কাজী নজরুল ইসলাম কবি। কবিতাই তাঁর শিল্পসিদ্ধির মূলে। তাও আবার বহুকর্ষিত কোনো সাহিত্যচর্চা নয়। যেন এক অপরিমিত আবেগঘনত্ব, সঙ্গে এক উচাটন মন। তা-ই তাঁর সাহিত্যের সৌন্দর্যকে বিকিরিত করছে। বহু পুরাতন ও ব্যবহৃত কথাটিই পুনরায় বলতে হয়-- আবেগের উচ্চতাই যেন তাঁকে স্বভাব কবিতে রূপান্তরিত করেছে। শুধু কবিত্ব নয়, কথাসাহিত্যের নজরুল একই বিভায় উচ্চকিত। অপরিমিত আবেগের ঘনত্ব তাঁর শৈল্পিকতাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে হয়তবা। কিন্তু নজরুলের সেই স্বভাব উন্মত্ততাই এক বিশেষ সম্পদ। যেন শৈল্পিক কারিগরিতে তা পুরোপুরি বাঁধা নয়; তবুও তিনি কথাশিল্পে যোগ করেন এক নতুন মাত্রা। তাঁর উপন্যাস, গল্প, নাটক এমনকি মননশীল রচনা প্রবন্ধেও সেই আবেগের ঘনীভূত ছায়া বিদ্যমান।
গল্পকার নজরুল একালে কতটা পঠিত হবেন সে-পরিসংখ্যান না হয় উহ্যই থাকল। কালের অপ্রতিরোধ্য গতি তাঁকে গল্প ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিমজ্জিত করুক সেটাও কারো কাম্য নয়। তা হলেও নজরুলের শৈল্পিক স্বভাবের অপূর্ব প্রাণতা পাঠককে বাধ্য করবে আরেকবার সাহিত্যসিন্ধুতে মুক্ত সেঁচতে। একটি বিষয় লক্ষ করা যাবে-- আর তা হচ্ছে, বিদ্রোহী কবিতার আমিত্ববোধ তাঁকে ছাড়িয়ে যায়নি তাঁর গল্পেও। নজরুল তাঁর স্বভাবি উচ্ছৃঙ্খলতা দিয়ে সাহিত্য শরীরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছেন। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ব্যথার দান (১৯২২); কবিতা-বিঘোষিত বেদনা সঞ্চারিত হয় এই নামকরণের মধ্যেও। ব্যক্তিসত্তার অন্তর্লীন গভীর যন্ত্রণা যা কীনা কবিতার শক্তি হবার পারঙ্গমতায় ভরপুর, তারই আলোকবিন্দু সমাপতিত হয় প্রেমিক কবির গদ্যবাসনায়।
গল্পে কাজী নজরুল নতুন কোনো ফর্মের সূচনা করেননি। সেটা হয়ত তাঁর কাম্যও ছিল না। তিনি কথাকার হয়ে জন্মাননি। যে-উন্মূল বাসনা একজন কবিকে গদ্য লিখতে অনুরুদ্ধ করে, গল্প তারই অভিপ্রায়। কথাকার নজরুলের আবির্ভাব সাহিত্যের একটি বিশেষ উর্বর সময়ে। রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে বাংলা ছোটগল্প ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠার সিঁড়ি বেয়ে উর্ধ্বমুখি আকাশে ধাবমান। বুদ্ধির ক্ষিপ্রতা নিয়ে আবির্ভুত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩৮), প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) কিংবা সমাজ সচেতন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ইতোমধ্যে কথাশিল্প নামক সৌধের একেকটি স্তম্ভরূপে প্রতিষ্ঠিত। সে-সঙ্গে ‘ভারতী’ পত্রিকার লেখক গোষ্ঠী তো শিল্পের নানা অলিগলি সন্ধান করে ফিরছেন। সমকালীন কথাশিল্প যাঁদের সরসতায় গৌরবান্বিত সে-ই তারাশঙ্কর, বিভূতি, মানিক এঁরাও আছেন। এ-পরিবেশেই ধূমকেতুর মতো উল্কা-বিস্ফোরণের মতো এক কথাকারকে পাওয়া গেল, যিনি আপন কবিত্বের ঘনঘোর বরষায় সিক্ত করছেন কথাশিল্পের আঙিনা; তিনি আর কেউ নন, সকরুণ বিদ্রোহের মূর্তিমান প্রতীক কাজী নজরুল ইসলাম।
কখনো উত্তম পুরুষের বয়ানে নিরন্তর আবেগী বৃষ্টিপাত, কখনো সমাজসচেতন ও সমাজবিদ্বিষ্ট মনোভাব, কখনো আঞ্চলিক শব্দ ও আবহের গূঢ় বাস্তবায়ন আবার কখনো অধরা প্রেমের বিরহকাতর অসহ্যতার সুক্তি দিয়ে আঁকা হয়ে আছে নজরুলের গল্পভূবন। ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’, ‘রাক্ষুসী’, ‘সালেক’, রাজবন্দীর চিঠি’, ‘ব্যথার দান’, ‘হেনা’, মেহের নিগার’, ‘অতৃপ্ত প্রেম’, ‘বাদল বরিষণে’, ‘ঘুমের ঘোরে’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘স্বামীহারা’, ‘পদ্মগোখরো’, ‘শিউলিমালা’, ‘বনের পাপিয়া’ প্রতিটি গল্পেই কাজী নজরুলের উক্ত বিষয়সমূহের সন্ধান মেলে। বিষয়গত কারণেই এ-নিবন্ধটিতে নজরুলের সামাজিক ও আঞ্চলিক কাহিনিবেষ্টিত গল্পগুলো আলোচিত হয়নি। তবে নজরুলের আবেগসঞ্চিত ধারার লেখনি থেকে এ-নিবন্ধে বেশ কটি গল্প আলোচনার প্রয়াস রাখছি। নজরুলের কবিত্ব ও অন্তর্গত প্রেমাবেগের উৎকৃষ্টতাও আশাকরি এর মধ্য দিয়ে অনেকটা স্পষ্ট হবে। তাঁর ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’, রাজবন্দীর চিঠি’, ‘ব্যথার দান’, ‘হেনা’ ও ‘শিউলিমালা’--এ-কটি গল্পেই ভালোবাসার এক মহত্তম ও অনির্বচনীয় রূপ প্রস্ফুটিত।
‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ ছন্নছাড়া ও ব্যর্থপ্রেমী যুবকের আত্মকাহিনি। কাজী নজরুলের স্বীয় জীবনেরই অনেকখানি ছায়া বোধহয় এ-গল্পে পড়েছে। দুরন্ত দুষ্ট কৈশোর কিংবা বোহেমীয় অস্থির মন যা চিরকালই বাধার শাসন উপেক্ষা করে, এমনই এক নায়ক এ-গল্পের। দুরন্ত মনকে বাঁধবার আশায় জননী তাকে বেধে দেন কিশোরী বধূর আঁচলে। খেলাচ্ছলেই তাকে প্রচণ্ড ভালবেসে ফেলে সে। কিন্তু একটু সুস্থির হবার বাসনা তার ভণ্ডুল হয় কিশোরী বউ রাবেয়ার অকালপ্রয়াণে। তাকে সে কোনমতেই ভুলতে পারে না। একসময় মা জোর করে দ্বিতীয় বিয়ের পিড়িতে ওঠায়। কিন্তু দ্বিতীয়া সখিনা তার মানসপ্রিয়া হয় না। প্রথম স্ত্রীর প্রতি দগদগে ভালবাসা আর প্রচণ্ড ক্ষত বুকে নিয়ে আজ সে বাউণ্ডুলে নেশাখোর। সে-যুবকের সঙ্গে বাঙালি পল্টনে দেখা হয় লেখকের।
বোহেমীয় বা ‘বাওয়াটে’ যুবকের নেশাতুর চোখে কীসের যেন তীব্র অতৃপ্তি দেখেন নজরুল। তৃষ্ণার্ত এক মানুষিসত্তার আবিষ্কার এ-গল্পটিকে অনন্য করে তোলে। তার দুরন্ত জীবন বর্ণনাও পাঠককে আবিষ্ট করে। সব শেষে এক বিরহকাতর পরিসমাপ্তি লেগে থাকে পাঠকের চোখেমুখে। এ-গল্পে আছে জীবন নিয়ে প্রচণ্ড এক কাঁচা আবেগ। কিন্তু তরলায়িত আবেগাক্রান্ত অনুভব হলেও তা-ই তো সত্যিকার প্রেম। কবিত্বের ছটা সমৃদ্ধ তাঁর আবেগের গল্পভাষা দ্রুত সঞ্চরণশীল। বাউণ্ডুলে সংলাপে তার পরিচয় :
..খোদা আমায় পয়দা করবার সময় মস্ত একটা গলদ করে বসেছিলেন, কেননা আমার চামড়াটা করে দিলেন হাতির চেয়েও পুরু, আর প্রাণটা করে দিলেন কাদার চেয়েও নরম! (পৃ.১৫)
জগতে এমন মানুষই অকাতর মানবিক সেবায় আপনাকে বিলাতে পারে। পাঠশালার গণ্ডি পেরুনোই ছিল গল্পের নায়কের কাছে চরম নিদান। প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিপতিত বর্ধমান শহরের মানুষকে রক্ষা করে এ-শ্রেণিরই ‘বাওয়াটে’ ছেলের দল। পুঁথিকীট পড়ুয়ার দল সেখানে ব্যর্থ। কিন্তু বাউণ্ডুলের সকরুণ জীবনেরই বা প্রাপ্তি কী? তার মধ্যে সমুদ্র কল্লোলিত প্রেমাবেগ যা প্রকাশের ভাষায়--
‘সে যে করুণা জাগায় সকরুণ নয়ানে,/কেন, কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে।’(পৃ.২০)
নজরুল জানেন সে-প্রেম শুধু অধরা। বিরহবিধুরতাই এর শেষ পরিণতি। সহ্যের মাত্রাও একবারে সসীম। তাই বাঙালি পল্টনের নেশাতুর যুবকের পরিণতি আজ বাউণ্ডুলে এক মদ্যপ জীবন।
‘রাজবন্দির চিঠি’ গল্পটিরও প্রধান উপজীব্য পুরুষের তৃষাতুর প্রেম। যাকে নিকটে মনে হয় নেহাৎ ছলনা, দূরে তার কথাই স্মরিত হয় বিস্ফারিত আবেগে। মানবজীবনের এই দ্বিধা-বৈপরীত্য একটি দার্শনিক বোধের জন্ম দেয়। তা ধরা পড়ে প্রেসিডেন্সি জেলে আটক রাজবন্দির অন্তরাভিব্যক্তিতে :
তোমার ঐ ছোঁয়াটুকুর আনন্দেই আমি আমার সকল জ্বালা সকল ব্যথা-বেদনা মান-অপমানের কথা ভুলে গেলুম। মনে হল, তুমি আমার-তুমি আমার-একা আমার! হায় রে শাশ্বত ভিখিরি! চিরতৃষাতুর দীন অন্তর আমার। কত অল্প নিয়েই না তুই তোর বুকের পূর্ণতা দিয়ে তাকে ভরিয়ে তুলতে চাস, তবু তোর আপনজনকে আর পেলিনে। (পৃ.৩৭)
প্রেমবুভুক্ষু তথা তৃষ্ণাকাতর এক মানবাত্মার আকুতি এখানে। বিচ্ছেদে অন্তরের প্রেম গরলের ভাষায় রূপান্তরিত এ-গল্পে। জেলখানার সেলে বন্দি মানুষ নির্জনতায় আপনাকে চিনতে পায়। খুব সাংঘাতিক হলেও সত্যসমূহ বেরিয়ে আসে। কেননা সে তখন সমাজ-মানুষ নয়। সমাজের প্রচলিত ভালবাসার আখ্যান তাই প্রত্যাখ্যাত তার কাছে। সত্যকার প্রেমে থাকে ঈর্ষার অগ্নিবাণ। প্রেমাস্পদের অবহেলা তাই প্রচণ্ড দাবদাহন হয়ে বাজে প্রেমিক হৃদয়ে। যেন সত্যিকার প্রেম পেলে জীবন ধন্য হোত তার।
দেখেছ কী ভিখিরি মন আমার! তুমি না জানি আমায় কতই ছোট মনে করেছ! আহা একবার যদি মিথ্যে করে হলেও বলতে লক্ষ্মী যে, আমার ব্যথার কারণ অন্তত তুমি মনে মনে জেনেছ, তাহলে আমি আজ অমন করে হয়ত ফুটতে-না-ফুটতেই ঝরে পড়তুম না! আমার জীবন এমন ছন্নছাড়া ‘দেবদাস’-এর জীবন হয়ে পড়ত না! (পৃ.৩৭)
বহুবারই প্রেম এসেছে রাজবন্দির জীবনে। কিন্তু কোনটাই যেন প্রেয়সীর দিক থেকে পূর্ণতার বার্তাবাহক হয়ে আসেনি। সাধারণের মত সহজ ভালবাসায় তার মন তুষ্ট নয়। অধরা অসুর্যম্পশ্যা এক প্রেমের প্রতিই তার আকর্ষণ। প্লেটোনিক এ-প্রেম, জাগতিকতার লেশমাত্র যেখানে নেই। তবুও তাকে পাবার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় সে উদ্বেল। সামান্য অপ্রাপ্তির তীক্ষ্ণ বাণ তাকে বিদ্ধ করে; যেন এক শায়ক বেধা পাখি। অনাদরের এ-অনুভব সঞ্চারিত হয় গল্প-শরীরে। কাব্যিক ভাষায় তাকে প্রকাশ করেন নজরুল :
শুধু অনাদর শুধু অবহেলা শুধু অপমান!
ভালোবাসা?- সে শুধু কথার কথা রে।
অপমান কেনা শুধু! প্রাণ দিলে পায়ে দলে যাবে তোর প্রাণ!
শুধু অনাদর, শুধু অবহেলা, শুধু অপমান! (পৃ. ৩৯)
‘ব্যথার দান’ দারা ও বেদৌরার প্রেম ও অতৃপ্তির গল্প। গোলেস্তান ও বোস্তান থেকে দু জন দু জনের মনের অবস্থা পরস্পরকে জানান দিচ্ছে। দূর-প্রবাসী সৈনিক তথা প্রেমিক হৃদয়ের করুণ বেদনার আর্তি এ-গল্পে স্পষ্ট। নজরুল দেখিয়েছেন প্রেমিকের সঙ্কট, যাতনা, অতৃপ্তির হাহাকার। ভালবাসার অনুভব দূর প্রবাসে সুতীব্র রূপ ধারণ করে। প্রেমের ভুল প্রেমাস্পদের জন্য হাহাকার হয়ে ওঠে। বেদৌরার কাছ থেকে পাওয়া আঘাত দারার বুকে শেলসম বেধা। তবুও যেন তাকে ভুলে থাকা অবাঞ্ছনীয়। বেদৌরার জীবনে সয়ফুল মুলকের মতো প্রেমের নবোদ্ভিন্নতা। তবু তার মুক্তি নেই। পূর্বতন প্রেমাস্পদের প্রতি যাচ্ঞা তার, যা এক গভীর বেদনায় মুহ্যমান। সাধক শ্রেষ্ঠ প্রেমিক রুমীর গজলে নিহিত সে-বেদনা তিনি গল্পে বিধৃত করেন :
ওগো প্রিয়তম! তুমি যত বেদনার শিলা দিয়ে
আমার বুকে আঘাত করেছ, আমি তাই দিয়ে যে
প্রেমের মহান মসজিদ তৈরি করেছি! (পৃ. ৬০)
নজরুল আরো বলেন, ‘শিশুদের চেয়ে সরল কিছু নেই দুনিয়ায়। দারাও প্রেমের মহিমায় যেন অমনি সরল শিশু হয়ে পড়েছে।’ প্রেমিক দারার এর চেয়ে ভাল পরিচয় দেয়া অসম্ভব। নজরুলের কাছে প্রেম মানেই মহান কিছু, শরীর থেকে অশরীরী, ধরা থেকে অধরা, নিরুদ্দিষ্ট, অনির্বচনীয় আবেগ। কল্পনায় তা দু পারের জীবনকে একসূত্রে বাধতে চায়; যদিও বাঁধবার সূত্রটি হারিয়ে গেছে। প্রেম হয়ে পড়ে তার কাছে নিতান্তই অধরা। তীব্র কল্পনার কবিত্বে তা হয়ে ওঠে একান্তই প্লেটোনিক। এ-অনুভব ঠিক তাঁর গানের আবহ স্মরণ করায়। নজরুলের বিখ্যাত কটি গানের লাইন, ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই/ কেন মনে রাখো তারে/ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও/ মোরে ভুলে যাও একেবারে।’ অন্যদিকে ‘ব্যথার দান’ প্রেম-প্রাপ্তির কল্পলতায় ভাস্বর হলেও ঐ গানের মর্মস্পর্শী বেদনা থেকে যেন আলাদা নয় এ-গল্পে প্রার্থিত প্রেমিকার সঙ্গ।
দেখ বেদৌরা, আজ আমাদের শেষ বাসরশয্যা হবে। তারপর রবির উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তুমি চলে যাবে নির্ঝরটার ওপারে, আর আমি থাকব এপারে। এই দুপারে থেকে আমাদের দুইজনকে ব্যথিয়ে তুলবে। আর ঐ ব্যথার আনন্দেই আমরা দুজন দুজনকে আরও বড়-আরও বড় করে পাব! (পৃ. ৬২)
বেদৌরার প্রেমবোধ আরো জটিল। সে ভুল করা মানবী। যন্ত্রণাক্লিষ্ট নারীর না-পাবার আকুতি আরো ভয়াবহ। যেন খাঁচায় বন্দি বনের পাখি সে।
ফিরতেই হবে প্রিয়তম, ফিরতেই যে হবে তোমার! এ সংশয় দুদিনেই কেটে যাবে। তখন দেখবে, আমাদের সেই ভালোবাসা কেমন ধৌত শুভ্রবেশে আরও গাঢ় পূত হয়ে দেখা দিয়েছে! আমি তোমারই প্রতীক্ষায় গোলেস্তানের এই ক্ষীণ ঝরনাটার ধারে বসে গান আর মালা গাঁথব। আর তা যে তোমায় পরতেই হবে। ব্যথার পূজা ব্যর্থ হবার নয় প্রিয়।... (পৃ. ৫৭)
জানি এ-আশা শুধু অকুল সমুদ্রে কুল পাবার আশায় নিরন্তর তরী চালনা। তবু বেদৌরা-মানস দুরাশার পারাবার অতিক্রমের বাসনায় বিসর্জিত।
এ-গল্পের একটি বড় বিষয় হল সৈনিকের চোখ দিয়ে দেখা ভিন্নতর এক বিশ্ব। নিয়ত জীবন-মৃত্যুর সন্নিধানে প্রবাস জীবনের একদিকে থাকে প্রেম অন্যদিকে থাকে দেশমাতৃকার প্রতি প্রচণ্ড ভালবাসা। মা ও জন্মভূমি সে-আবেগে একাকার। ব্যক্তিজীবনের ছায়াপাত হয় এ-ভাষায়-- ‘...মাকে হারিয়েছি বলেই-মাতৃত্বের এ মস্ত শিকলটা আপনা হতে ছিঁড়ে গিয়েছে বলেই আজ মার চেয়েও মহীয়সী আমার জন্মভূমিকে চিনতে পেরেছি।’ এখানে প্রবাসী প্রকৃতিও যেন এক প্রেমিক এবং তার সৌন্দর্য-অন্বেষী অন্তর্চক্ষু দিয়ে যা চিহ্নিত হয় গল্পে তার বর্ণনা :
আঙুরের ডাঁশা থোকাগুলো রসে আর লাবণ্যে ঢলঢল করছে পরীস্তানের নিটোল-স্বাস্থ্য ষোড়শী বাদশাজাদীদের মতো! নাশপাতিগুলো রাঙিয়ে উঠেছে সুন্দরীদের শরমরঞ্জিত হিঙুল গালের মতো! রস-প্রাচুর্যের প্রভাবে ডালিমের দানাগুলো ফেটে ফেটে বেরিয়েছে কিশোরীদের অভিমানে-স্ফূরিত টুকটুকে অরুণ অধরের মতো। পেস্তার পুষ্পিত ক্ষেতে বুলবুলের নওরোজের মেলা বসেছে। আড়ালে আগডালে বসে কোয়েল আর দোয়েল-বধূর গলা-সাধার ধুম পড়ে গিয়েছে, কী করে তারা ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে তাদের তরুণ স্বামীদের মশগুল করে রাখবে।... উদ্দাম দখিন হাওয়ার সাথে ভেসে-আসা একরাশ খোশবুর মাদকতায় আর নেশায় আমার বুকে তুমি ঢলে পড়েছিলে। শিরাজ-বুলবুল-এর ‘দিওয়ান’ পাশে থুয়ে আমি তোমার অবাধ্য দুষ্টু এলো চুলগুলি সংযত করে দিচ্ছিলাম, আর আমাদের দুজনারই চোখ ছেপে অশ্রু বয়েই চলছিল। (পৃ.৫১)
কবি নজরুলের প্রবাসী সৈনিক জীবনে একপাক্ষিক প্রেমের প্রকাশ ‘হেনা’ গল্প। ফ্রান্সের ভার্দুন ট্রেঞ্চ, সীন নদী তীরের তাবু, প্যারিসের পাশের অরণ্যানী, জার্মানীর হিন্ডেনবার্গ লাইন, কাবুলের ডাক্কা ক্যাম্প, পাকিস্তানের পেশোয়ার প্রভৃতি স্থান থেকে অবসরে তিনি আত্মকথার আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন এগুলো। সেখানে বাহ্যত যুদ্ধের বর্ণনা, গুলি ও বোমার শব্দ। কিন্তু এ-গল্পের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিদেশিনী কিশোরীর প্রতি নজরুলের প্রেমের এক অন্তর্লীন প্রবাহ। নজরুলের কাছে তো প্রেম মানেই সুদূর রহস্য। সীন নদীর তাবুর ধারে বসে তিনি লেখেন, ‘মেয়েটা আমাকে খুব ভালোবেসেছে। আমিও বেসেছি।’ খানিক দূরত্বেই প্যারিসের ঘন অরণ্যে তার বিরহে কাতর তিনি। তিনি বিদেশী নারীর স্বদেশী নাম দেন হেনা। তার জন্য তাঁর প্রেমানুভূতির তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা :
এই আলোছায়ায় আমার কত কথাই না মনে পড়ছে! ও, তার চিন্তাটা কী ব্যথায় ভরা! আমার মনে পড়ছে আমি বললুম-- ‘হেনা, তোমায় বড্ড ভালোবাসি।’
সে, --হেনা তার কস্তুরীর মতো কালো পশমিনা অলকগোছা দুলিয়ে দুলিয়ে বললে-- ‘সোহরাব, আমি-যে এখনও তোমায় ভালোবাসতে পারিনি।’ (পৃ. ৬৯)
ভাল না বেসে কিংবা কোনো নারীর ভালবাসাহীন সেবা গ্রহণ করতে নায়কের মনে সায় নেই। তাই নার্সদের সেবা তাঁর ভাল লাগেনি। আবার কিঞ্চিৎ ভালবাসাই তার আবেগকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। ফরাসি তরুণীর সঙ্গে সম্পর্কসূত্রে তিনি তার বাড়িতে বেড়াতে যান। দেশের সঙ্গে বিদেশের মেয়েদের আচরণ ও সংস্কৃতির পার্থক্যও তুলে ধরেন। তারপর তিনি আফগান নারীর প্রেমাস্পর্শ পান। কিন্তু নানা দেশে যুদ্ধ শেষে কেবল অতৃপ্ত প্রেমাকাঙ্ক্ষা নিয়ে ফেরেন।
অব্যক্ত কান্নার ভাষায় অশ্রুতপূর্ব চোখে ধরা পড়েছিল হেনার হৃদয়ের ভাষা। অপ্রকাশিত আবেগের তৃষ্ণাটুকু নিয়েই তাকে বলতে হয়, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে মস্ত হেঁয়ালি হচ্ছে মেয়েদের মন!’ (পৃ.৭২) তিনি একসময় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু ছায়ার মতো রয়ে যায় হেনা। বস্তুতই হেনা ‘পাহাড়-ফাটা উদ্দাম জলস্রোতের মতো’ এক সুগভীর প্রেম হৃদয়ে আটকে রেখেছিল! নিশ্চিন্ত নিরপরাধ এক ঘুমের ভেতর দিয়ে যার পরিসমাপ্তি। সেই অসম্পূর্ণ সমাপ্তিকে তাকে তিনি ভোলেন কী করে? অতৃপ্তিই তাঁর সঙ্গী; তাই সদ্যপ্রাপ্ত প্রেমও লুটিয়ে যায় করুণ রসে :
আর হেনা! হেনা!-ঐ-যে সে আমায় আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে।... এখনও তার বুক কীসের ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে! এখনও বাতাস ছাপিয়ে তার নিশ্বাসে উঠছে একটা মস্ত অতৃপ্তির বেদনা!
আহা, আমার মতো অভাগাও বড্ডবেশি জখম হয়েছে। ঘুমিয়েছে, ঘুমুক!-না, না, দুজনেই ঘুমোব। এতবড় তৃপ্তির ঘুম থেকে জাগিয়ে আর বেদনা দিওনা খোদা।
হেনা! হেনা!-না-না-আহ্! (পৃ. ৭৪)
‘শিউলিমালা’ও প্রেমের গল্প। কালে যে-প্রেম মহীয়ান হয়ে ওঠে তার রূপ এতে অঙ্কিত। তাই অতৃপ্তির তৃষ্ণাকেই তিনি এঁকে দেন জয় তিলক। মরবে জেনেও পতঙ্গ ঝাঁপিয়ে পড়ে আলোকের প্রত্যাশায়। এ-গল্পের নায়কও প্রেম রূপ অনলে আপনাকে সমর্পণ করে। সে অনলে পুড়ে খাঁটি হয় অপ্রাপ্ত কিন্তু মহৎ এক জীবন।
কলকাতার তরুণ ব্যারিস্টার আজহার। দাবাখেলায় পারদর্শী সে। দেশ-বিদেশের বহু নামকরা খেলোয়ারের সঙ্গে সে দাবা খেলেছে। জেতার রেকর্ড তার সবসময়ই। শিলং-এ বেড়াতে এসে প্রফেসর চৌধুরী বাড়িতে সে বন্ধুবান্ধবসহ একদিন আতিথ্য গ্রহণ করে। দাবাখেলার পর বসে গানের আসর। প্রফেসর কন্যা শিউলির ঠুংরি টপ্পা মেশানো স্বতঃস্ফূর্ত গানের সুরে ও গলার কাজে বিমুগ্ধ হয় আজহার। শিউলির গান শুনে মন্ত্রমুগ্ধ আজহারের অভিব্যক্তি :
এ সেই কণ্ঠ! মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু বলবার ইচ্ছা ছিল না। ভদ্রতার খাতিরে একবার মাত্র বলতে গেলাম, ‘অপূর্ব!’ গলার স্বর বেরুল না। শিউলির চোখে পড়ল-- আমার চোখে জল। সে তার দীর্ঘায়িত চোখের পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে যেন সেই জলের অর্থ খুঁজতে লাগল। (পৃ. ৯৫)
প্রফেসর চৌধুরীর অনুরোধে সপ্তাহখানেক পর হোটেল ছেড়ে তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয় আজহার। তার নিরবচ্ছিন্ন সঙ্গী হয়ে ওঠে প্রফেসর চৌধুরীর মেয়ে শিউলি। রোজ দাবা খেলা, আড্ডা ও সঙ্গীতে মুখরিত হয় বাড়ির অন্দরমহল। এ-পরিবারের সঙ্গে বেশকিছুদিন স্বপ্নের মতো কেটে যায় তার। শিউলির চোখে চোখে রেখে এক দারুণ মোহজালে আবিষ্ট হয়ে থাকে আজহার। কিন্তু পরস্পরের মন জানাজানি হলেও কোন এক অনির্দেশ্য মনস্তত্ত্বে তাকে একান্তে পাবার অবকাশ হয়নি তার। কিন্তু স্বপ্নের মতো দিনগুলো ফুরিয়ে গেছে নিজের অজান্তেই। আজহার টের পায়-- তার মনে অলক্ষ্যেই বাসা বেঁধেছে শিউলি। এটা আরো স্পষ্ট হয় শিলং ছাড়ার প্রাক্কালে। মেশামিশিতে নিষেধের বালাই ছিল না বলেই পরস্পরের হস্তস্পর্শটুকুও লাগেনি। সেখানে এই তীব্র মুক্তিই হয়ত ছিল তাদের পরস্পরের মিলবার পক্ষে দুর্লঙ্ঘ ও অনির্দেশ্য বাধা।
আজহারের যাবার বেলায় একগুচ্ছ শিউলিফুল নিয়ে হাজির প্রফেসর কন্যা শিউলি। কিন্তু অসহায় চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া আজহারের আর কিছুই যে করার নেই! যাবার সময় একবার দাবাখেলার আসর হল প্রফেসর চৌধুরীর ইচ্ছায়। দাপুটে খেলোয়ার আজহার শিউলির সঙ্গে হেরে গেল আজ। জীবনে প্রথম ও শেষবারের মত দাবার এই হার তার জন্য। হয়তো জীবনের সঙ্গেই হেরে যাওয়া তা। অপূর্ণতার বার্তা এই হারবার সঙ্কেতে। শিউলির সঙ্গে আজহারের আর দেখা হয়নি কোনোদিন। কিন্তু তখন থেকে প্রতি শরৎ-সন্ধ্যায় একখানি শিউলিফুলের মালা জলে বিসর্জন দেয় সে। গল্পাংশটুকু উদ্ধৃত করা যায় :
আর তার সাথে দেখা হয়নি-হবেও না! একটু হাত বাড়ালেই হয়তো তাকে ছুঁতে পারি, এত কাছে থাকে সে। তবু ছুঁতে সাহস হয় না। শিউলিফুল- বড় মৃদু, বড় ভীরু, গলায় পড়লে দুদ-ে আউড়ে যায়! তাই শিউলি ফুলের আশ্বিন যখন আসে-- তখন নীরবে মালা গাঁথি আর জলে ভাসিয়ে দিই! (পৃ. ৯৯)
নজরুলের নায়ক-নায়িকার প্রেম এমনই ছন্নছাড়া এক অনুভূতিতে ভাস্বর। চূড়ান্তভাবে কাছে পাবার স্বাদ নেই সেখানে। অপূর্ণতার এই তৃষ্ণাই তো মহৎপ্রেমের নজির। বস্তুত, ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’, রাজবন্দীর চিঠি’, ‘ব্যথার দান’, ‘হেনা’ ও ‘শিউলিমালা’--এই সবকটি গল্পেই নজরুলের অপূর্ণ অথচ শক্তির অপূর্ব বিভায় দেদীপ্যমান প্রেমাবেগের পরিচয় উদ্ভাসিত। নজরুল স্বভাব কবি ও স্বভাব প্রেমী। অন্যদিকে বিদ্রোহ চেতনাই কাজী নজরুলের লেখকসত্তার অন্যতম প্রধান সুর। কবিতা কিংবা কথাসাহিত্যে সে-বিদ্রোহকে কখনো ছাপিয়ে উঠেছে নির্বাধ আবেগের উচ্চণ্ডতা। এই আবেগ কখনো কখনো তারল্যে ভরপুর। তা হলেও কোনো এক মরমীয়লোকে যখন তা পৌঁছে যায় তখন সেই তরল কাঁচা আবেগই ঘনীভূত হয় বরফকঠিন শীতলতায়। যেন তা অসীম আকাশে উড়ে চলা পেজা মেঘের তুলো, যা ঘন হলেই প্রচণ্ড ঝাপটা দিয়ে ভিজেয়ে দেবে সাদা-কালো-রঙিন পোষাক। আমরা ক্রমশই স্নাত হই সে-অনুভূতিরূপ মেঘের রাজ্যে। বারিপাত হয়ে মিলন যার নিশ্চিত মহাসমুদ্রে। সে-অনুভব সমুদ্রগভীর জলরাশির মতোই অফুরান।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে আমরা ভাবি নজরুল প্রতিভার উৎসমুখ। সেখানে একই সঙ্গে তিনি রুদ্র ও প্রেমের প্রতীক। বিদ্রোহ যাঁর সমাজচৈতন্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনিই যেন রচনা করেন এক মহান বৈপরীত্য। তিনি তো নিজেই বলেন-- ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণসূর্য।’ এই উভয়-স্বভাবী নজরুলের প্রথম সত্তাটির প্রতিই এ-প্রবন্ধের নিবেদন। কৃষ্ণের বাঁশরী যাঁর এক হাতে, সেই নজরুলের আবেগ ফেলে দেয়া আবেগ নয় মোটেই। কেননা সেখানেই তাঁর মনন, প্রতিভা ও উদাত্ত এক কবি-হৃদয়ের খবরাখবর সঞ্চিত। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের শরীরী প্রেম দিয়ে তাকে যাচাই করা যায় না। তিনি যেন বৈষ্ণবীয় ধাঁচের এক নিরালোক সত্তা-- অলক্ষ্য আর বিরহই যার অন্যতম সুর। সেখানেই তার রস আস্বাদনের পরিপূর্ণতা। পশ্চিমের এক কবির ভাষায়-- ‘আওয়ার সুইটেস্ট সংস আর দোজ দ্যাট টেল দ্য স্যাডেস্ট থট।’ অর্থাৎ ‘আমাদের মধুর গান সেগুলিই যেগুলো আমাদের বেদনার কথা বলে।’ কাজী নজরুলের গল্পের চেতনানিহিত এই বিরহী প্রেমের যন্ত্রণা আমাদের অন্যতম সম্পদ। তাঁর গল্পের কাঠামোগত ত্রুটি হয়তোবা কোথাও কোথাও চোখে পড়বে পাঠকের। কিন্তু বিষয় যখন আবেগবহুল তখন শিল্পের বিষয়ী তথা রূপের শাসন দিয়ে তাকে আর কতটা বাধা যায়! তিনি তো স্বভাব-কবির প্রতিভায় বেঁধেছেন তাঁর গল্পের রশি। সে-রশিটি বাস্তবের মাটি স্পর্শ করে না সবসময়। কিন্তু অনির্বচনীয় ও অতীন্দ্রিয় এক স্বপ্নাচ্ছন্ন ভাবলোকে নিয়ে যাবার ক্ষমতা আছে তাঁর। নজরুলের আবেগবহুল গল্পসমূহ প্রেমবোধে শিখরস্পর্শী, যা আমাদের চৈতন্যলোককে নাড়া দিয়ে যায়। বঞ্চনা ও অপ্রেমের হলাহল পূর্ণ এ-বিশ্বেও নজরুলের প্রেম ও প্রেমের আবেগ তাই চির-অটূট।
বাংলা বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন