ওউদ (বাদ্যযন্ত্র) থেকে বাংলার ‘ঈদ’ উৎসব

আরবি শব্দ ‘আউদ’ (عود)-এর অর্থ একপ্রকার বাদ্যযন্ত্র। ‘ঈদ’ শব্দের মূল শব্দ এই আউদ। আরবিতে যা আউদ, তুর্কিতেও তা আউদ এবং পারস্যে বলা হয় বারবাত। বারবাত শব্দটা আবার হিন্দিতে পাওয়া যায় যেমন, ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বলিউড চলচ্চিত্র ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ যেখানে রণবীর সিং এবং অনুষ্কা শর্মা মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন। যদিও বিভিন্ন ভাষায় বারাতের অর্থ অনুষ্ঠান, রাত, ভাগ্য, মুক্তি ইত্যাদি। ভারতীয় উপমহাদেশে বারাতের অর্থ বিবাহ উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা। যাই হোক, বাংলায় এই আউদ বা বারবাতকে বলা যায়, এক ধরনের তারের যন্ত্র যা, গিটার বা ম্যান্ডোলিনের মতো দেখতে। এর থেকে উৎপন্ন সুর খুব মোহনীয় আর চমৎকার। 

আউদ/ওউদ (ফুটনোটে বর্ণনা আছে)

ল্যুট (ফুটনোটে বর্ণনা আছে)


বর্তমানে ঈদ عيد শব্দের অর্থ হচ্ছে খুশি, আনন্দ, উৎসব, পার্বণ, পর্ব ইত্যাদি। উৎপত্তিগতভাবে তা ওউদ/আউদ ‘عود’ বাদ্যযন্ত্র থেকে আগত। যেটি আবার ইউরোপীয় ‘ল্যুট’ (Lute) পরিবারের একটি যন্ত্রকে বোঝায়। উৎপত্তি যা-ই থাক, সঙ্গীতের একটি বড় অবদান আনন্দ, বেদনাময় আনন্দ, এমনকি আনন্দময় বেদনা সৃষ্টি করা। অন্যদিকে আরবি ওউদ/আউদ ‘عود’ শব্দের একটা আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ফিরে আসা। সুখ-দুঃখ, রোগ-দুশ্চিন্তা, আনন্দ-বিষাদ সবকিছুই তো মানুষের কাছে ফিরে ফিরে আসে। এর আরও অর্থ আছে, আর তা হলো—লোকজনের সমাগম, যেখানে কোনো সম্মানিত বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করা হয়। 


ইসলামপূর্ব আরবে শরৎ ও বসন্তে দুটো উৎসব পালন করা হতো। মূলত মদিনার অধিবাসী ইহুদি ধর্মের মানুষ এই উৎসব পালন করতো। উৎসব দুটোর নাম নওরোজ ও মেহেরজান। ফারসি ‘নওরোজ’ মানে নববর্ষ, যাকে আরবিতে বলা হয় ‘আলসানাত আলজাদিদা’। হিজরি সাল হিসেবে যা হয়ে যায় ‘রাআস্সানাহ্ আল হিজরিয়া’। আর মেহেরজান শব্দের মানে বসন্ত। শরৎ ও বসন্তের সেইসব উৎসবে অন্যান্য আরবরাও অংশগ্রহণ করতো। এই উৎসবগুলো শুধু আরবে নয়, প্রত্যেকটা জনজাতির জীবনে ফিরে ফিরে আসে। শুধু ফিরে আসে না বরং সুখ-দুঃখ সাথে করে নিয়ে আসে। তবুও মানুষ আনন্দমত্ত হয়। মানুষ দুঃখকে ভুলে আনন্দ পেতে চায়। দুঃখ ছাড়া পৃথিবীতে শতভাগ আনন্দ নেই। 


ইসলামের নবি মুহাম্মদ (স.) মক্কা থেকে মদিনায় হিযরত করার পর ‘ঈদ’ নামে নতুন উৎসব প্রবর্তন করেন। মুসলমানদের নির্দেশিকা হিসেবে কোরআনে এর উল্লেখ সরাসরি নেই, তা রয়েছে অন্যভাবে। সুরা মাঈদা’র ১১৪ নম্বর পংক্তিতে বলা আছে—  


قَالَ عِیۡسَی ابۡنُ مَرۡیَمَ اللّٰهُمَّ رَبَّنَاۤ اَنۡزِلۡ عَلَیۡنَا مَآئِدَۃً مِّنَ السَّمَآءِ تَکُوۡنُ لَنَا عِیۡدًا لِّاَوَّلِنَا وَ اٰخِرِنَا وَ اٰیَۃً مِّنۡکَ ۚ وَ ارۡزُقۡنَا وَ اَنۡتَ خَیۡرُ الرّٰزِقِیۡنَ 

﴿۱۱۴﴾


অর্থ : মরিয়ম পুত্র ঈসা (আ.) বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের প্রতি আকাশ হতে খাদ্য অবতীর্ণ করুন যেন ওটা আমাদের, অগ্রজ ও  অনুজদের জন্য একটি আনন্দের(ঈদ) বিষয় হয় এবং আপনার পক্ষ হতে এক নিদর্শন হয়ে থাকে। আর আমাদেরকে রিজিক প্রদান করুন, বস্তুত: আপনিতো সর্বোত্তম জীবিকা প্রদানকারী।    

[Said Jesus, the son of Mary, "O Allah, our Lord, send down to us a table (spread with food) from heaven to be for us a festival (EID) for the first of us and the last of us and a sign from You. And provide for us, and You are the best of providers."]


বিবিসি বাংলার রিপোর্টে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের অভিমতে, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ঈদ উদযাপন করা হয়েছিল। মহানবি যখন মক্কা থেকে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হিজরত করে মদিনায় যান, তখনকার সময়কে ভিত্তি ধরে হিজরি সাল গণনা করা হয়। হিজরি প্রথম বছরের নবম মাস অর্থাৎ রমজান মাসে একমাস রোজাকে অবশ্য পালনীয় বলে ধার্য করা হয়। বস্তুত ঈদের সামাজিকতা ওই সময় থেকে শুরু। আনাস (রা.) নামে একজন সাহাবির বর্ণনা মতে, মদিনায় যাওয়ার পর নবি দেখলেন যে, সেখানকার মানুষ বছরে দুটো বড় উৎসব পালন করে। নবি মুহাম্মদ ওই দুটো দিনের আদলেই দুটো দিবসকে মুসলমানদের জন্য উৎসব পালনের জন্য নির্ধারণ করে দেন। অতীতে এ দুটো দিনে তারা খেলাধূলাসহ নানা ধরনের আমোদফূর্তি করতো। 


মুসলমান জনগোষ্ঠী ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদের নামাজ প্রথম পড়ে খ্রিষ্টাব্দের হিসেবে ৬২৪ সালে। মহানবি বড়-ছোট সবার দিকে বিশেষ খেয়াল করতেন, যাতে সবাই তাদের অধিকার পায়, নতুন জামাকাপড় পড়তে পারে, কেউ অভুক্ত না থাকে। নবি-স্ত্রী আয়েশা(রা.)-র মাধ্যমে জানা যায়, একবার আবিসিনিয়ার কিছু লোক লাঠিখেলায় অংশগ্রহণ করেছিল ঈদের দিন। নবি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সেই খেলাটি উপভোগ করেছিলেন। তিনি নাকি আরেকটি কাজ করতেন, আর তা হলো, এক রাস্তা দিয়ে গেলে অন্য রাস্তায় ফিরতেন। এতে হয়তো গরিব-দুখি মানুষের খোঁজখবর নেওয়াটা তাঁর জন্য সহজ হতো। 


বাংলাদেশে ঈদ উৎসবের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বর্তমানে ঈদ উৎসব যেন অনলাইন নির্ভর হয়ে উঠেছে। কে কোথায় ঈদের নামাজ পড়লো, কে কি ধরনের পোশাক পড়লো, কি খেলো বা কোথায় বেড়াতে গেলো, এগুলো ফলাও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে তারা। একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল ঈদের কার্ড। তখন বন্ধুবান্ধব বা নিকটাত্মীয়রা কার্ড বিতরণ করে একে অপরকে অভিবাদন জানাতো। তথ্যপ্রযুক্তির এ-যুগে তা এখনও টিকে আছে, তবে ডিজিটাল কার্ড হিসেবে। 


ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও নামাজ, রোজা ও ঈদোৎসবের প্রচলন হয়েছে তারও বেশ আগে থেকেই। ভারতবর্ষ মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকরা ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব-বাংলায় আসেন। আরবীয় এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমে বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। ধারণা করা হয়, তখন থেকেই মুসলিম-সংস্কৃতি পূর্ব বাংলায় প্রভাব বিস্তার করে। তবে, পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে ঈদ উদযাপনকে জনপ্রিয় করে তোলে মোঘলরা। সে সময়ের চিত্রশিল্পে মোঘল সম্রাট বাবরকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে রাজ দরবারের সভাসদকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে দেখা যায়। মোঘল সৈন্যদের ছাউনি থেকে ঈদের আনন্দবার্তা ঘোষণা করা হতো।

মোঘলদের সময়ে ঈদের দিন মুসলমানরা নতুন নতুন পোশাকে সজ্জিত হতো। সব বয়সের নারী-পুরুষ সুন্দর সুন্দর কাপড় পরতো। পোশাক সজ্জিত অবস্থায় তারা শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতো। এভাবে ঈদগাহ্ পর্যন্ত দলবেঁধে যাত্রা করতো। অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা প্রভুত অর্থ ও উপহারাদি পথে পথে ছড়িয়ে দিতেন। আরও জানা যায়, মোঘলরা ঈদ উদযাপন করতো ২ থেকে ৩ দিন ধরে। বিচিত্র খাবার তৈরি করা ছিল তাদের অনন্য সংস্কৃতির অংশ। এই পোশাক ও খাবারের প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। 


তৎকালীন কলকাতায় দেখা যেতো ঈদের বাহারি দৃশ্য। পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশভাগের সময় যেসব সাহিত্যিক পূর্ববঙ্গে আগমন করেছেন, তাঁদের স্মৃতিকথায় এর কিছু কিছু স্পষ্ট হয়। যেমন কথাসাহিত্যিক আবু রুশদ (১৯১৯-২০১০) তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবন ক্রমশ’তে বর্ণনা করেছেন, "যেদিন ঈদের চাঁদ দেখা দিতো সেটা ছিল মহা স্ফূর্তির সময়। সাধারণত দুই ঈদের ব্যবধানে আমরা নতুন কাপড় ও জুতো পেতাম। খুব বাহারি কিছু নয়। পায়জামা ফুজি সিল্ক-এর পাঞ্জাবী আর চপ্পল।…” তাঁর এই স্মৃতিকথা থেকে যে চিত্র পাওয়া যায়– ১. ঈদ উপলক্ষে মুসলমানদের নতুন কাপড়-চোপড় কেনার রেওয়াজ ছিল। ২. কলকাতার বিভিন্ন মুসলিম এলাকায় ঈদের দিন কাওয়ালী গানের আসর হতো। ৩. বড়দেরকে সালাম করার রীতি ছিল। তারপর ছোটদেরকে সালামি/উপহার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। এই রেওয়াজটি নাকি শুধু তার সময়ে নয়, কমপক্ষে শতবছর পূর্বেও ছিল। সালামির রেওয়াজের খবর পাওয়া যায় ত্রিশের দশকে কলকাতায় বেড়ে ওঠা অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের স্মৃতিকথায়:

"বড়দেরকে সালাম করবার পর তখনকার দিনেও ছিল সালামি উপহার দেওয়ার রেওয়াজ। এখন বেশ মজাই লাগে ভাবতে—পুলিশের নিচের পদের হাবিলদার সাবেরা সালামি দিতেন ডবল পয়সা। মাথায় মুকুট কুইন ভিক্টোরিয়া অথবা সম্রাট পঞ্চম জর্জের ছাপ‌অলা তামার ডবল পয়সা। সেই যে কত ছিল!" (কিশোর বেলা, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ২০১৯, ২৬)


সৈয়দ মুজতবা আলীর পূর্বপুরুষরা ছিলেন বাংলাদেশের সিলেট জেলার করিমগঞ্জে। সেখানে ভাইবোন আত্মীয় পরিজন সমেত তাঁদের ছেলেবেলা কেটেছে। তাঁর বড় ভাই সৈয়দ মুস্তফা আলী ‘আত্মকথা’য় লিখেছেন: 

"শীতের দিনে রোযা শুরু হয়েছে। সমস্ত দিনের কর্মসূচি পালটিয়েছে। মা খুব ভোরে উঠে আমাদের খাইয়ে দাইয়ে রোদে বসেছেন। আমরা সকলে শিউলী ফুলের পাপড়ি ছাড়িয়ে লাল বোঁটা একত্র করছি। মা পাশে বসে সেমাই তৈরি করছেন। সেমাই ডালার উপর রেখে মা রৌদ্রে শুকোতে দিলেন। শিউলির বোঁটাও রৌদ্রে দিলেন। তারপর মা কাপড় কেটে পাজামার মাপ নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গায়ের জামার মাপ। আমাদের কি আনন্দ! পয়লা রোযা হ'তে নিত্য চললো ঈদের প্রস্তুতি। পঞ্চাশ বছর পূর্বের (১৯১৮) কথা বলছি। সন্ধ্যার সময় শিউলীর বোঁটা উঠিয়ে মা একটি বোতলের ভেতর রাখলেন আর সেমাই ভর্তি করলেন বিস্কুটের টিনে। ঈদের দিন মা রাঁধবেন কোরমা পোলাও। আর জরদাতে দিবেন ঐ শিউলী ফুলের বোঁটার রং— তাতে জরদার শুধু যে রং খোলতাই হবে তা নয়— চমৎকার ঘ্রাণ‌ও বেরুবে। আর সেমাই তৈরি হবে—যে সেমাই মা নিজের হাতে সারা মাস ভর করেছেন; আমাদের গায়ে উঠবে মার নিজের হাতে সেলাই জামা পাজামা। মাকে নিয়েই ঈদ আর ঈদের খুশীর সব, তাতে রয়েছে মার হাতের স্নেহের পরশ। এ খুশী ভুলবার নয়!" (সৈয়দ মুস্তফা আলী, ১৯৬৮, ৯-১০)।


তিনি আরও জানিয়েছেন, কীভাবে প্রতিবেশীরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন—কার আগে কার বাড়ি নাশতা পাঠাবে। শুধু সিলেটের নয়, শতবছর আগে কর্মসূত্রে ফরিদপুরেরও চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন, যা বাংলাদেশে, বিশেষত গ্রাম ও মফস্বলে আজও মানুষ ঈদ উপলক্ষ্যে করে থাকে। 


আবুল মনসুর আহমদ (১৯৯৮-১৯৭৯) যেভাবে ঈদকে দেখেছেন, তার চিত্র ‘আত্মকথা’য় ধারণ করেছেন : "সাধ্যমতো নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়া লোকেরা বেদম গান-বাজনা করিত। সারারাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইত। প্রায় বাড়ি বাড়ি ঢোল-ডগর দেখা যাইত।" (আত্মকথা, আবুল মনসুর আহমদ, ২০১৪, ২৮)। তাঁর  জন্ম হয়েছিল ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধানিখোলা গ্রাম। বর্তমানে ঈদের উৎসবমুখর পরিবেশে গান-বাজনার যে পরিবেশ দেখা যায়, তা নতুন নয়। শতবর্ষ পূর্বে ময়মনসিংহের ত্রিশালেও ছিল ঈদের দিন বাদ্য বাজানোর রেওয়াজ।


বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের সংস্কৃতি মোটামুটি কাছাকাছি। আজও ঈদের দিন মানুষ নতুন জামাকাপড় পড়ে। প্রতিবেশী বাড়িতে মিষ্টি শেমাই ফিরনি পাঠায়। পোলাও কোর্মা সুস্বাদু ব্যঞ্জন তথা হরেক রকম পদের খাবার ছাড়া অতিথি আপ্যায়ন হয়ই না বলতে গেলে। সবচেয়ে বড় কথা, ঈদকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরের তথা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও মুসলমানদের বাড়িতে আগমন করেন। এই সম্প্রীতির বাঁধন এদেশের সব গ্রাম-গঞ্জ, ছোটবড় শহর কি মফস্বল সবখানেই দেখা যায়। ঈদকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। 


সর্বোপরি ঈদকে কেন্দ্র করে গরিব বঞ্চিত ও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ায় মানবিক মুসলমানেরা। বলতে গেলে, যাকাত ও আর্থিক সহযোগিতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে ঈদকে কেন্দ্র করে বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক চমৎকার সুযোগ তারা পেয়ে থাকেন। ঈদ মানে পরস্পরের সঙ্গে সৌহার্দ বিনিময়, সুখ-দুঃখকে ভাগ করে নেবার একটা উপায়, মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মন্ত্র। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ২০২৪ সালের ঈদের দিনেও ফিলিস্তিনে বোমা হামলায় শতাধিক নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সারাবিশ্বের মানুষ এই মজলুমদের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করলেও, যুদ্ধবাজ ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার একদল অমানুষ থেকে তারা রেহাই পাচ্ছে না।


বাংলাদেশের দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়, বরং মাত্রাতিরিক্ত। সম্মিলিতভাবে তাদের জীবনের মান বৃদ্ধির জন্য আরও বড় গণজোয়ার হিসেবে এই ঈদ উৎসবকে কাজে লাগানোর সুযোগ মুসলমানরা গ্রহণ করতে পারেন। এতে মানবকল্যাণে তাদের ভূমিকাকে সবাই বড় করেই দেখবে। একটা সুন্দর সমাজ-পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঈদ একটা প্রবল সুযোগ হয়ে উঠতে পারে। সর্বোপরি ঈদ শব্দের যে উৎস আনন্দ-সঞ্চার, তা যেন উচু-নিচুর ভেদাভেদকে দূর করতে পারে। তবেই হয়তো ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। মুসলমানদের আত্মপ্রতিষ্ঠা ও সাংস্কৃতিক উচ্চমন্যতা তৈরিতেও তা ভূমিকা রাখতে পারে। 


ফুটনোট

*ওউদ/আউদ ‘عود’-এর রোমান উচ্চারণ ʿūd [ʕuːd], এটি মধ্যপ্রাচ্যের ছোট গলাবিশিষ্ট ল্যুট-টাইপ, নাশপাতি আকৃতির, ফ্রিটলেস তারযুক্ত একটি বাদ্যযন্ত্র। কর্ডোফোন যন্ত্রের শ্রেণিবিভাগে তাকে বলে বলা হয় Hornbostel-Sachs। সাধারণত ১১টি স্ট্রিং ছয়টি কোর্সে গোষ্ঠীভুক্ত, কিন্তু কিছু মডেলের যথাক্রমে ১০ বা ১৩টি স্ট্রিং সহ পাঁচ বা সাতটি কোর্স থাকে। প্রাক-ইসলামিক পারস্য, আরব এবং মেসোপটেমিয়াতে, তারযুক্ত যন্ত্রের কেবল তিনটি তার ছিল। একটি ছোট বাদ্যযন্ত্রের বাক্স এবং একটি লম্বা গলা ছিল কোনো সুরের খুঁটি (টিউনিং পেগ্স) ছাড়াই। কিন্তু ইসলামি যুগে বাদ্যযন্ত্রের বাক্সটি বড় করা হয়, একটি চতুর্থ স্ট্রিং যোগ করা হয়। এবং টিউনিং পেগ (বুনজুক) বা পেগবক্সের ভিত্তি যোগ করা হয়। ঐতিহাসিক সূত্রমতে, জিরিয়াব (789-857) তার অউদে একটি পঞ্চম স্ট্রিং যোগ করেছিলেন। তিনি আন্দালুসিয়ায় সঙ্গীতের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। ধারণা করা হয় যে, এখান থেকেই ওউদ বা ল্যুট ইউরোপে প্রবেশ করেছিল।  


**ল্যুট Lute সুনির্দিষ্টভাবে, ‘ল্যুট’ শব্দটি সাধারণত ইউরোপীয় ল্যুট পরিবারের একটি যন্ত্রকে বোঝায়। এই শব্দটি সাধারণত সাউন্ড টেবিলের সমান্তরালে একটি সমতলে চলমান স্ট্রিং সহ যে কোনো স্ট্রিং যন্ত্রকে বোঝায় (হর্নবোস্টেল-স্যাক্স সিস্টেমে)। ল্যুট শব্দটি যেন লিটারেচার শব্দের প্রথম অংশ লিট। গীতিকবিতা যেখান থেকে আগত সেই Lyrical Poetry-র প্রথম অংশ Lyre-ও সমান উৎস থেকে আগত বললে অত্যুক্তি হবে না। সেখানেই আবার লুকিয়ে আছে Lyric নামক শব্দটি। প্রথম যুগের কবিতার সঙ্গে সঙ্গীতের ছিল গাঁটছড়ার বাঁধন। মানুষের জীবনের উৎসবমুখরতার সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্ক নিবিড়।


***বারবাত (ফার্সি: بربت) বা বারবুদ হল বৃহত্তর ইরান বা পারস্য উৎপন্ন একটি একটি ল্যুট ধরনের বাদ্য। বিশেষ করে সাসানি সাম্রাজ্যের পর থেকে এটি মধ্য এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত হয়। বারবাতকে একটি কাঠের টুকরো থেকে খোদাই করা হয়। এর মধ্যে একটি গলা এবং একটি কাঠের সাউন্ড বোর্ড রয়েছে। এটি কাঠ-শীর্ষ ওউদ, বিওয়া এবং চামড়া-শীর্ষ ইয়েমেনি কানবাসের সমগোত্রীয়। আসল বারবাত বর্তমানে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আধুনিক ইরানি লুথিয়াররা বারবাত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একটি নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। আধুনিকভাবে নির্মিত এই যন্ত্র (ইরানি বারবাত) ওউদের সঙ্গে তুলনীয়। ওউদের সঙ্গে পার্থক্যের মধ্যে রয়েছে বারবাতের ছোট শরীর, লম্বা ঘাড় এবং সামান্য উত্থিত আঙুলের বোর্ড।
---

*শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন