মূল লিঙ্ক : 'কমন' ও 'জনপ্রিয়তা'র সন্ধানে | শিলালিপি | কালের কণ্ঠ
ঠিক কেমন হবে কাহিনী-কথন? এক বাক্যে এর উত্তর দেওয়া বোধ হয় সহজ নয়। হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে চিন্তা করতে গেলে একটা বিরাট ধন্ধে পড়ে যাই। কারণ তাঁকে নিয়ে আমাদের কথার রাজ্যে তোলপাড় কম হয়নি। যেমন বিরাট তাঁর ভক্ত-গোষ্ঠী তেমনি বিশাল তাঁর সমালোচনার বহর। তখন হাই স্কুলে পড়ি। ইতিমধ্যে তিনি সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে দেশের যেকোনো প্রান্তের মতো আমরাও হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখার অধীর আগ্রহে টিভি সেটের সামনে বসে থাকি।
এরপর তাঁর কিছু উপন্যাস ও সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। আবার কখন, কেন তাঁর বেশ কিছু লেখা গোগ্রাসে পড়েছি ঠিক জানি না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য বিভাগে পড়তে এসে সমালোচনার হরেক রকম ফিকির চিন্তাকে ক্রমেই জটিল করে দেয়। এর ফল অনেক দিন সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নাম পাশ কাটাতে পারলেই বাঁচি। প্রতিবার একুশে বইমেলায় 'অন্যপ্রকাশে'র স্টলে একদঙ্গল উঠতি তরুণ তাঁকে হুমড়ি খাবার ধরনে ঘিরে থাকতে দেখেছি। একবার উঁকি দিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে শুধু তাঁর অবয়বটা দেখার কৌতূহল মেটাই।
এবার তাত্ত্বিক ফ্যাসাদ বাধাল 'পপুলার কালচার', 'পপুলার লিটারেচার'। গণ্ডগোলটা টের পেলাম নিজের মধ্যে। তাহলে সাহিত্যের ধ্রুপদী, আধুনিক ও বিশ্বমান নামক ব্যাপারের সঙ্গে আটকে গেছে মন। বিচার নামক বিষয়টি বরাবরই নির্মম। তাহলে কি হুমায়ূন অনেক ক্ষমতাশালী লেখক? এ প্রশ্নটাও জটিল। তাহলে শুধু ক্ষমতাকেই সর্বেসর্বা করে নেওয়া হয়। কিন্তু সেটা কিসের ক্ষমতা? সাহিত্যিকের গভীরতা-তরলতা, গাম্ভীর্য-বাঁচালতা নাকি শুদ্ধ গাল্পিকতা বা হতচ্ছাড়া পোস্টমডার্ন- এসব তাত্ত্বিকতাও এখন ফিকে হলো প্রায়। নানা পরিবর্তনের খেয়াল-রাগিণী লক্ষ করি। একজন সাহিত্যিক ঠিক কোন ব্যাপারের সঙ্গে আটকে থাকবেন- সেটা তাঁর নিজস্ব নিয়তি।
এরপর দেখা যাক, হুমায়ূন আহমেদ যাঁর স্বভাবটাই নাকি এমন- তিনি অতৃপ্ত ক্রিয়েটিভ লোক হতে চাননি। ক্রিয়েটিভিটির অন্যতম নিয়তি হলো অতৃপ্ত থাকা। হুমায়ূন বিনয়ের সঙ্গে তা অস্বীকার করেন। বাংলা সাহিত্যের 'বড় জাদুকর' নয়, তিনি 'দীনহীন সেবক' বলে আখ্যায়িত করেন নিজেকে। জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গে 'জন' অস্তিত্বকে তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন। অর্থাৎ 'জন'কে খাটো করে দেখতে চাননি তিনি মোটেও। আবার এর উল্টো ব্যাপারও আছে- তিনি নাকি নিজের লেখার বিষয়ে বেখাপ্পা ধরনের অহংকারী- অবশ্য ঋজু মৃদুতার সঙ্গে তাঁর নিজের সরল স্বীকারোক্তি এটি- মোটেও অন্যের কথা নয়। তাহলে কী ধারণা করতেন তিনি নিজের লেখা বিষয়ে? অন্যের মন্তব্য নিয়েও বাড়াবাড়ি রকমের লেগে পড়ার স্বভাব তাঁর ছিল না। আত্মতা-মগ্নতা-সঙ্গলিপ্সুতা সব কিছুর বিনিময়ে স্বভাবজাত আচরণকে সিদ্ধ করে নেওয়ার ভঙ্গি ছিল তাঁর। একবার সাইকিক একদল হিমুকে বোঝানোর জন্য তাঁকে ভীষণ কষ্ট স্বীকার করতে হয়। তিনি বললেন, 'শোনো, এই হিমুগুলি আমার লেখা। কাজেই আমি জানি, এটা ফিকশন। এটা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার কিছু নেই।'
এবার চেক অ্যান্ড ব্যালান্স- এলেন মিসির আলী। গোয়েন্দা কাহিনী-ক্রাইম ফিকশন-থ্রিলার কোনোটিই নয়। হিমুর এন্টিলজিক মিসির আলী। দুই বয়সের দুজন প্রবল প্রতাপে যে যার দর্শনকে হাজির করছে। হাইব্রিড-ক্যাপিটালিজমের যুগে প্রতি মুহূর্তে মানুষ নিজেকে বাঁচাতে পারাও যেন বড় ব্যাধি-মুক্তি। হুমায়ূনের হিমু কারো রোগমুক্তির আকাঙ্ক্ষা হোক না হোক- লেখকের কাছে হিমু খুব প্রিয় একটা চরিত্র। কারণ 'হিমু অনেক কিছু করে যেগুলো আমরা করতে চাই, কিন্তু করতে পারি না।'
যুক্তিতর্ক, একই সঙ্গে অসীমতা, বিজ্ঞানের কল্প দরজা খুলে প্রহেলিকায় বন্দি করা- এসবের মধ্যে অন্য প্রকৃতির হুমায়ূন ধরা পড়ে। প্রকৃতি-বিজ্ঞান-মানুষ তাঁর কাছে রহস্যের জট খোলা কোনো ব্যাপার নয়। তাঁর দাবি, 'আমি খুব কনভিন্সড্, আমরা একদিন গাছের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।' সবাই পৃথিবীকে, সৃষ্টিকে জানার জন্য গবেষণা করছে। হুমায়ূন আহমেদ এই জানার প্রক্রিয়ায় রহস্যবাদী, অজ্ঞেয়বাদী, পরিণামে মিস্টিক। রহস্য-রোমান্স ব্যতিরেকে তাঁর কথাসাহিত্যে সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে 'স্কেপিস্ট' মনোভাব আবিষ্কার করা কঠিন নয়। তবে সব সময় শুভবোধ 'এন্ডিং'-এর বিশ্বাসে পরিচালিত তাঁর মনোভঙ্গি কখনো ব্যক্তিগত, কখনো উপলব্ধিপ্রবণ, কখনো হাস্যরস উদ্দীপক। হুমায়ুন আজাদ তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে আপত্তিকর শব্দ প্রয়োগ করলেও কথাসাহিত্যের প্রশ্নে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে অনেক উঁচুতে রাখতে চেয়েছেন। তিনি হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের রসজ্ঞান ও সহজবোধ্য ভাষার প্রশংসা করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর জীবদ্দশায় যেকোনো বিতর্ক বা প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তরও দিয়েছেন। কোনো এক অনুষ্ঠানে এক ভদ্রলোক হুমায়ূন আহমেদকে আক্রমণ করলেন 'পোলাপান' ও 'মধ্যবিত্তে'র লেখক বলে। তিনিও বলে ফেললেন, 'আমি তো তাও মধ্যবিত্ত নিয়ে লিখি। উনি তো রাজা-বাদশাহর নিচেই নামেননি। তাঁর নাম উইলিয়াম শেকসপিয়ার।' তবে আমাদের বিবেচনায় তাঁর সাহিত্যে নিম্নবিত্তের সহাস্য পরিচয়ের পেছনে একটি প্রণোদনা হিসেবে কাজ করত একধরনের খেয়াল; কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের অবস্থান তৈরি করার সূক্ষ্ম বুদ্ধি। মাধ্যম-পরিবর্তনে দৃশ্যমান সিনেমার ভেতর দিয়েও সেসব তিনি ধরেছেন। 'ঘেটুপুত্র কমলা' তাঁর সে রকম অভিজ্ঞতার কথা বলে। কিভাবে নিম্নবিত্তের মানুষ অসাধারণ টেক্সট হয়ে ওঠে- সেখানেই নিহিত হুমায়ূন আহমেদের দরদবোধ। লেখকের আনকন্শাস থেকে সেটা সবার চোখের সামনে তুলে ধরেন তিনি। বিভূতিভূষণকে তিনি অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখেছেন। আবার তিনিই বলেছেন- 'দুর্গা'র প্রতি আরেকটু সদয় হলে লেখকের কী-ইবা ক্ষতি হতো! এখানেই লেখক-লেখকে শুধু আবেগী নয়, ঘটনা সংঘটনেরও পার্থক্য। হুমায়ূন আহমেদ এ ক্ষেত্রে দুর্গাকে বাঁচাতেন না সত্য, তাকে আরেকটু স্নেহে আগলে রাখারই পক্ষপাতী হতেন। কিন্তু কে না জানে- দুর্গা কাহিনীর চরিত্র? অন্যদিকে যেকোনো হিরোই তা হিমু হোক আর যেই হোক- তাতে সমসাময়িক জীবনের সঙ্গে নস্টালজিক করার মধ্য দিয়ে লেখক-পাঠকে তৃষিত-প্রত্যাশিত টানাপড়েন তৈরি হয়। এই টানাপড়েন তাদের গভীর যোগাযোগ-সূত্র; যে কারণে কিশোর-তরুণরা হিমুর পাগলামিকে অযাচিত প্রশ্রয় দেয়।
জন্ম ও জীবনের জঙ্গমতা হুমায়ূন আহমেদকে পেয়ে বসেনি কখনো। বস্তুত যেকোনো রকম ভান-ভণিতার ঊর্ধ্বে ওঠার কারণে তরুণসমাজের বৃহত্তর একটি অংশের নিরঙ্কুশ ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। কারো কারো অভিযোগ- তিনি হয়তো পারতেন আরো একটু দায়িত্বশীলতা নিয়ে তরুণসমাজকে পরিচালিত করতে। তবে তিনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না হয়েও প্রায় সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু রাজনীতি যা পারেনি, হুমায়ূন আহমেদ তা পেরেছেন। জীবনের স্বপ্ন বুনতে শেখা তারুণ্যকে তাঁর পক্ষে এর চেয়ে কী-ইবা বেশি দেওয়ার ক্ষমতা? এ প্রশ্নের জবাবে থমকে দাঁড়াই। 'বাকের ভাই'খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর ছিলেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র 'শঙ্খনীল কারাগার'-এর একজন কুশীলব। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই তিনি অর্থ সন্ধানে বড়লোকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণে আউট স্পটে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি।
'একটা লেখা লেখার জন্য যে পরিমাণ প্রস্তুতি আমার থাকা দরকার, যে পরিমাণ পড়াশোনা নিয়ে আমার একটা লেখা লিখতে যাওয়া উচিত, ওই জায়গাটা আমি অবহেলা করি।' এমন স্বীকারোক্তি সচরাচর বিরল। হুমায়ূন আহমেদকে 'বাজারি লেখকে'র তকমা জীবদ্দশাতেই অনেকে তাঁকে এঁটে দিয়েছেন। এর পেছনে বড় কারণ লেখা নিয়ে বা লেখা শেষ করা নিয়ে তাঁর বড্ড বেশি তাড়াহুড়ো। সেই তড়িঘড়িতে ৩০০ বছরের কচ্ছপ জীবনের সঙ্গে তুলনায় মানবজীবনে অন্তত এক হাজার বছর বাঁচার প্রত্যাশী হুমায়ূন বোধ হয় একটু তাড়াহুড়োই করলেন।
আসলে হুমায়ূন আহমেদ শিল্পের কারবারিতে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা সাজতে চেয়েছিলেন। তিনি সেই স্বপ্নেই ভাসাতে চেয়েছিলেন তাঁর ভক্তকুল তথা অনুসারীদেরও। হয়তো এ জন্যই পৃথিবীর ইতিহাসে হলুদ পাঞ্জাবির এত এত হিমু তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল। কারণ তিনি মনে করতেন, 'আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, মর্বিডিটি মানুষের অর্জিত একটা ব্যাপার। জন্মগতভাবে মানুষ মর্বিড না। একটা মানুষকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মর্বিড দেখানোর আমি পক্ষপাতী না। আমি মনে করি, শুদ্ধতম চেতনা নিয়ে আমরা পৃথিবীতে এসেছি। যেসব মর্বিডিটি আমরা পাচ্ছি সেগুলো আমরা সঞ্চয় করেছি। আমাদের মধ্যে সেগুলো দিয়ে পাঠানো হয়নি। যে জিন নিয়ে আমরা এসেছি তার মধ্যে কোনো মর্বিডিটি ছিল না।' বলা বাহুল্য, এই মর্বিডিটির অনেকটাই ইউরোসেন্ট্রিক আধুনিকতাঘেঁষা। বিষণ্নতা নামক খিন্নতা থেকে বের হওয়ার একটা খিড়কি দরজা হুমায়ূন আহমেদ খুঁজতে চেয়েছিলেন। কথাসাহিত্যের চরিত্রে মাদকতা সৃষ্টি সে ক্ষেত্রে খুব দোষের হয় না বলেই ভাবি। কারণ অনেকগুলো বড় সমস্যার ভেতরে দেশীয় তরুণসমাজ ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত। তিনি লেখনী জগতের মাদকতা দিয়ে তরুণসমাজকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন- এই যা।
বিকাশমান আধুনিকতায় এসে উল্লিখিত মর্বিডিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সহজ বিষয় নয়। সাহিত্যিকের বড় কাজ স্বপ্ন দেখানো। কারণ অঘটনঘটনপটীয়সী বিশ্বে মানুষ সত্যিকার অর্থে এক নিরাশ্রিত জীব। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকার বা জীবনকে অর্থবহ করে তোলার নানা ম্যাজিক দেখিয়ে অবলম্বনহীন এক কঠোরতা যাকে 'ট্রমা'ও বলা যেতে পারে- সেখান থেকে মানুষকে রেহাই দিতে চেয়েছিলেন। সে পথ কোনদিকে গেছে সে বিচার সাইকিয়াট্রিকের। তবে শিল্পের নানা মাধ্যমে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষের 'কমন' সাংস্কৃতিক কণ্ঠস্বরকে ধারণ করার বাসনা ছিল তাঁর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন