।
প্রুশিয়ানদের হাতে গড়া লেফট-রাইট মার্কা শিক্ষাব্যবস্থাকে ফলো করে সারা পৃথিবীতে গড়ে উঠল এই কারিকুলাম বেইজড স্কুল। এরপর শহরগুলো বদলে যাওয়া শুরু করে। এর মধ্যেই শুরু হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলুশন। অথচ অধিকাংশ গ্রামের মানুষ তখন পর্যন্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কারণ তারা তাদের কৃষির পাশাপাশি নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাতে পরিণত হয়েছিল। নিজেদের সৃজনশীলতা ব্যবহারের স্বাধীনতাও তাদের ছিল।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলুশনের ফলে শহরের কারখানাগুলো চালানোর জন্য গ্রামের মানুষকে শহরে নিয়ে আসার প্রলোভন দেওয়া হলো। অথবা তারা নিজেরাই বাধ্য হয়ে শহরে আসা শুরু করল। কারখানায় তখন প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন পড়তো। তেমনি করে মিডিয়েটর হিসেবে অফিসগুলোতে দরকার হতো প্রচুর সংখ্যক কেরানি। কাজেই কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করা কিংবা কেরানি তৈরি করাই ছিলো ওই শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য। ফলে শহরগুলো ক্রমশ বর্ধিত হওয়া শুরু করে। কিন্তু একইসঙ্গে তাদের ইন্ডাস্ট্রির প্রোডাক্ট বাইরে বিক্রি করার সুযোগও তারা তৈরি করে। এটা ছিল বুদ্ধিমান ও শহুরে উদ্যোক্তাদের একটা সুযোগ। এই সুযোগে তারা নাগরিক হওয়া শুরু করে। ভালো কাপড় পরিধান, ব্রান্ডের জিনিসপত্র কিংবা শ্রেণিগত আত্মপ্রচারও একইসঙ্গে বাড়তে থাকে। ক্রমশ শিল্পীরাও তাদের শিল্পকর্ম তৈরির সুযোগের জন্য শহরে আসতে থাকেন। কেননা শহর মানেই ক্যাফে, রেস্তোরা, সৃষ্টিশীল আড্ডা, সুন্দরী বারবণিতা প্রভৃতির হাতছানি। অন্যদিকে নিজেদের শিল্পকর্ম ছাপানো, প্রদর্শনী, পুরস্কার কিংবা বাহবা পাওয়ার সুযোগ বাড়তে থাকে।
কিন্তু একসময় অস্ত্রের ঝনঝনানিতে সারা পৃথিবীতে শুরু হয় মারামারি হানাহানি। বিশ্বযুদ্ধগুলো যার ফল। এছাড়াও আন্তদেশীয় যুদ্ধ, দলপাকাপাকির যুদ্ধ ক্রমশ পৃথিবীর শান্তিকে নরকে পাঠিয়ে দেয়। সৎ শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা হতাশ হয়ে পড়েন। শিল্পী সাহিত্যিকদের হাতে তৈরি হতে থাকে আধুনিকতা/মডার্নিটির ক্ষয়ের শিল্প। আত্মক্ষয় আর যন্ত্রণার চিৎকারই হয়ে ওঠে প্রধান। কারণ কাউকে তখন থামানো যাচ্ছে না। মানুষের হিংসা আর জিঘাংসাকে দমানো যাচ্ছে না, সেইসব বস্তাপচা শিক্ষা ও সংস্কৃতি দিয়ে।
এখন বাংলাদেশের কথায় আসি। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, বিদেশি টেকনোলজির ওপর নির্ভরশীল। ফলে কিছু সংখ্যক মানুষের স্বচ্ছলতা তৈরি হলেও, মানুষের ক্রিয়েটিভিটির ওপর নিজের স্বাধীনতা তৈরি হচ্ছে না। এমনকি যারা সৃজনশীল তাদের পেছনে রাষ্ট্র/সমাজ কোনো দায় বোধ করছে না। অর্থাৎ ‘সেল্ফ ডিপেডেন্সি’ আসছে না কোনোভাবেই। সেটা আমরা হতেও পারবো না আপাতত। শেখার স্কুল/বিদ্যায়তনগুলো সেভাবে তৈরি করা হয়নি। এখানে মিথ্যে অহংবোধ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। যার অধীনে আর চক্রে ঘুরছে মানুষ। সামাজিক বিধিব্যবস্থাও ‘মুই কি হনুরে’ ধরনের।
সপ্তদশ শতকের ইউরোপের মতো বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষকে শহরে নিয়ে এসে তোলা হয়েছে। কিন্তু তাদের মোটামুটি নিরাপদ জীবিকা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা না করেই তা করা হয়েছে। তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারতো, সেই সম্ভাবনাকে গলা টিপে, উপরন্তু ফাঁদে ফেলে তাদের জীবনকে নষ্ট করে তোলা হয়েছে। তারা এখন ঋণের চক্রে নিপতিত। গ্রামগুলোকে নষ্ট করে, তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে আমরা শহর বানিয়েছি। ইউরোপ-আমেরিকার মতো শহর/নাগরিকত্ব এদেশে তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ বিদেশে আমাদের বাণিজ্য নেই। সোজা কথা আমরা কারো কাছে কোনো কিছু বিক্রি করি না। ফলে অর্থ আসবে কোত্থেকে? সমানে ক্রয় করছি বিদেশি পণ্য, সেগুলো তৈরির দিকে মনোযোগ না দিয়ে।
ইউরোপ-আমেরিকার মতো গ্রাম তৈরি করা সম্ভব না হলেও, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর গ্রাম তৈরি করাই যায়। তার জন্য দরকার উপযুক্ত পরিকল্পনা। দেশের যারা রাজনীতি করছেন, তারা অজান্তেই একটা শহুরে মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরির ফ্যান্টাসিতে ভুগছেন। অথচ বাস্তবে এদেশে তা সম্ভব নয়। কারণ প্রকৃত মধ্যবিত্ত ও পরিশীলিত নাগরিক হওয়ার পরিবর্তে তারা শুধু সুবিধাটুকু নিতে সক্ষম। বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, এটা শুধু সিস্টেমজনিত ত্রুটি। উন্নত দেশে যারা থাকেন, তারা আমাদের চেয়ে বেশি মেধাবী নন। সমান মানুষ সমান মেধাকে কাজে লাগাতে পারছে না শুধু বাস্তববাদী পদক্ষেপ ও চিন্তাশীল না হবার কারণে। অনেকে উদ্যমী হয়ে অনেক কিছু করতে পারছেন না, শুধু ভালো ব্যকআপের অভাবে।
আমরা হুজুগে পড়া জাতি। মানুষের হাতে কাজ নেই। তা তৈরির ব্যবস্থাও নিতে অক্ষম করে তোলা হয়েছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির গোড়া নষ্ট করে। যে কোনো আইনের ফাঁদে গরিব মানুষরাই আগে পড়ে। সাধারণ মানুষের অনেকেই সন্তানের মুখে শুধু খাবারের চাহিদা মেটাতে হতাশ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে দিশেহারা হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। কখনো চিন্তা করে দেখেছি দেশে এতো এতো অটোরিক্সা কেন? সাধে?
কিন্তু নিরাপদ যানবাহন তৈরির মতো টেকনোলজি বেইজড ইন্ডাস্ট্রি/কারখানা এখানে গড়ে তোলা যায়নি। এটা একটা উদাহরণমাত্র। এ অবস্থা সর্বত্রই। অথচ উর্বর ভূমি ও জনবান্ধব টেকনোলজির ব্যবহার আমাদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে পারতো। রাজনীতিবিদদের অবিমৃশ্যকারিতা, মূর্খতা, জনমানুষের পক্ষে রাষ্ট্রের হিস্যা বুঝে নেওয়ার অপারগতা—সবই এর জন্য দায়ী।
*খোরশেদ আলম, শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন