লোভ মানুষের জীবনের সঙ্গে বাঁধা। আমরা যেভাবেই বিশ্বকে কল্পনা করি, লোভের ভূমিকা সর্বগ্রাসী। মানবিক সদ্গুণ প্রতিষ্ঠা দেওয়ার অবিরত চেষ্টা কি তবে মাঠে মারা যাবে? শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত, সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি, ব্যবসা-চিকিৎসা-শিক্ষা, কূটনীতি-যুদ্ধ-শান্তি হেন কোনো শাস্ত্র বা চর্চা নেই, যা প্রয়োগ করতে গেলে লোভকে সামলে-সুমলে চলতে হয় না।
মানুষ নামক উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণিটির যতো বুদ্ধি, ঠিক ততোটাই নির্বুদ্ধিতা তার অস্তিত্বের গভীরে। এই নির্বুদ্ধিতা আসে অজ্ঞানতা-অযৌক্তিকতা থেকে, মানুষের মনস্তত্ত্বে লুকানো নেতিবাচক বোধ থেকে। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণি স্বনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খল মেনে চললেও, মানবিক শৃঙ্খলা একটা জটিল বিষয়। মানুষের জন্য তাই তৈরি হয়েছে বিচিত্র জ্ঞানশাস্ত্র, তা চর্চার জন্য বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় পাশেও তার জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। তাকে হাত বাড়াতে হয় জগৎ ও জীবনের দিকে। তার উপদেশের জন্য তৈরি হয়েছে ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র। জীবনকে মহিমান্বিত না করলে মানুষ কখনো মানুষ হয় না, প্রাণিই হয়ে থাকে। এটাই মানবজীবনের অনন্য নিয়তি। তাকে শুধু জ্ঞান অর্জন করলেই চলে না। সেই জ্ঞান ধরে রাখার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। তা প্রয়োগ করার জন্য পথে নামতে হয়। এমনকি তা মানবকল্যাণে নিবেদিত করতে শ্রম দিতে হয়, কখনো রীতিমতো সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এতো উন্নত মস্তিষ্কের জীব হওয়া সত্ত্বেও কেন এমনটা? যুগে যুগে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন জ্ঞানীগুণী মানুষেরা। এর মধ্যে লুকানো হয়তো জগৎ-রহস্য। ত্রুটি না থাকলে মানুষ সংশোধনে তৎপর হতো না। মহামতি শেক্সপিয়র বলেছেন, Life “is a tale / Told by an idiot, full of sound and fury, / Signifying nothing. আবার ভুল না থাকলেও জীবনের অর্থ পরিষ্কার হয় না। ভুলের শিক্ষা না নিলে জীবনযাপনের কোনো মানে দাঁড়ায় না। একটা অর্থপূর্ণ জীবন মানে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার জীবন। ভুল এড়িয়ে কেউ মহৎ হতে পারেনি। লোভকে জয় করার আগে কেউ পির-আউলিয়া-ঋষি-সন্ন্যাসীও হননি। মানুষের মনস্তত্ত্ব ধর্মেরও বড় প্রতিষ্ঠাভূমি। পৃথিবীতে মানবিক ভুলের গল্পগুলো তাই সেখানে নৈতিক গল্প হয়ে ওঠে। পুরাণ ও মহাকাব্যে মানবিক ত্রুটিগুলো অধিকতর স্পষ্ট। এর মধ্যে লোভ নামক নেতিবাচক গুণটি অধিকতর প্রসারিত। আধুনিক যুগপূর্ব সাহিত্যে এ অনুষঙ্গটি আখ্যানে-চরিত্রে, তাদের চলায়-বলায় নানারূপে অভিব্যক্ত। মানুষ নিজেকে খোলনলচে পাল্টে আগের পৃথিবী থেকে নতুন পৃথিবীতে আগমন করলো। তবুও লোভ তার পিছু ছাড়লো না। সঙ্গত কারণে আধুনিক ও আধুনিকোত্তর সাহিত্যে লোভ যেন বিচিত্র মাত্রা নিয়ে যুক্ত হলো। বাংলা সাহিত্যে কি ভিন্ন ভাষার আধুনিক সাহিত্যের দিকে নজর দিলে বিষয়টি আর আড়াল থাকে না। মানুষ ও মানবিক ত্রুটি যেখানে বিবেচ্য, লোভ-অনুষঙ্গ সেখানেই কার্যকর। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মানুষ জগতে অতৃপ্ত। মানুষের সতৃষ্ণ বাস্তবতা থেকে তৈরি হয়েছে জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ, জানার প্রতি অসীম কৌতূহল। কিন্তু ফাউস্টের মতো সেই আগ্রহ বিশুষ্ক জ্ঞানের তাবেদার হলে মানবিক বিশ্বটা ভেঙে পড়ে। ফাউস্ট ঘোষণা করেছে, "Alas, I have studied philosophy, / the law as well as medicine, / and to my sorrow, theology; / studied them well with ardent zeal, / yet here I am, a wretched fool, / no wiser than I was before."
“হায়! আমি দর্শন পড়েছি,
আইন ও চিকিৎসাশাস্ত্র,
এমনকি অন্তরের আবেগ নিয়েঅধ্যয়ন করেছি ধর্মতত্ত্ব,
দুঃখের সাথে বলছি তবুও
আজ আমি হতভাগ্য এক মূর্খ,
আগের চেয়ে নই এতটুকু প্রাজ্ঞ !”
মানুষের অতৃপ্তি-অসন্তুষ্টি বস্তুগত ও স্পিরিচুয়াল যে-কোনো দিকেই হতে পারে। আবার একইসঙ্গে উভয় দিকেই তা গমন করতে পারে। তা যেদিকেই যাক না কেন, কল্যাণ-বিরোধী না হওয়া সার্থক মানবজন্মের প্রথম শর্ত। লোভ মানুষকে মানবকল্যাণ থেকে দূরে সরে নিয়ে যায়। আত্মস্বার্থ অর্জনের সীমাহীন ইঁদুর দৌড়ে সবাইকে শামিল করায়। পরিণতিস্বরূপ পৃথিবীতে তৈরি হয় শতসহস্র ‘ক্যাওয়াস’, যা সৃষ্টি করে অনর্থ, যুদ্ধ-বিগ্রহ-হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি। ‘ক্যাওয়াস’ শব্দটি এসেছে ‘কাওয়াজ’ থেকে, যার অভিধানিক অর্থ শিক্ষাপ্রাপ্তি, ট্রেনিং, প্যারেড প্রভৃতি। শৃঙ্খলিত সেনাবাহিনির কুচকাওয়াজেও তৈরি হয় উচ্চমাত্রার শব্দ। এই শব্দের দূষণ মেনে না নিলে প্যারেড অসম্ভব। তাই লোভের ভয়ে জীবন থেকে সরে গেলে জীবনটাই হয়ে যাবে বরবাদ। মানুষ লোভ করবে, অন্যায় করবে, প্রায়শ্চিত্ত করবে, পুড়বে খাঁটি সোনা হতে—এটাই তার ভবিতব্য।
একেকটি বই মানে লেখকের নতুন করে জন্ম। প্রকাশকের কাছে অনুরোধ জানাতে অপারগ বলে বই করতে পারিনি বেশ কিছুদিন। সময় পেলে লেখা নিয়ে বসি, কিন্তু বই গোছানো হয় না। ‘কথাপ্রকাশ’ থেকে এবার ‘মনোবিশ্লেষণ সিরিজে’র একজন লেখক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জিত হলো। বলা বাহুল্য, এই কৃতজ্ঞতার অনেকখানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সিরাজ সালেকীন স্যারের প্রতি। তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য জনাব আবু হেনা মোস্তফা এনাম ভাই স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজটিতে নামিয়েছেন। এই দু জনকে আমি মনের গভীর থেকে ধন্যবাদ জানাই। লেখার সময় সহসা কোনো বই বা তথ্য প্রয়োজন হলে ঐকান্তিকভাবে সহযোগিতা করেছে আমার একমাত্র পুত্র কাব্য। ওর প্রতি শুভাশীষ, যেন সে বড় মানুষ হতে পারে। এছাড়াও যারা সবসময় লেখার জন্য আমার মধ্যে প্রণোদনা তৈরি করেন, তাদের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা। এ বই লিখতে গিয়ে মনে হয়েছে, স্বল্পতম সময়ে সম্পাদনের জন্য বিষয়টি বেশ কঠিন। কাজেই অসম্পূর্ণতা, ভুলত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। পাঠকের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি ও পরামর্শ পরবর্তী পদক্ষেপের সহায়ক হয়ে উঠবে। বইটির পুনর্মুদ্রণেও সহায়ক হয়ে উঠবে পাঠকের সুচিন্তিত অভিমতসমূহ।
খোরশেদ আলম
শিক্ষক, বাংলা বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন