‘শিশিরের শব্দ’তে ছাপা। পত্রিকা লিঙ্ক : https://wp.me/p46zKa-Pt
সত্য যে, কবিতা হৃদয়ে প্রবেশ করে ছন্দের দরজা দিয়ে। এখন তা সদর দরজা হোক আর খিড়কি দুয়ারই হোক। দরজার প্রকারভেদ নিয়ে মামলা হতে পারে কিন্তু ছন্দ নিয়ে নয়।
হ্যাঁ সবকিছুতেই ছন্দ রয়েছে—শুধু কবিতা বা সঙ্গীতে নয়। ছন্দ মানুষের মনের বিশেষ অবস্থা। ছন্দ দেহেরও বিশেষ অবস্থা। এই মন ও দেহে যখন তা মিলে যায় তখন ছন্দ সম্পূর্ণতা পায়। কারণ ছন্দ এক বিশেষ শরীরবৃত্তীয় ব্যাপার। মানুষের হৃদপিণ্ড যে ছন্দেই স্পন্দিত হয়। আর এই ছন্দপতন ঘটলে হৃদযন্ত্রের অসুখ কিংবা মৃত্যু অনিবার্য। প্রাণীদেহে রক্তও চলে বিশেষ ছন্দে, যেটাকে বলি পাল্স। কাজেই ছন্দকে অবজ্ঞা করার কোনোই মানে নেই। আজকালকার কবিতা-বিশেষে ছন্দের খুব প্রয়োগ নেই। কিন্তু ছন্দকে ব্যবহার না করতে পারেন কেউ, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, ছন্দ সম্পর্কে অজ্ঞাত হলে তো চলে না। ছন্দের সঙ্গে যে মানব-হৃদয়ের গভীর সংযোগ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘কাব্য ও ছন্দ’ নামক প্রবন্ধে বলেন―
“ছন্দের মধ্যে যে বেগ আছে সেই বেগের অভিঘাতে রসগর্ভ বাক্য সহজে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে, মনকে দুলিয়ে তোলে―এ কথা স্বীকার করতে হবে।”
রবীন্দ্রনাথের কথা স্বীকার না করেও উপায় নেই। গদ্যছন্দের কথা বলতে গিয়ে মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কাব্য ও ছন্দ’ নামক প্রবন্ধে উক্ত প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। কিন্তু ছন্দ সম্পর্কে এটাইতো সারস্বত সত্য। কবিতা হৃদয়ে প্রবেশ করে ছন্দের দরজা দিয়ে। এখন তা সদর দরজা হোক আর খিড়কি দুয়ারই হোক। দরজার প্রকারভেদ নিয়ে মামলা হতে পারে কিন্তু ছন্দ নিয়ে নয়। কেননা মানুষের জীবনের মৌলিক অনুভূতির মধ্যেই রয়েছে ছন্দের অবস্থান। তাই কেবল কবিতা নয়, ছন্দ একটি মস্তিষ্কজাত, এমনকি হৃদয়জাত প্রক্রিয়া। জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গেই এই ছন্দ প্রয়োজন, নইলে ‘ছন্দপতন’ কথাটা আমরা কেন বলি? হৃদস্পন্দন না হলে মানুষ বাঁচে না, মানুষের প্রেম বাঁচে না, বাঁচে না সুন্দরতম অনুভবগুলো। ছন্দপতন হলে মানুষের জীবনে ধস নামে। আর কবিতার ছন্দে পতন হলে কবিতার স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট হয়ে যায় স্বাভাবিক গতি, স্পন্দন ও কাব্যরসটুকু।
মহাকাল-মহাপৃথিবীর অপার বিস্ময়ের একটি এই ছন্দ। কবে কোন কালে ছন্দ কাব্যদেহে প্রযুক্ত হয়েছে, তার একাডেমিক ইতিহাস আছে। তেমনি রয়েছে মানব-হৃদয়প্রসূত গভীর অন্তর্জ্ঞান। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা কবিতা কোথায় নেই ছন্দের কারিগরি? শুধু কবিতা নয়, বলতে হয়―গদ্য বোঝার জন্যও তা জরুরি। জরুরি আমাদের জীবনের অন্তর্নিহিত ছন্দটা বোঝার জন্যও।
ছন্দ নিয়ে কথাশিল্পী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চমৎকার একটি বক্তব্য আছে। তিনি বলেন―
ছন্দ আসলে সব কিছুতেই আছে। একটা লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে―এর মধ্যে যেমন ছন্দ আছে, তেমনি পাথরে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পা টলে গেল―তারও একটা ছন্দ আছে। কথা হলো, প্রথাগত ছন্দটা জেনে রাখা ভালো। কিন্তু এর দাসবৃত্তি করা ভালো নয়। বই পড়তে হবে ছন্দ সম্পর্কে সামান্য ধারণা পাওয়ার জন্য। তবে শিখতে হবে নিজের মতো করে। আর ছন্দ শেখার পর ওটা ভুলে যেতে হবে। ছন্দ কাজ করবে ভেতরে ভেতরে, অত স্পষ্টভাবে তাকে টানার দরকার নেই।
অনেকে তাই ছন্দ-নির্ভরতাকে এড়িয়ে চলতে চান। কিন্তু সাহিত্যিকমাত্রই ছন্দের অনুভবকে দার্শনিকভাবে উপলব্ধি করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলা কবিতায় গদ্যছন্দের পুষ্টি-পরিণতি। কিন্তু তাঁর গদ্য কবিতা খনন করলেও পর্বে-মাত্রায় বিন্যস্ত এক অপূর্ব ছান্দসিক সত্তার পরিচয় মেলে। যারা ছন্দকে ভেঙেচুরে উত্তরাধুনিক করতে চান, তাদের নির্ভরতাও কিন্তু ওই ছন্দই। ছন্দকে অস্বীকারের মধ্যে বাহাদুরি আছে বটে―তা ছন্দকে না জেনে নয় অবশ্যই। ছন্দ জানলেই তবে ছন্দকে ভাঙা যায়। মহামহিম বিদ্যাসাগর যখন বাংলা সাহিত্যের প্রথম পর্বে গদ্য তৈরি করেছেন তখনও ছন্দের প্যারামিটারটা ছিল তাঁর হাতে ধরা। কারণ তিনি জানতেন মানব-অনুভূতির পালসটাকে ধরতে হলে ছন্দে পারঙ্গম হওয়া চাই। পুনশ্চ রবীন্দ্রনাথের ছন্দ বিষয়ক ধারণা উপস্থাপন করা যেতে পারে। তিনি বলেন :
গদ্যই হোক, পদ্যই হোক, রচনামাত্রেই একটা স্বাভাবিক ছন্দ থাকে। পদ্যে সেটা সুপ্রত্যক্ষ, গদ্যে সেটা অন্তর্নিহিত। সেই নিগূঢ় ছন্দটিকে পীড়ন করলেই কাব্যকে আহত করা হয়। পদ্যছন্দবোধের চর্চা বাঁধা নিয়মের পথে চলতে পারে কিন্তু গদ্যছন্দের পরিমাণবোধ মনের মধ্যে যদি সহজে না থাকে তবে অলংকার-শাস্ত্রের সাহায্যে এর দুর্গমতা পার হওয়া যায় না।
রবীন্দ্রনাথ এখানে সচেতনভাবে অলঙ্কারের প্রসঙ্গ তুলেছেন। কারণ প্রাচীন অলঙ্কারশাস্ত্রে এই ছন্দের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই শাস্ত্র দিয়েই সেই যুগের কাব্যমূল্য সূচিত। যা কিছু নান্দনিক, সৌন্দর্য সৃষ্টিকারী উপাদানের সঙ্গে যুক্ত, তা-ই প্রাচীন কাব্যতত্ত্ব। আর এই কাব্যতত্ত্ব মানে ছন্দ ও অলঙ্কারের মিলিত প্রক্রিয়া। অলঙ্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ ভূষণ’যা দিয়ে মানবদেহ সজ্জিত করা যায়। কাব্যলঙ্কারের অর্থও তাই কাব্যদেহের সৌন্দর্য সৃষ্টি করা। কিন্তু পরিমিতিবোধের অভাবে ‘গোলে হরিবল’ হয়ে যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ সেই সদা সতর্ক বাক্যই উচ্চারণ করেছেন।
বর্তমানে এই অলঙ্কার শাস্ত্রেরও প্রয়োজনীয়তা হ্রাসপ্রাপ্ত। কিন্তু খুব ভাল করে উপলব্ধি করলেই স্পষ্ট হয় যে―অলঙ্কারের প্রয়োজন আজো ফুরায়নি। আমাদের আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ যখন বলেন, ‘উপমাই কবিত্ব’ তখন এই উপমার বরাতে আরেকবার অলঙ্কারশাস্ত্রের কথা মনে পড়ে। তাছাড়া আমাদের নিত্যদিনের কথা ও অভ্যাসের জগতেও রয়েছে এই অলঙ্কারের চেতন-অবচেতন প্রয়োগ। অত্যন্ত সুচারু-সূক্ষ্মভাবেই এ-বিষয়টা ঘটে চলে। কথার কারিকুরিতেই জন্ম নেয় ‘বক্রোক্তি’, ‘অতিশয়োক্তি’, ‘বিরোধাভাস’, ‘যমক’ কিংবা ‘উৎপ্রেক্ষা’র। কাজেই মানুষের অবচেতন মন থেকেই তৈরি হয় এইসব ব্যঞ্জনা, আবেগদীপ্ততা। আবেগ-অনুভবের ভাষা, এই ভাষাসৃষ্টির প্রক্রিয়া এবং তার মাধ্যম গদ্য-পদ্য। আর উভয়বিধ বিষয়ের জন্যই অলঙ্কার চির প্রাসঙ্গিক। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের কবিতা বিশ্লেষণ করতে গেলে অলঙ্কারের প্রয়োগ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা পড়া হয়, বিশ্লেষণ করা হয়। সেসব কবিতা-পাঠে বিষয়বস্তু যেমন বোঝা জরুরি, তেমনি থাকা চাই ছন্দ-অলঙ্কার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা। অবশ্য বিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পৌঁছার পূর্বেই শিশুরা ছড়া-কবিতা পাঠ করে। শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ত আবৃত্তির সঙ্গে তার দেহের দুলুনি কিংবা অভিনয় লক্ষ করার মতো। সে যখন আপন মনে গান করে সেখানেও একধরনের ছন্দ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা পর্বে পর্বে ভেঙে স্বরবৃত্ত ছন্দে পাঠ করা যায়। অন্যদিকে এই ছন্দই পোক্ত হয়ে মধ্যম লয় গ্রহণ করে। তখন সেই কবিতাকে বলি মাত্রাবৃত্ত। আবার অপেক্ষাকৃত ধীরগতির কবিতা অক্ষরবৃত্ত। এসব ছন্দেরও আবার রয়েছে বহুভঙ্গিম বিভাজন, বিচিত্র গঠন-প্রক্রিয়া। এই অক্ষরবৃত্ত ছন্দের সঠিক পাঠ না জানা থাকলে মধ্যযুগের কবিতা পাঠ একটি দুষ্কর ব্যাপার বৈকি। সেই মধ্যযুগের পয়ার ছন্দের নিগড় অতিক্রম করেই তো জন্ম নেয় অমিত্রাক্ষর ছন্দ। জন্ম নেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচয়িতা একজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এই অক্ষরবৃত্তেই আধুনিক কবিতার পরিপুষ্টি। মন মননের কবিতার অপূর্ব বন্ধন সে।
আবার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ছন্দরূপ গঠনের প্রক্রিয়াও বহুমুখি। বিভিন্ন দেশের ছন্দ ও মাত্রা-গণনাও বিভিন্নমুখি, বৈচিত্র্যময়। বাংলা ভাষার প্রতিভাবান অনেক সাহিত্যিক বিভিন্ন দেশের ছন্দ-রূপক-অলঙ্কার প্রয়োগ করেছেন। বাংলা কাব্যে বিচিত্রতা এনে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছেন। বিভিন্ন দেশের বৈচিত্র্যময় কবিতার বিচিত্র রূপের মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতা হয়েছে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর। সারা বিশ্বে সনেট, লিমেরিক, হাইকু, রুবাই, কাসিদা, গযলসহ রয়েছে নানা ছন্দের কবিতা। এসব কবিতা-পাঠে কারুর সাধ্য নেই ছন্দকে অতিক্রম করা। আবার ছন্দকে নীরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর মতে সচেতনে অস্বীকার করাও জরুর। ছন্দ পেয়ে বসলে কেবল ছন্দ মিলতে পারে, কবিতা হবে না। তা-ই সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিচার-বিবেচনা বৈদগ্ধ্য ও বোধের। প্রয়োজন জানা, কতটুকু তরকারিতে কতটুকু লবন-মশলা।
রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ত্রিশ ও ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতা এমনকি হাল আমলের পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক কবিতা-বিশ্লেষণে কি বোঝাপড়ায় ছন্দ ও অলঙ্কার দরকারি। ছন্দ ও অলঙ্কার জানাকে অনেকে দুরূহ বলে মনে করেন। কিন্তু সঙ্গীতের হৃদয়কাড়া সুরের মতোই এই ছন্দ-অলঙ্কার কারো কারো প্রিয় থেকে প্রিয়তর, তারও চেয়ে প্রিয়তম বিষয় হয়ে উঠতে পারে। তখন কবিতা হৃদয়ে প্রবেশ করবে খিড়কি দুয়ার নয় বরং সদর দরজা দিয়ে।
খোরশেদ আলম, লেখক ও শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন