অ্যাডোনিস আধুনিক কাব্যজগতে পরিচিত একটি নাম। তাঁর জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৩০ সালে সিরিয়ার উত্তরে লাতিকিয়ার অন্তর্গত আল-কাসাবিন গ্রামে। অ্যাডোনিসের পুরো নাম আলী আহমেদ সাই’দ আসবার। তবে সিরিয়ার এ সাহিত্যিককে গোটা বিশ্ব সংক্ষিপ্ত অ্যাডোনিস নামেই চেনে। গত কয়েক বছরে বারবার নোবেল পুরস্কারের তালিকায় তার নাম ওঠে।
২০১২ সালে প্রায় পেয়েও নোবেল পাওয়া হয়নি এ সাহিত্যিকের। তবে তিনি ওই বছরই গ্যাটে পুরস্কারে ভূষিত হন। লেবানন ও ফ্রান্স সাহিত্যিক হিসেবে তার বেড়ে ওঠার জায়গা হলেও সাহিত্য রচনায় বিশ্বাÍবোধের এক প্রতিফলন তাকে জার্মানির অমূল্য গ্যাটে পুরস্কার এনে দেয়। তারও আগে সিরিয়া-লেবাননে সবচে বড় কবি-পুরস্কার ‘নাজিম হিকমত কবিতা পুরস্কার’ প্রথমবারের মতো তিনিই অর্জন করেন। ১৯৮৩ সালে ‘স্তেফান মালার্মে একাডেমি’তে সম্মানিত সদস্য হিসেবেও তিনি নির্বাচিত হন। ১৯৬১ সালে অ্যাডোনিস লেবাননের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। লেবাননের দামাস্কাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পরে প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে তিনি কাজ করেন। বর্তমানে তিনি প্যারিসেই অবস্থান করছেন। গত সালে নোবেল পাওয়া সুইডিশ সাহিত্যিক টমাস ট্রান্সটমারকে আরব বিশ্বে তিনিই পরিচয় করিয়ে দেন। যাই হোক, অধুনা আরব বিশ্ব তথা গোটা দুনিয়ার শক্তিশালী আধুনিক কবিদের তিনি একজন। দ্য ফার্স্ট পয়েমস (১৯৫৭), লিভস ইন দ্য উইন্ড (১৯৫৮), মিহইয়ার ডামাসসিন (১৯৬১), দ্য ব্লাড অব অ্যাডোনিস (১৯৭১), দ্য বুক অব দ্য ফাইভ পয়েমস (১৯৮০), ট্রান্সফরমেশন অব দ্য লাভার (১৯৮২), দ্য পেজেস অব ডে অ্যান্ড নাইট (২০০১), ইফ অনলি দ্য সি কুড স্লিপ (২০০৩), আ টাইম বিটউইন অ্যাশেশ অ্যান্ড রোজেস (২০০৪), মিহইয়ার অব দামাসকাস (২০০৮) প্রভৃতি কাব্য তার হাতে রচিত। এ ছাড়াও প্রাবন্ধিক, সাহিত্য-সংকলক, সাহিত্য-সমালোচক, তাত্ত্বিক ও অনুবাদক (ফ্রেন্স থেকে আরবি) হিসেবেও তার খ্যাতি আছে। কমপক্ষে বিশটিরও অধিক বই তিনি আরবি ভাষায় রচনা করেছেন।অ্যাডোনিসের কবিতাকে বলা যায় মহাকাব্যিক। সমগ্র বিশ্ব, বৃহত্তর মানবজাতি, সৌন্দর্যের অনুভূতি, ঘটনাপ্রবাহ, বস্তু ও প্রাকৃতিক নানা বিস্ময় তার কাব্যের অনুষঙ্গ হয়ে আসে। ফলে এগুলো তার কাব্যবোধের মহারণ্যিক এক পরিব্যাপ্ততাকে প্রকাশ করে। অ্যাডোনিসের কবিতায় রয়েছে তার প্রখর ভাষাবোধেরও প্রতিফলন। তিনি কাব্যছন্দ কিংবা অলংকার ব্যবহার করে বিষয়ের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করতে চান। অর্ধ শতকেরও অধিক সময়ব্যাপী সাহিত্য-সাধনায় অ্যাডোনিস কবিতার বিষয় ও আঙ্গিকে এনেছেন নানামাত্রিক বৈচিত্র্য। আরব-কাব্যজগতে গদ্যকবিতা তার হাত দিয়েই পরিচিতি লাভ করে। অন্যদিকে শিল্পী হিসেবে আরব-আধুনিকতার অন্যতম ব্যতিক্রমী ও বিতর্কিত লেখকের অভিধাও তার ভাগ্যে জোটে। দ্য ন্যুয়র্ক টাইমসে ২০০২ সালের এক সাক্ষাৎকারে তিনি ঘোষণা করেন :
আরব দুনিয়ায় সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। এটা এখন সমাপ্তির পথে। বলতে গেলে (সাংস্কৃতিকভাবে) স্রষ্টা হিসেবে তো নয়ই বরং ভোক্তা হিসেবে আমরা এখন পাশ্চাত্যেরই অংশ।
অ্যাডোনিস তার কবিতার মর্মে ও দেহে আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত করেন ধ্রুপদী আরব-কাব্যের গভীর ব্যঞ্জনা এবং সঞ্চার করেন বিপ্লবাত্মক অনুভূতিকে। একজন প্রভাবশালী সাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও তার বিপ্লবী মনোভাবের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের আরও ক’জন নির্বাসিত সাহিত্যিকের মতোই তিনি স্বদেশ ছাড়া হন। অ্যাডোনিস বলেন, ‘আমি লিখছি এমন এক ভাষা-ভঙ্গিতে নির্বাসন যেখানে অনিবার্য।’ এ-বাক্যবন্ধে রয়েছে তার নির্বাসিত হওয়ার তীব্র যন্ত্রণার আর্তি।
অ্যাডোনিসের জীবন ও সাহিত্যিক সংগ্রামের সূত্র একতারে বাঁধা। এক দরিদ্র কৃষক পিতার ঘরে তাঁর জন্ম। তিনি মারা গেলেন ১৯৫২ সালে। বার বছর বয়সের আগে তিনি স্কুলেই যাননি; এমনকি তখন পর্যন্ত অ্যাডোনিসের বাবা মোটর গাড়ি দেখেননি কিংবা শোনেননি রেডিও। অথচ গ্রামের এক সাধারণ কৃষক ও মসজিদের ইমাম এ পিতাই ছিলেন তার প্রথম শিক্ষক। অ্যাডোনিসের লেখাপড়ার হাতেখড়ি তারই হাতে। সেই অ্যাডোনিস ১৯৫০ সালে টারটাসের ফ্রেন্স লিসেতে গ্র্যাজুয়েট হন। দামাসকাস বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও দর্শনের পাঠ তিনি গ্রহণ করেন। পেশাগত জীবনে দু’বছর সেনাবাহিনীতে কাটান। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শগত কারণে চাকরিরত অবস্থাতেই তাকে জেলে যেতে হয় বেশ ক’বার। ১৯৫৬ সালে তিনি স্বদেশ ছাড়েন। লেবাননের সাহিত্য-সমালোচক খালিদা সাইদের সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হয়ে সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বন্ধু ইউসুফ আল-খালের সঙ্গে শী’র নামক কবিতা পত্রিকা গড়ে তোলেন তিনি। আরব-কবিতার আধুনিকতা প্রকাশে এ-পত্রিকার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। সিরিয়ার জাতীয়তাবাদী সুর থাকায় এ-পত্রিকার নামে গুজব ওঠে। ফলে এ-পত্রিকার প্রথম দফা প্রকাশিত হলেই আরব দেশগুলোতে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৯৬৮ সালের দিকে এডোনিস সম্পাদিত মাওয়াকিফ নামক জার্নালের মাধ্যমে পুরোদমেই আরব-কাব্যের পুনর্জাগরণ ঘটতে থাকে। এর আগেই তিনি আঘানি মিহইয়ার আল-দামেস্কি নামক গ্রন্থে অতীত ইতিহাসের সূত্র উপস্থাপন করে তার বৈপ্লবিক চিন্তার প্রকাশ ঘটান।
সাহিত্য জীবন শুরু হওয়ার প্রাক্কালেই অ্যাডোনিস নামক ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন তিনি। গ্রিক মিথলজিতে অ্যাডোনিস অর্থ ‘সুদর্শন যুবক’। গ্রিক মিথে আফ্রোদিতির প্রেমিক এ যুবক পুনরুত্থানের থিমের সঙ্গে জড়িত। আরব-দুনিয়ার বদ্ধ হাওয়ায় প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতি সহজাত অনুভবের স্বীকৃতিও ঘটে তার এ নাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে। জীবনে প্রেম ও উজ্জীবনের মন্ত্রে তিনি পুনরুত্থানবাদী। ইন রেজারেকশন অ্যান্ড অ্যাশেশ-কাব্যে অ্যাডোনিস লেখেন :
হায় ফিনিক্স,
যখন তোমার প্রিয় পাখায় আগুন ধরে/বল তখন কী তোমার অবলম্বন?/কী করেই বা কর পাখার প্রতিস্থাপন?/তুমি কি মুছে ফেল তোমার প্রমাদ?/যখন ছাই-ভস্ম ঘিরে ফেলে তোমায়,/তখন অনুভবের পৃথিবী তোমার কেমন?
অ্যাডোনিসের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ দ্য ব্লাড অব অ্যাডোনিস ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়। আধ্যাত্মিক এক অনুভব তার এ-কাব্যের সঙ্গী। তিনটি নতুন কবিতা সংযোগে ১৯৮২ সালে তিনি প্রায় একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটান ট্রান্সফরমেশন অব দ্য লাভার নামক কাব্যগ্রন্থে। এতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে আরব সংস্কৃতির সেতুবন্ধন রচিত হয়। আরবে গ্রিসীয় সংস্কৃতি ও বাইবেলীয় প্রভাবকে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পূর্বেরই আরেক নাম।’ কিন্তু একথা বললেও পরবর্তী কালে তিনি পশ্চিমা বস্তুবাদকে বাতিল করেন। নিউইয়র্ক সিটিতে ভ্রমণ করার পর তিনি লেখেন গ্রেভ টু দ্য নিউইয়র্ক কাব্য। এ-কাব্যে আমেরিকান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকণ্ঠ। এ-প্রসঙ্গে ‘নিউইয়র্কের শেষকৃত্য’ নামক কবিতাটির অনুবাদ এখানে উল্লেখ করছি। কবিতায় সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে অ্যাডোনিসের এক গভীর অভিজ্ঞান লক্ষণীয় :
নিউইয়র্কের শেষকৃত্য
সমস্ত পৃথিবীর ছবি নারী/ কিংবা স্তন্যের মত আঁকা,/
এখানে বাঁচা কিংবা মৃত্যু/মধ্যে টিকে থাকে বঞ্চনা :/
নিউইয়র্ক,/চারপায়ে পশুর মত/এগিয়ে যায় হত্যায়,/
দূরে যারা-/ডুবে যায় বেদনায়;/নিউইয়র্ক তো নারীর মত/ইতিহাস যা কয়,/একহাতে চালায় স্বাধীনতা/প্রহসন অন্যকে ঠকায়।
অ্যামেরিকান সভ্যতার কঠোর সমালোচক এ কবি। অন্যদিকে অ্যামেরিকান কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের প্রতি রয়েছে গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তিনি হুইটম্যানকে তার পথনির্দেশক বলে মেনেছেন যেমন মেনেছিলেন ভার্জিল দান্তেকে। তার কথায় :
আমি দেখছি ম্যানহাটানের রাস্তায় তোমার কাছে উড়ে যাচ্ছে অসংখ্য চিঠি। প্রত্যেক চিঠি এক একটি ওয়াগনের মতো যেন কুকুর ও বেড়াল ভরে আছে। এই কুকুর-বেড়ালগুলোর বয়স একবিংশ শতাব্দির মতো, মানুষরা এখান থেকে নিশ্চিহ্ন হবে।
পাশ্চাত্য দর্শন ও সাহিত্যবোধকে সঙ্গী করেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিরোধিতা করেন অ্যাডোনিস। ওয়াল্ট হুইটম্যানকে তিনি যেমন গুরু মেনেছিলেন তেমনি বিশ শতকের গোড়ার দিকে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, অন্য আরব লেখকদের চেয়ে তিনি নিটশে ও হাইডেগারের, রঁ্যাবো ও বোদলেয়ারের অথবা গ্যাটে কিংবা রিলকের বরং কাছাকাছি। নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির মেল-বন্ধনে বিশ্বাস করতেন তিনি। তবে তা নিজস্বতাকে বিকিয়ে দিয়ে নয় কিংবা প্রশ্নহীনভাবে পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে গ্রহণ করে নয়। আবদুল গাফফার হোসাইন নামক আমিরাতের লেখক তার সম্পর্কে যা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি সমকালীন আরব দুনিয়ায় অ্যাডোনিসের মত আর একজন চিন্তাবিদও নেই যিনি তার মত উচ্চতা ও স্পষ্টতাকে ধারণ করতে পেরেছেন। তিনি তার বৌদ্ধিক ও শৈল্পিক প্রেক্ষাপট থেকে সভ্যতার নানাসূত্রকে একসঙ্গে গাঁথার ক্ষমতা রাখেন।’
গভীরতায়, অন্তর্দৃষ্টিতে, বৈচিত্র্যময় বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক মহামিলনকে ধারণ করে তিনি নিজস্ব সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি তার কাজের মাধ্যমে সমকালীন পৃথিবীতে আরব সম্পর্কে নানা ভুল ধারণার অবসানও তিনি ঘটাতে থাকেন। পূর্ব সম্পর্কে পশ্চিমের বুদ্ধিজীবীদের অন্ধকারাচ্ছন্ন ও একচ্ছত্র ধারণার মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেন। এমনকি আরবের অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের চেয়েও অ্যাডোনিসের চিন্তা আলাদা। সেখানে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দু’ধরনের চিন্তার প্রকাশ লক্ষণীয়। একদল যারা পুরোপুরি পশ্চিমা সভ্যতাকে গ্রহণ করেছেন তাদের কাছে ‘যা কিছু বাইরের তা সব উচ্চমান সম্পন্ন’। বাইরের বলতে মূলত পশ্চিমকেই চিহ্নিত করা সমীচীন। তার দৃষ্টিতে এসব বুদ্ধিবাদীরা কেবল অনুকরণেই বিশ্বাস করেন। অন্য একদলের কাছে বাইরের কিছু মানে শয়তানের সঙ্গে আঁতাত করা। আবার এটাও সত্য সাংস্কৃতিকভাবে বাইরের কোনও কিছুকে তারা অগ্রাহ্য করলেও শেষ পর্যন্ত তারা পশ্চিমের ওপরই নির্ভরশীল। পণ্য ব্যবহারে, কি তাদের জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গে কিংবা পাশ্চাত্য যন্ত্রসভ্যতাকে তারা ইচ্ছা করলেও এড়াতে পারেন না। অ্যাডোনিস বিরোধ নয় বরং এ দুই সংস্কৃতিকে মেলাতে চান। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আরবকে পাশ্চাত্যে এবং পাশ্চাত্যকে আরবে পরিচিত করে তোলেন। বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক ভাবনায়, পক্ষপাতহীনতা ও নৈর্ব্যক্তিকতার সঙ্গে ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিধিকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক মিলনের মধ্য দিয়ে মানবতার বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে চেয়েছেন।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে অ্যাডোনিস কবিতার পাশাপাশি তার অনুভবের জগতকে ধরার জন্য ছবি আঁকার কাজে হাত দেন। এ সময়ের কিছু কোলাজ কর্মে (দুবাইয়ের হানার গ্যালারিতে প্রদর্শিত) অ্যাডোনিসের আঁকা ক্যালিগ্রাফি ও শব্দ দিয়ে তৈরি চিত্রকর্মগুলো সাংস্কৃতিক মিলনের কথা বলে। মানের উচ্চতায়, সৃষ্টিকর্মের নৈপুণ্যে এবং সুসংহত শৈল্পিক গুণে সত্যিই সেগুলো বহির্বিশ্ব ও আরব-আধুনিকতার মিলনবিন্দু। তার প্রায় সব ক্যালিগ্রাফির পেছনে কোলাজ থাকে। সব সময় শাব্দিক ও ভাষিক স্তর দিয়ে সেগুলোতে পৌঁছানোও যায় না। কবির পাশাপাশি একজন চিত্রী হিসেবে তার এ-আবিষ্কার একটি ভিন্নমাত্রায় সূচিত। তার সংগৃহীত নানা বস্তুগুলো ক্যালিগ্রাফির পাশে ভিড় করে থাকে। মানুষ কিংবা পশু থেকে শুরু করে, দরজা-জানালা, বাড়িঘর, সৌধ নানা কিছু সেখানে আর্কিটেকচারাল মহিমা তৈরি করে। আপাত অর্থহীনতার মধ্যেও সেগুলোর এক ধরনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য থাকে। আসলে শব্দ-সম্ভব কবিতার জগতকে তিনি চিত্রে প্রতিফলিত করেন। তার কাছে শব্দ মানে সমুদ্রের মতো বিশাল। আর এ বিশালতার ওপর ভেসে থাকে বস্তুবিশ্বের নানা উপাদান। তার প্রত্যেকটি কোলাজ একেকটি জলভাষ্য যা আরব সাগরের ওপর ভাসিয়ে নেয়া নানা সামগ্রীর মতো। অন্য কথায়, আমাদের বাস্তব বিশ্বের নানা পঙ্কিল আবরণ সরিয়ে তা নিয়ে যায় এক নৈঃশব্দিক চেতনাজগতে। শিল্পী হিসেবে তিনি বিশ্বাস করেন জগতে বেঁচে থাকার কিছু না কিছু অর্থ আছে।
তিনি মানেন, শুধু জীবন ও জগতের লেনদেন নয় বরং মানুষের অন্তর্গত অনুভূতি ও স্বভাব দ্বারা পরস্পরের মধ্যে কিছু একটা সঞ্চার করতে পারলে জীবনের অর্থ আবিষ্কার করা সম্ভব।
অ্যাডোনিস মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছেন। অন্যদিকে কবি হিসেবেও তিনি নিরীক্ষাধর্মী। গতানুগতিকতার হাত থেকে কাব্যকে বাঁচানোর সংগ্রাম তিনি করেছেন। সমকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক চিন্তাকে তিনি কবিতার আঙ্গিকের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করতে চাইতেন। তার নির্বাসনকে তিনি বলেছেন দু’ধরনের বাস্তব হিসেবে। একটি ভেতরের আরেকটি বাইরের। তিনি বলতেন আরব কবি হওয়ার জন্য নির্বাসন শুধু একটি কারণ বা বিষয় নয়, এ ভাষাটির জন্মই হয়েছে নির্বাসনের মধ্যে। এর মধ্য দিয়ে হয়তো তিনি সমাজ-রাজনৈতিক সূত্রকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। সেন্সরশিপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দমন, পীড়ন, বহিষ্কার, অন্তরীণ রাখা কিংবা হত্যাকাণ্ডের রাজনীতিকেও তিনি তাই নির্বাসন ছাড়া আর কিছু বলতে চাননি। অ্যাডোনিস প্রত্যক্ষ করেছেন আরব-সংস্কৃতির স্থবিরতার কারণগুলো। ফলে তার কাব্যশক্তি ভেতর থেকেই জন্ম দিয়ে যাচ্ছিল এক ধরনের বিতর্কিত অবস্থাকে। তার কবিতা খুঁড়লে তাই পাওয়া যায় ঐতিহাসিক গভীর আধ্যাত্মবোধের ছায়া। সমালোচকের কাছে তা অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট বলে বিবেচিত। ফ্রেঞ্চ সুররিয়ালিজমকে আরব কাব্যের ভেতরে প্রবেশ করে তিনি জন্ম দিয়েছেন এমন এক শিল্পকে যা তিনি নিজেই ব্যক্ত করেন অধরা বলে। তিনি বলেন, ‘রহস্যাচ্ছন্ন অন্ধকারের মতো কোনও কিছুই আমাকে স্পষ্ট করে না, অথবা এটাই সত্যি স্পষ্টতাও আমার কাছে রহস্যাচ্ছন্ন অন্ধকারের মতো যা কিছুই খোলাসা করে না।’ অনুভবি শিল্পী হিসেবে তার এ বোধ বর্তমান পৃথিবীর জটিল সাম্প্রতিককেই প্রকাশ করে, যেখানে ঘরে বাস করেও ঘরহারা মানুষের অনুভূতি একজন নির্বাসিত মানুষের মতোই সত্য হয়ে ওঠে।
http://www.ejugantor.com/2013/01/11/
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন