পুবাকাশ পত্রিকায় প্রকাশিত। লিঙ্ক : জাল স্বপ্ন—খোরশেদ আলম
পরিসর বড় না হলেও বেশ পরিপাটি গোছানো ঘর। চকচকে টাইল্স করা মেঝেতে একটু দাগও পড়ে নেই। রান্না ঘরে জিনিসপত্র বেশি নেই। তবে যা আছে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। দু রুমের ছোট্ট বাসাটায় রয়েছে একসেট বসার উপযোগী সোফাও। বোঝার উপায় নেই–জীবন-তরী তীব্র স্রোতের নদীতে।
এ-বেলা হাসি তো অন্যবেলা কান্নার উত্তাপ। এ-বেলা স্বপ্নের জাল, তো অন্যবেলা বোনাজাল ছিড়ে যাওয়ার দীর্ঘশ্বাস। তবুও তাদের কল্পনা ভেসে যায় অনন্ত আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে। অবিরাম পথ হাঁটা দূর-অতীত স্বপ্নকে ধরবে বলে।
রবিন আর সায়মার সংসার। বিয়ের প্রায় ১৩ বছর পেরিয়ে। রবিন বলে, আনলাকি থার্টিন। কিন্তু একে অপরকে সাধ্যের বাইরেই উইশ করে। ও’ হেনরির ‘গিফট অব দ্য মেজাই’ গল্পের জিম আর ডেলার মতো আজও তারা উপহার দেয়। তখন তাদের আনন্দ আকাশ স্পর্শ করে। ক্ষণেকের আনন্দ-হাসি, ক্ষণেকেই আবার কখন উবে যায়। তারা টেরও পায় না হাসির জীবনটাতে ঠিক কখন বৈশাখের আকাশের মতো অন্ধকার নামে।
স্বপ্নের দুয়ারে বারবার উঁকি দিয়ে তারা জীবন জাগিয়ে রাখে। নুন আনতে পানতা ফুরোয়। লুকিয়ে রাখতে চাইলেও জনসম্মুখে ধরা পড়ে। কিন্তু তারা হারবার পাত্র নয়। জীবনটাকে মিথ্যের ফুলঝুরি দিয়ে সাজাতে তাই ব্যস্ত হয়। যে-করেই হোক জিততে হবে এ-লড়াইয়ে। কোনো প্রতিপক্ষ নেই, তবু যেন লড়াইটা ভীষণ। আত্মীয়-পরিজন সবাই পরিত্যাগ করেছে। সবাই এড়িয়ে চলে, তাতে কি?
রবিন ভাবে, আজ প্রতিষ্ঠিত হলে এমন হতো না। সবাই তাকে তোয়াজ করেই চলতো। যখন তার পকেট-ভরা পয়সা ছিল, তখন সমাদর ছিল। কোনো এক বড় ভাইয়ের হাত ধরে একসময় রাজনীতি করতো। সেই সুবাদে ছোটখাটো ঠিকাদারি করে অল্পবয়সে পকেটটা গরম থাকতো। সেই গরম পকেট দ্রুত হালকাও হতো। প্রায়ই প্রেমিকার জন্য জম্পেস খরচ করতো। ক্যাম্পাসে এসে সায়মার সঙ্গে ঘোরাঘুরি, সায়মার বন্ধুকৃত্যে এন্তার ব্যয়। তাতেও তার আনন্দ কম ছিল না। আর হবু শ্বশুর বাড়িতেও মণ্ডা-মিঠাই কম যায় নাই। ওরা যে আগে থেকেই আত্মীয়– ঠিক এজন্যই।
বিয়ের পর থেকেই বাসায় আত্মীয়-স্বজন বড় আসে না। শেষবার মা বড়বোন আর ছোটভাই এসে কয়েকদিন থাকে। সায়মা ও রবিন তাদের সাধ্যের বাইরেই ব্যয় করে আপ্যায়ন করে। কারণ—দেখাতে হবে, তারা ভাল আছে। এটা তারা প্রায় সবার সঙ্গেই করে। এই ভাল থাকার অভিনয়টা নেশায় পরিণত হয়েছে। যাবার সময় সবার জন্য কেনাকাটাও করে দেয়।
অন্যদিকে পরিচিতজন সবার কাছেই তারা ধারকর্য করে চলে। এর কাছে টাকা নিয়ে ওর কাছে পরিশোধ করে। আবার হয়তো আরেকজনের কাছ থেকে নিয়ে ভিন্ন একজনের টাকা পরিশোধ করে। কিন্তু ঋণ তাদেরকে ছাড়ে না। ঋণ শোধ করতে গিয়ে আরো ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। তবুও মানুষকে দেখাতে হবে সায়মা-রবিন মন্দ নেই।
কখনো তাদের অবস্থা সঙ্গীন হয়, কখনো রঙিন। কখনো একহালি ডিম কেনার টাকায়ও টান পড়ে। দোকান থেকে দুটো মাত্র ডিম পলিথিনে সন্তর্পণেই পেচিয়ে নেয় রবিন। আজকের মতো একবেলার খাবারটা সামাল দেয়া গেল, এই স্বস্তি।এদিকে মাঝেমধ্যে টাকা হাতে এলেই বউ-বাচ্চা নিয়ে রেস্টুরেন্টে পয়সা ঢালে। তখন গ্রিল আর নানের সুবাসে বাতাস ভারি। মেয়োনেজের সঙ্গে দু একটুকরো নান পাশের বাসায়ও যায়।
সরকারি বড় অফিসারের মেয়ে সায়মা। আজ অসহায়ত্বের দোষ দেবে কাকে? পালিয়ে বিয়ে করেছে। যখন একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষে পড়ে তখনই কাজিনের সঙ্গে ভেগে বিয়ে। কিছু করার ছিল না। বাবা-মা পাত্র দেখছিলেন, ঠিকও করেছিলেন আমেরিকা-প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার পাত্র। কিন্তু সায়মা তো রবিনকেই ভালবাসে। সায়মার প্রায় সমবয়সী রবিন তখন পাসকোর্সে বি.এ ক্লাসের ছাত্র। পরে কী হবে সে-চিন্তা ভবিষ্যতের কাছেই সমর্পিত দুজনের। চোখে রঙিন স্বপ্ন, জীবনের নতুন আশা।
অদ্ভূত বুক ভরা স্বপ্নতরীতে নৌকা ভাসাতে তাদের কোনো বাধা নেই। কেরানিগঞ্জে একটা জমির খোঁজ আছে। কেউ একজন মামলায় পড়েছে জমির মালিকানা নিয়ে। রবিনের চাচা সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাডভোকেট। রবিন তার চাচার কাছে ধর্না দিয়ে সেই জমির কেসটা হাতে নেয়।
রবিন– “বুঝলেন ভাই, জমিটার মামলা জিতবই। জিতলে জমির অর্ধেকটা আমার। জানেন তো শহরের জমি, পাইলে বাজিমাৎ। অন্তত কোটি টাকার মালিক আমি। বুঝলেন, হাতটা হইল গিয়া আমার বড়। সারাজীবন হাত খুইল্যা খরচ করছি ত।”
সায়মা স্বপ্ন দেখে, তখন আর আমাদের পায় কে? দেখিয়ে দেবো না সবাইকে! মা আমাকে এখনও বিশ্বাস করে না। আমাকে ভালোবাসে না। আমার বোনের বাচ্চা হলো, তার কাছে মাসের পর মাস থাকলো। অথচ আমি কী অবস্থায় আছি একবার চিন্তাও করে না। আমার বোনের তো লাখ টাকার চাকরি। ওর হাজব্যান্ডও উচ্চবেতনের চাকুরে। অথচ আমি, আমার দুটো ছেলেমেয়ে। ওরাই আমার সব। আমরা কেমন আছি সেটা বড় না, ওদের মুখে যেন হাসি থাকে সেই চেষ্টা করি। আমার আম্মা পেনশনের টাকা তোলে। একবারও তার নাতি-নাতনি দুটোর কথা ভাবে না। অথচ বড় আপার জন্যে মা কী না করে?
সায়মার পরিবারের মা, ভাই ও বড় বোন সালমা যেবার বেড়াতে আসে, মায়ের সাথে নানাগল্পে সায়মা জানিয়ে দেয়– তারা কত ভাল আছে। বোনকে বলে–“জানিস মফস্বলে আছি তাতে কি? এখানে তো আমি ঢাকার জিনিস সবই পাই। আর কুরিয়ারে সব আসে। ঢাকা বেকারির ভাল কেক-বিস্কুট থেকে শুরু করে জামাকাপড় কী পাই না বল? আমার বাসাটা ছোট। কিন্তু ছোট বাসাই আমার মেনটেনের সুবিধা। তাছাড়া বাসাটার সামনে এক টুকরা মাঠ। বাচ্চারা খেলতে পারে। ঢাকা শহরে তো বাসা ভাড়া নিতে পারি। কিন্তু বাচ্চারা খেলবে কোথায় বল? আর এই মফস্বলে এত্ত সুন্দর বাসা।”
সালমা কোনো কথারই উত্তর দেয় না, শুধু শুনে যায়।
সালমারা চলে যায়। চলে গেলে বলে,“বুঝলেন ভাবি, ওর ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। গাড়ি করে অফিস যায়, বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনা নেওয়া করে। ওর পক্ষে জানেন ভাবি, সবই সম্ভব। কিন্তু তাতে কি? আমার ছেলেমেয়েকে আমি নিজ হাতে সব বানিয়ে খাওয়াতে পারি। কিন্তু বোঝেন, সালমা অসুস্থ। ওর তো কোমরে ব্যথা। ওর টাকা থাকলেই কি? ওকি বাচ্চার যত্ন নিতে পারে? অথচ দেখেন কিন্ডারগার্টেনে সামান্য যা পাই তা দিয়ে আর টিউশানি করে আল্লা ভালই চালাচ্ছে। ছেলেটার মেধা ভাল, আমার মেয়েটাও মাশাআল্লা দেখতে…।রুনার বাপ কিছু করে না। বোঝেন তো, আব্বা ছিল বড় অফিসার। এই এলাকার সবাই জানে। তার মেয়ে জামাই হয়ে এখানে ছোট চাকরি কীভাবে করবে? আর ব্যবসা করতেও অনেক পুঁজি লাগে। ছোটখাট স্টেশনারি দোকান দিয়ে রবিন বসতে চায়। কিন্তু আমার একটা মান-সম্মান আছে না? বলেন তো ভাবি!”
রবিন কতবার ভেবেছে কিছু একটা করবে। এভাবে ঘরে বসে বসে থাকা আর কতদিন?
রবিন– “দেখেন না আপনার ভাবি আমাকে কিছু করতে দেয় না। আরে আমি ছোটখাটো ব্যবসা করলে নাকি তার মান-সম্মান যায়। এভাবে একটা মানষের চলে, বলেন? আমার চা-সিগেরেটের হাত খরচের টাকাও বউয়ের কাছে চাইতে হয়। আর আমার ছোটভাই একটা বাঞ্চোৎ, বুঝলেন? ওর বউটাও অর মতোই। অথচ অর পা ভাঙলো, আব্বা এখন অক্ষম কিন্তু তখন তার হাতে টাকা ছিল। সংসার থেইক্যা অর জন্যে মিনিমাম ২০ লক্ষ টাকা খর্চা করা হইছে। সিঙ্গাপুর নিয়া অর পা ঠিক করা হইল। আর অখন আমার দুর্দিনে চোক্ষেও দ্যাখে না। আমার বাপে বাড়িতে এক্কেবারে একা। যাই হোক ভাই, আল্লায় চালাইতেছে, একদিন উনিই মুখ ফির্যা চাইবেন। বুঝলেন তো, ঐ কেরানিগঞ্জের জমিটা লইয়া পার্টির সাথে দ্যানদরবার চলতাছে। আশাকরি শীঘ্রই একটা ফল আসবো।”
সায়মা– “বুচ্চ জরিনা, রুনার আব্বু বললো, আমরা এই খালি কয়েকটা মাস…। ঢাকায় বাসা দেখছি, উইঠ্যা যাব শিগগিরই। আমারও একটা একটা ভাল চাকরি হবে। কথা হইয়া আছে। গাড়িও তো লাগবো। তাই একটা গ্যারেজও অগ্রিম ম্যানেজ কইরা ফেলছি প্রায়।”
বুয়াদের কাছে এ-ধরনের কথা বললে সাধারণত তা বাতাসের আগে উড়ে বেড়ায়।
জরিনা যাওয়ার সময় বলে, “আফা, আমার কামের ট্যাহাটা?”
জরিনা পাশের বাসায়ও কাজ করে। সেখানে বলে, “আফায় জানি কেমুন? কাম করতাছি, বেতনডা অহনও দিলো না। দুইডা মাস হইলো। কাম আর করাইবো না। জানেন, খালি ঘুরায়। আমার ছোট মাইয়া হ্যার স্কুলেই পড়ে। ট্যাহাটা চাইবার গেলাম, পলায়া থাহে।”
সায়মা– “বুঝলেন, ভাবি, কাজের লোক খালি ঝামেলা। আমার ছোট সংসার। নিজের কাজটা নিজেই না হয় করলাম, কি বলেন? ভাবি, আপনার কাছে কি কিছু টাকা হবে? রুনার আব্বা দেশের বাড়ি গেছে। কিছু টাকা পাবে। ও এখন রাস্তায়। এলেই দিয়ে দেবো। এই তো কাল দুপুরেই দিয়ে দেবো। বিকেলে দিলে হবে না ভাবি?”
রবিন বাড়ি থেকে ফিরে আসে সাত-সকালেই। এসেই বলে, “চলো, রুনার মা, মার্কেটে যাই। এই আম্মু, তোমার কী লাগবে? আব্বু তোমার?”
রুনার মা সায়মার চোখ চকচক করে, ইস্ কত্তদিন… শপিংয়ে যাই না!
মার্কেট থেকে নতুন মোবাইল সেট কেনে সায়মা। তারই জমানো টাকা। ডাবল জামা বাচ্চাদের কিনে দেয়, নিজেরাও কেনে।
সায়মা–“বুঝলেন ভাবি, সবসময় তো পারি না। ওদের মুখে হাসি দেখলেও ভাল লাগে।”
‘এই যে ভাই’, রবিন পাশ থেকে। আজকে আমার জন্মদিন বুঝলেন। মোবাইলটা আপনার ভাবি গিফট করলো। এত্ত করে কইলাম, আরে লাগবো না। মন তো!
ওপাশ থেকে সায়মা, “দ্যাখেন তো ভাই, একটা কিছু দিতে তো মন চায়। আমি তো না বলে জমায়া রাখছি। ভাবিকে নিয়ে আজ বিকেলে একটু আসেন না ভাই।” সঙ্গে রবিনও বলে, “হ্যাঁ ভাই, একসঙ্গে একটু গল্পসল্প চা-চক্র আরকি, হাহাহাহা।”
সায়মা মাঝে মধ্যে পাশের বাসাটায় আসে। ওই বাসার ভাবির সঙ্গে গল্পগুজব করে। দেখে, ভাবির বাসায় নতুন কী কেনা হলো, কী রান্না হলো। রাজ্যের আলাপ, সুখ-দুঃখের ফিরিস্তি তো আছেই।
রবিনের সঙ্গেও পাশের বাসার ভাইয়ের দেখা হয়। কথা হয় নানা বিষয়ে; পরিবারিক যেমন আলাপ থাকে মানুষের।
এরমধ্যেই তারা হঠাৎ একদিন একটা মাইক্রোওভেন কেনে। সেদিন তাদের উচ্ছ্বাসটাই হয় দেখার মতো।
সায়মা– “বুঝলেন, ভাবি, বাচ্চারা এটা-ওটা খাইতে চায়। দেখি বাসায় গ্রিল করতে পারি কিনা।” রাত্রে অবশ্য পাশের বাসায়ও যায় নানের সঙ্গে একটুকরো গ্রিল।
মাঝখানে আবার টানাটানি। এরপর আবার হয়তো একদিন কোথাও কিছু টাকা পেয়ে ধুমচে কেনাকাটা। বাসায় ফেরে তারা। কিছুক্ষণ পরেই নিচে এক মহিলাকে দেখা যায়। রাস্তা থেকে অনুসরণ করেছে। নিচে এসে সে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। তারপর না পেরে নিচ থেকে চিৎকার করে–
“রুনার মা, বাসায় আছেন? এই যে ফোন কইরা যাইতেছি তো যাইতেছি। ফোন ধরেন না ক্যান? সেই কখন থেইক্যা আপনারে খুঁজতেছি। আমার টাকাটা দিবেন না, খুব দরকার আজ?”
–“আরে, দেবো না! তা কি বলেছি? আজ একটু সমস্যা।” সায়মা নিচে নেমে আসে। বলে, “এই যে অল্প কিছু, নেন প্লিজ।” কথাটা পাওনাদার মহিলার কাছে নতুন নয়।
এ-বাসা ও-বাসা নানাজনই তাদের কাছে টাকা পায়। বাজারে দোকানিদের কাছেও পয়সা বাকি। ‘আপা, ট্যাকাটা দিলেন না?’ মুদি কি সবজি দোকান সব জায়গা থেকেই পাওনাদারের হাক আসে। বাজারে যেন পথচলার উপায় নেই। আবার স্থানীয় কিন্ডারগার্টেনের আপা বলে অনেকে মুখে মুখে খাতির করলেও মনে মনে চরম বিরক্ত। কারো কারো বাচ্চা ঐ-স্কুলেই পড়ে, তাই মুখের ওপর কিছু বলাও যায় না।
সায়মা পাশের বাসায় গল্প করে,“আর বইলেন না ভাবি, মাসে কমপক্ষে ২/৩টা করে দাওয়াত। কোনো দাওয়াত মিস করি না জানেন। গার্ডিয়ানরাও দাওয়াত করে। বুঝলেন তো অনেক সম্মান করে। কথা ফেলতে পারি না। এখানেই তো থাকি। ওরাই তো সব।”
এদিকে রবিনের মনটা খারাপ। মুখের দিকে তাকানো যায় না। একটু আগেই বাসার ভেতরে যে কালবৈশাখী হয়েছে তারই ছাপ চোখেমুখে।
রবিন– “আর ভাই, এলাকায় আমাদের তো বড়বাড়ি, বুঝলেন। লোকে কয় মিঞাবাড়ি। ডাক দিলেই গুষ্ঠির সব ভাইঙ্গা পড়বো। আমার দাদার হাতে এখনো সব সম্পত্তি, ভাগ কইরা দেয় নাই। বাইচ্যা আছে তো, এইটাই বড় কথা। জমির দাম লাখ লাখ ট্যাকা। বুঝলেন, যৌথ এখনো, সবাই তো একসঙ্গে আছে। ঈদে-চান্দে এক জায়গায় হই সবাই। ভাই ব্রাদাররা একসঙ্গে হইলে বাড়িতেই প্যান্ডেল খাটাইয়া পিকনিক হয়। ঈদের সময় একবার প্রাইভেট কার ভাড়া কইর্যা গেলাম। বুঝলেন না, সবাই জানে ঢাকায় থাকি! আল্লায় দিলে খারাপ কি! আব্বায় একটা ভাতা পায়। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। উনি তো দৌঁড়াতে পারে না। আমিই সব কাগজপাতি ব্যবস্থা কইর্যা দিছি। টাকাটা আব্বা আমারেই দেয়। বাড়ির জমিজমা থাইক্যা যা হয় আব্বার চইল্যা যায়।
আরেকদিন রবিন তার বাড়ির গল্প শোনায়–“বুঝলেন, আমরা পাপী। মা তো মরছে সেই ছোটবেলা। আমগো বউদের জন্যে বাপের সেবা করতে পারলাম না। তারা গ্রামে গিয়া থাকবো না। আমি এইখানে বেকার পইড়্যা আছি। আমার ছোটভাইয়ের বউয়ের লগে আপনার ভাবির মন কষাকষি। আমার বুড়া বাপের দায়িত্ব কেউ নিবো না। একজন আরেকজনরে ঠ্যালে। পোলা-মাইয়া মানুষ হোক। তয় একদিন আমার যাওয়া লাগবে।যামু, আমার শরীর যেদিন চলবো না,ঠিক সেইদিন, বুঝলেন?”
সায়মা প্রায়ই পাশের বাসায় এটা-সেটা চাইতে যায়। রান্নায় কমতি হলে একমুঠ কাঁচা মরিচ, একটু লবন, কি একটা ডিম ইত্যাদি। এসবই অফেরৎযোগ্য। বর্ষা হলে ছাতাটাও। ছাতাটা ফেরৎ পেতে চেয়ে নিতে হয়।
রবিন– “ভাই জমিটা প্রায় হইয়াই গ্যাছে। মাগার পাট্টি ছাড়তে চাইতাছে না। অ্যাডভোকেট চাচায় দায়িত্ব নিছে, কইছি না আপনারে? ছেলেটারে ক্যাডেট কোচিং করাইতেছি। ছেলেটা মানুষ হইলে আর কি? অরাই তো আমার সব। দেখছেন না, মেয়েটাও আমার মাশাল্লা লক্ষ্মী।”
এদিকে বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়ায়। প্রায়ই রবিনের ভাড়া বকেয়া হতো। বাড়িওয়ালা সমস্যার কথা মেনে নিয়েছে বহুবার। এবার কয়েকমাসের ভাড়া বাকি।
সায়মা বাড়িওয়ালাকে বলে, “ভাই, প্লিজ, আমি আগের ভাড়াটাই দিই। বাড়তি ভাড়া দেবো কোত্থেকে বলেন? জানেন তো সবই।”
বাড়িওয়ালা বলে, “আপনারা এই ভাড়ায় থাকলে থাকবেন, না পারলে চইল্যা যাবেন। আমি তো জোর করি নাই।”
এরমধ্যে একটা বাসা ঠিক করে ফেলে রবিন। পাশের ভাড়াটিয়াকে ডেকে বলে,“দুনিয়ায় বাড়ির অভাব আছে? একটা বাসা দেইখ্যা আসলাম। ভাড়া এর চাইতে দুই হাজার কম। বাসা ভালোই। ছেলের রুমটা একটু ছোট। খাট তো ছিল না, ওর লাইগ্যা একটা ছোট খাট বানামু ঠিক করছি। সোফাগুলাও চাপাইয়া রাখা যাইবো ডায়নিং-এর পাশে আরকি। আর ভাই, মান-সম্মানটা বড় জিনিস, বুঝলেন।”
রবিন-সায়মারা অবশ্য শোনেনি, বাড়িওয়ালা অন্য ভাড়াটিয়াকে বলছে–“বাড়তি ভাড়া তো বিষয় না। আশপাশে ম্যালা অভিযোগ। পরিবেশ নষ্ট হইতেছে।”
এদিকে রবিন পাশে থাকা প্রতিবেশির সঙ্গে কথা বলছে– বুঝলেন, বাড়িঅলা কিন্তু রিয়্যালি ভালো মানুষ। হ্যার বোনজামাইটা হইল গিয়া কুটনার এক শ্যাষ। হালার পুতেই কথা লাগাইছে। আমগো মতোন লোক পাইতে সময় লাগবো। আর দেইখেন, এই বাসা খালি থাহে কত্তদিন !
খোরশেদ আলম : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক; অন্তর্জাল : https://khorsed-alam.blogspot.com/
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন