১. কোনো লেখকই নিজের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করেন না। … কেবল নিজেদের জন্য সাহিত্য সৃজন করা যায়, পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষের মানচিত্র নেই।
২. সাহিত্য এমন এক শক্তি, যা আপনাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে ও একনায়কের বিরুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করবে। আর এ কারণেই আমি সাহিত্যের প্রতি এতো কৃতজ্ঞ। —ইসমাইল কাদারে
স্বদেশ থেকে উৎখাত হলেই লেখক ভূমিচ্যুত হয়ে যান না। শরণার্থীর মতো ইসমাইল কাদারে নিজেও ঘুরেছেন বহির্বিশ্বে। একসময় ফ্রান্সে নির্বাসন নিয়ে ডায়াস্পোরার মতো ঠিকানা খুঁজেছেন নিজের দেশে। সাংস্কৃতিক আত্মতা ও স্বকীয়তায় অন্বেষণ করতে চেয়েছেন নিজের ভূমিকে। ফিরতে চেয়েছেন স্বজাতির কাছে বারবার। ১৯৬৭ সালে আলবেনিয়া তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করে। কৃষক ও শ্রমিকদের জীবন সম্পর্কে জানার জন্য কাদারেকে অন্যান্য আলবেনিয়ান লেখকদের সাথে গ্রামাঞ্চলে পাঠানো হয়। তবে তিনি সবসময় নিজেকে আপন দেশেও নির্বাসিত মনে করতেন।
মিলান কুন্দেরার পর ইসমাইল কাদারে একমাত্র লেখক যিনি সাহিত্যকে এক ধাক্কায় কয়েকশো বছর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি তুলনীয় নিকোলাই গোগোল, জর্জ অরওয়েল, বালজাক, গার্সিয়া মার্কেজ,নাগিব মাহফুজ, কাজানসাকিস, ফ্রানৎস কাফকা প্রমুখ বিশ্বের বড় বড় লেখকদের সঙ্গে। ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে লিখেছেন তিনি। ৮৮ বছর বয়সে ২০২৪ সালের ১ জুলাই তিনি না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কারজয়ী ইসমাইল কাদারের নাম নোবেলের তালিকায় উঠেছে অন্তত পনেরো বার। তা না পেলেও, সাহিত্যিক অবদানের জন্য তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার, ২০০৯ সালে প্রিন্সেস অফ অ্যাস্টুরিয়াস পুরস্কার, ২০১৫ সালে জেরুজালেম পুরস্কার এবং ২০২০ সালে নিউস্ট্যাড আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কারসহ তিনি বহুরকম সাহিত্য-পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক লেখালেখিতে আজীবন অবদানের জন্য ২০২৩ সালে পেয়েছেন আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড।
ইসমাইল কাদারে আলবেনিয়ার সাহিত্যকে গৌরবের সঙ্গে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। আলবেনিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিচিত্র জটিলতাও উঠে আসে তার লেখায়। স্বসমাজের বিভিন্ন দিক—ঐতিহ্য, আধুনিকতা, রাজনীতি ও মানবতাকে তার মতো করে উপস্থাপন করেছেন তিনি। তার সাহিত্যকর্মগুলো ৩০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি তার সাহিত্যে যে কণ্ঠস্বর তৈরি করেন, তা তীব্রভাবে পাঠকের মনোযোগ-আকর্ষী। আলবেনিয়ার সমাজ, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্দরমহলের উত্তাপ উপলব্ধি করতে তা বেশ সহায়ক। কাব্যিক ভাষার ব্যবহার এবং গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে উচ্চকিত তার লেখা যেন আলবেনীয় জনগণের সংগ্রাম ও প্রতিরোধের দর্পণ। তার রূপক অবলম্বী উপন্যাস ‘ব্রোকেন এপ্রিল’ ও ‘দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’তে প্রকাশিত বাস্তবতা অত্যন্ত বিদ্রুপাত্মক। বস্তুত একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। ১৯৬৩-তে যখন ‘দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’ রচনা করেন, তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ২৬ বছর। অন্যদিকে ১৯৪০ সালের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তীকালে বিশ্বসাহিত্যে যে-আধুনিকতার জোয়ার আসে, তিনি তার অন্যতম পথিকৃৎ। পুরনো মূল্যবোধ অতিক্রম করে বিশ্ব তখন চিন্তাগতভাবে নতুন দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিপন্ন বাস্তবতায় নিপতিত সেকালের মানব-পরিস্থিতি। আর বহুমুখী সংস্কৃতির অভিযোজন ও দ্বন্দ্ব তখন তুঙ্গে অবস্থান নিচ্ছে।
ইসমাইল কাদারে ছিলেন টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধ বক্তাদের একজন। বলতে গেলে, সাহিত্য সম্পর্কে বেশিরভাগ শাসকেরই উষ্মা থাকে। কারণ সৎ সাহিত্যিক কারো তাবেদারি করেন না, মিথ্যা গালগল্প লেখেন না। সম্মিলিত মানুষের প্রতি বিশ্বাসী তাদের দৃষ্টিতে থাকে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা। কিন্তু ইতিহাস ও রাজনীতিতে একনায়কদের দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকে চরম পক্ষপাতদুষ্টতা। তার কথা, “শাসকরা ভিন্নমতাবলম্বী বা প্রথা-অনুসারী। তবে কারো পতাকা নিয়েই হাঁটিনি কখনও।” নানা কারণে আলবেনিয়ার তৎকালীন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ইসমাইল কাদারের নামে দেশদ্রোহীর দুর্নাম এঁকে দেয়। স্বৈরশাসক এনভার হোক্সার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের সাক্ষর রয়েছে তার ‘ব্রোকেন এপ্রিল’ ও ‘দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’ উপন্যাসে।
গত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে আলবেনিয়া ছেড়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমান ইসমাইল কাদারে। এক যুগ পর ২০০২ সালে আবার দেশে ফেরেন। ‘দ্য জেনারেল অফ দ্য ডেড আর্মি’ ছাড়াও ১৯৮১ সালে প্রকাশিত আরেকটি উপন্যাস ‘দ্য প্যালেস অফ ড্রিমস’ও স্বদেশী কমিউনিস্ট সরকারের তীব্র সমালোচনা। বলা যায়, আলবেনীয় স্বৈরশাসনের নিকষ কালো অধ্যায় এ-উপন্যাসে চিহ্নিত। প্রকাশের সাথে সাথেই নিষিদ্ধ হয় ‘দ্য প্যালেস অফ ড্রিমস’। গণতন্ত্রের পক্ষে বিবৃতিদাতা কাদারেকে ১৯৯০ সালে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়। তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘এ ডিক্টেটর কলস’ প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। সেটিও স্বৈরশাসকের অপশাসনের বিরুদ্ধে লেখা। নিজের উপন্যাস সম্পর্কে তার বক্তব্য :
আমি দুটি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সময় সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছি: একটি কালোতম অধ্যায় যা ৩৫ বছর ধরে চলে (১৯৫৫-১৯৯০), অন্যটি ২০ বছরের স্বাধীনতা। উভয় ক্ষেত্রেই, যে জিনিসটি সাহিত্যকে ধ্বংস করতে পারে তা হচ্ছে—সেলফ-সেন্সরশিপ।
মাত্র ১১ বছর বয়সে ইসমাইল কাদারে ‘ম্যাকবেথ’ পড়েছিলেন। সবকিছু বুঝতে না পারলেও বইটা তার এতোটাই পছন্দ হয়ে যায় যে, এটি নিজ হাতে লিখে কপি করতে আরম্ভ করেন। এক বছর পরে, ‘হ্যামলেট’-এর ক্ষেত্রেও তিনি একই কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘ম্যাকবেথে’র চেয়ে ‘হ্যামলেট’ ছিলো তার কাছে দুর্বোধ্য। তবে এগুলো ছিলো সাহিত্যে তার হাতমকশো করার প্রেক্ষাপট। ‘ম্যাকবেথ’ তার কাছে ছিলো চিন্তারাজ্য খুলে দেবার মতো বই। পরিণত কাদারে পরবর্তীকালে নিজের দেশ আলবেনিয়ার সমাজ ও সংস্কৃতিতে মনোনিবেশ করেন। সাহিত্যের ইতিহাস ঘেটে তিনি উপলব্ধি করেন যে, আলবেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যগাথা বেশ মূল্যবান। তা জাতির অন্তর্দর্শনে সমৃদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে তার পরিণত লেখাগুলো হারিয়ে যাওয়া বলকান জীবন-আশ্রয়ী।
ইউরোপের সাহিত্যভূমিকে মোটাদাগে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়—দান্তের এপেন্নিস; সফোক্লিস-এস্কিলাসের গ্রিক (ট্রাজেডি), দন কিহোতের আইবেরীয় অঞ্চল, শেক্সপিয়রের বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জ এবং মধ্যযুগীয় আলবেনীয় শোকগাথায় ঘেরা বলকান অঞ্চল। শেষেরটি ইসমাইল কাদারের সাহিত্যকর্মে পরম উৎকর্ষে প্রতিষ্ঠিত। শুধু আলবেনিয়ার নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের পাঠকদের মন কাড়েন তিনি। অন্যদিকে তার প্রবল প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের সাহিত্য সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের অনুপ্রেরণার বিষয়ে পরিণত হয়। ‘এএফপি’র এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,
‘সাহিত্য হলো এমন এক শক্তি, যা আপনাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে ও একনায়কের বিরুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করবে। আর এ কারণেই আমি সাহিত্যের প্রতি এত কৃতজ্ঞ। কারণ, এর মধ্য দিয়েই অসম্ভব বলে যা প্রতীয়মান হয়, তা-ও জয় করা সম্ভব।’
ইসমাইল কাদারে মনে করেন মানুষের শিল্পসাহিত্যের বোধ সহজাত। তাই তাদেরকে শুধুই এ-বোধ সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়োজন নেই। তার মতে—মানচিত্রের বই, ইতিহাসের বই এসবই মানুষের বৈশ্বিক ধারণা তৈরির জন্য যথেষ্ট। প্রকৃত মানুষ তার স্বসমাজের অত্যাচারের প্রতি অবিচলভাবে প্রতিরোধী হবে। অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার শক্তি হয়ে উঠবে। এছাড়া তাদের মুক্তির পথ খুবই সংকীর্ণ। আর এভাবেই তৈরি হয় প্রকৃত দেশাত্মবোধ। যেখান থেকে উঠে আসে জনতার শাসক। এসব ধারণা থেকেই কাদারে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের রাজনৈতিক মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বর।
অন্যদিকে মানুষের মনকে শক্তিশালী করতে হলে প্রয়োজন অঞ্চলবোধ। আমাদের বাংলা সাহিত্যে যারা স্বমহিমায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, তারাও এই অঞ্চলবোধকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, সতীনাথ ভাদুড়ী, শওকত আলী, কায়েস আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, দেবেশ রায়, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখের নাম। এছাড়াও আমাদের সাহিত্যে যারা এর ভিত্তিভূমি তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম, তারাও তাদের স্বীয় কালের স্মারককে সাহিত্যে ও শিল্পের বোধ হিসেবে প্রোথিত করেছিলেন। নইলে পাওয়া যেতো না রবীন্দ্রনাথের লোকসাহিত্য বিষয়ক উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ। আর কাজী নজরুল ইসলামের ব্রিটিশবিরোধিতা তো স্বজাতির জন্য রীতিমতো প্রয়োগযোগ্য বিষয়। যেখানে প্রতিরোধের সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে নিজের দেশের কাঠামোর কাছে ফিরতে চেয়েছেন তিনি। ভিনদেশী সাহিত্যের স্বাদ-আস্বাদন সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ মনোযোগী হয়েছিলেন লোকসাহিত্য সংগ্রহে। গ্রামগঞ্জের পথে আবহমান ধরে বয়ে চলা লোকঐহিত্যের গুরুত্ব তিনি স্বীকার করেছেন। তরুণ বয়সেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এগুলো মোটেও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয় নয়। আঞ্চলিক কাঁচা সাহিত্যই একসময় বড় লেখকের হাতে পড়ে মহিমাময় হয়ে ওঠে। তবে তিনি বহমান লোকজীবনের গুরুত্ব দিলেও, মূলধারার সাহিত্যে তার ব্যবহার করেছেন কমই। চুরুলিয়ার লেটোগানের দলের শিল্পী নজরুলের সৃষ্টিপ্রতিভার অনেকখানি দেশ ও মাটিনির্ভর। চুরুলিয়ায় জন্ম এ-মানুষটি যেখানেই গেছেন, সেখানকার ভূপ্রকৃতি, মানুষ ও বন্ধন তার কাব্য ও গানের বিষয় হয়ে উঠেছিলো। এরকম গানের কথাগুলো তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ—“একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী/ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবণী।” অথবা, পদ্মার ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের প্রতিধ্বনি শুনি, যেখানে চাঁদের আলোয় কৃষ্ণকালো গ্রাম্য বঁধূয়ার রূপ ঝলকে ওঠে— “পদ্মার ঢেউ রে/মোর শূন্য হৃদয় নিয়ে যা যা রে/ও পদ্মা রে ঢেউয়ে তোর ঢেউ ওঠায় যেমন চাঁদের আলো/মোর বঁধুয়ার রূপ তেমনি ঝিলমিল করে কৃষ্ণ কালো।” ১৯২০ সালের পরে ৬/৭ বছর ধরে নজরুল বাংলাদেশের গ্রাম থানা ইউনিয়ন মহকুমা জেলা ভ্রমণ করেছেন। নদীবিধৌত বাংলার রূপ তিনি কাছ থেকে উপলব্ধি করেছেন, তাকে ব্যবহার করেছেন শিল্পের অনন্য শক্তিতে।
তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের সাহিত্য অন্বেষণ করলে স্পষ্টত ধরা পড়ে—অঞ্চল ও আঞ্চলিকতার কতো গভীরে তাদের মনোনিবেশ ছিলো। তাদের সৃষ্ট চরিত্র ও কাহিনির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে তা-ই আবিষ্কৃত হয়। অন্যদিকে কায়েস আহমেদ বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্য খনন করলে প্রকৃতি-মাটি-জনমানুষ ও জলবিধৌত জীবন এমনিতেই ভাস্বর হয়ে ওঠে। লোক পরিকাঠামোর বিশ্বাস-আচার-ভূগোলে তা শৈল্পিক সৃজনভূমিতে একাকার। ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’য় আঞ্চলিক একটি নদী বা বিল, সেখানকার অন্ত্যেবাসী মানুষ, তাদের জীবনের শৈল্পিক অভিব্যক্তি, গানে ও লোককথার অপূর্ব মিশেলে মহত্তম মর্যাদা লাভ করে। সতীনাথ ভাদুড়ীর আন্তরিক প্রেক্ষাপটও অবজ্ঞাত জনমানুষের ভূগোলকে ঘিরে। জসীম উদদীন, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদের কবিতার পরতে পরতে লোকপরম্পরার স্বদেশ। এভাবেই বাংলা সাহিত্যে একের পর এক শৈল্পিকতা তৈরি হয়েছে জীবনের তলানিতে থাকা মানুষের প্রসঙ্গ নিয়ে। তারাই একটা দেশের সত্যিকার সাহিত্যস্পন্দন। এদের কম্পাঙ্ক ধরতে না পারলে কেউই বড় সাহিত্যিক হতে পারবেন না। দায়িত্ববোধের প্রসঙ্গ শুধু নয়, শৈল্পিক নির্মিতির বিষয়েও তা প্রাসঙ্গিক। ইসমাইল কাদারেকেও দেখি স্বদেশের তথা আলবেনীয় আঞ্চলিকতার কাছাকাছি যেতে। তিনি মানুষকে ইউরোপীয় ধারণা পরিত্যাগ করে স্বদেশী ধারণার প্রতি বিশ্বাসী করে তুলেছেন।
ইউরোপীয়দের চোখে বলকানের মানুষ সাধারণত বেশ কর্কশ আর ঝগড়াটে। একথায় কিছুটা সত্যতা আছে বটে, তবে একথাও মানতে হবে, বলকানের মানুষ, বিশেষ করে আলবেনীয়রা সাহিত্য খুব ভালোবাসে, এমনকি সাহিত্যকে জীবনে ধারণ করারও চেষ্টা করে।
ইউরোপীয়দের চোখে বলকানরা অপরিশীলিত, উপরন্তু তারা কর্কশ আর ঝগড়াটে। একথায় কিছুটা সত্যতা থাকলেও, বলকানরা বিশেষত আলবেনীয়রা সাহিত্য খুব ভালোবাসে। এমনকি সাহিত্যকে তারা তাদের জীবনে ধারণ করারও চেষ্টা করে। আসলে জীবনের ভিন্নতর রূপকে স্বীকার করে নিতে হয়। সত্যের তো বহুমুখ, তা একপেশে নয় কোনক্রমেই। যেমন, বাস্তবজীবনে নারীদের প্রতি আলবেনীয়দের মনোভাব ঈর্ষণীয় না হলেও শিল্প-সাহিত্যে নাকি যথেষ্ট ইতিবাচক। আলবেনিয়ার মতো আর কোনো দেশের সাহিত্যে নারীরা এতোটা মূল্যায়িত হন না। তাদের সাহিত্য সেভাবেই নির্মিত। ফলে তা একটি ব্যতিক্রমী গঠন। সাহিত্যের জাদুও এখানেই। ইসমাইল কাদারে মনে করেন, সাহিত্যের উদ্ভবভূমি তথা সৃষ্টি-প্রেক্ষাপটই সেখানকার মানুষকে চেনায়। ফলে একটা দেশ বা দেশের মানুষকে চেনাটা সহজাতভাবেই ঘটে। তবে এটিও নাকি সাহিত্যের লক্ষ্য নয়। এর জ্বাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত প্রাচীন ট্রয় নগরী। নগরটি ধ্বংসের সময় গ্রিকদের লক্ষ্য ছিল—এর সমস্ত স্মৃতি, এমনকি নাম পর্যন্ত মুছে দেওয়া। অথচ কালে ঠিক বিপরীত ঘটেছে। “সাহিত্যের কারণে তিন হাজার বছর পরও ট্রয় টিকে আছে। আর গোটা মানবজাতির স্মৃতিকে অম্লান করে রেখেছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রয়ের ঘটনাটিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম কূটাভাষ বলা যেতে পারে।” (ইসমাইল কাদারে)
পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ সময়েও উৎকৃষ্ট সাহিত্য তৈরি হতে পারে। আর নির্মম শাসকের অধীনেও তৈরি হতে পারে উচ্চমানের সাহিত্য। তবে সতর্কবার্তা হচ্ছে—নিয়ন্ত্রণ-প্রবণ শাসকরা সাহিত্যকেও ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু যে-সাহিত্য অরাজক ও স্বৈরাচারী শাসকের পক্ষে কথা বলে তা হয়ে যায় ক্লিশে। কালে মানুষ তাকে আবর্জনায় ছুঁড়ে দেয়। কাদারের নিজের বক্তব্যে, “সম্মানের কথা যদি বলি, সাহিত্য নিজেকেই সম্মানিত করে। আর লেখক কোনো জাদুকর নন। মোড় নেওয়া রাষ্ট্রের ঘাটতিগুলো তিনি পূরণ করতে পারবেন না।” তিনি আরো মনে করেন,
কোনো লেখকই নিজের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি করেন না। কেউই না। সেই আদি থেকেই, এটি সৃষ্টি করা হচ্ছে সব মানুষের জন্য। ইংল্যান্ড চাইলেও শেক্সপিয়ারকে নিজের করে রাখতে পারবে না। তিনি আমাদের সবার। কেবল নিজেদের জন্য সাহিত্য সৃজন করা যায়, পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষের মানচিত্র নেই। এটা সম্ভব নয়।
বস্তুত এভাবেই ইসমাইল কাদারে তার চিন্তার মধ্য দিয়ে পাঠককে সজাগ করে তোলেন। তার সাহিত্যপাঠে ঘুমিয়ে পড়া ঝিমিয়ে পড়া পাঠকরাও সুষুপ্তি থেকে জেগে ওঠে। সহজাত মানবিক গুণগুলোকে সঙ্গে করেই তিনি রচনা করেন সাহিত্যের অনন্য শৈলী। মানুষের কণ্ঠস্বর আপনি বেজে ওঠে সেখানে। তাদের মুক্তির শ্বেতপত্র রচনা করেন তিনি। উপহার দেন এক তাপিত বিশ্বের উপলব্ধি, অথচ তা শিল্পের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রয়োজনকেও মেটায়। সাহিত্যে সেন্সরশিপের তোয়াক্কা না-করা ইসমাইল কাদারে একজন সত্যিকারের অনুসরণযোগ্য শিল্পী।
খোরশেদ আলম, শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ওয়েব-সংযোগ: https://khorsed-alam.blogspot.com/
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন