ওকড়াবাড়ির অষ্টুমির মেলা

ওকড়াবাড়ি নামটা হয়তোবা অদ্ভূত শোনাবে অনেকের কাছে। আমরা যারা ওই এলাকার মানুষ তাদের কাছে অবশ্য অদ্ভূত নয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা গাইবান্ধা। সেখানকার ভাষায় চোরকাঁটার স্থানীয় নাম ওকড়া। অনেকদিন মাঠ অব্যবহৃত থাকলে কিংবা খেলাধূলা না করলে চোরকাঁটা জন্মায়। সকলের চোখের সামনে, তবে অমনোযোগেই বড় হয়ে ওঠে এই চোরকাঁটা। একফুটের বেশি লম্বা হয় না এগুলো। যেখানে জন্মে তার ওপর দিয়ে হেঁটে গেলে কাপড়ে বিঁধে যায়। মাঠ দিয়ে হেঁটে গেলে এই ওকড়া বা চোরকাঁটার দৌরাত্ম্য টের পাওয়া যায়। আস্তে আস্তে খুঁটে খুঁটে তুলতে হয় প্যান্ট কিংবা পাজামা থেকে। 

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে আনুমানিক দশ কিলোমিটার দূরে ওকড়াবাড়ির মাঠ। এখন এটি মূলত স্কুল মাঠ। ছাত্র-ছাত্রী ও এলাকাবাসীর ভিড়ে চোরকাঁটাগুলো চিরে-চ্যাপ্টা হলেও, ওকড়াবাড়ি নামটি জাগ্রত হয় প্রতিবারের মেলায়। বর্তমানে চোরকাঁটার অস্তিত্ব খুব বেশি না থাকলে কি! অষ্টুমির মেলায় ওকড়াবাড়ি তার পূর্বনাম ফিরে পায়। কবে কখন এই মাঠটির নাম ওকড়াবাড়ি হয়েছে তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্কুল ঘর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে সারাবছর পড়েই থাকতো এই মাঠ। কাজেই বছরব্যাপী নির্বিঘ্নে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেত চোরকাঁটাগুলো। তারপর মেলার দিন এলে সাফ সুতরো করে পরিষ্কার করা হতো।

বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করে মেলা বসতো ওকড়াবাড়ির মাঠে, আজও বসে। ওকড়াবাড়ি নামটিকে ঘিরে মনে আসে পুরনো আমেজ। ওকড়া ছাড়াও ধুতুরা ভাঁটফুল কলমিসহ নানা লতাপাতা গজিয়ে উঠতো এ মাঠে। আশেপাশের গাছগাছালি তাদের স্বাভাবিক সৌন্দর্যের মহিমা ঘোষণা করতো স্বর্ণলতা বা পরগাছাসমেত। মেঠো রাস্তাগুলো গিয়ে মিলতো ওকড়াবাড়ির মাঠটিতে। এখন যেটি পাকা রাস্তা, তা ওকড়াবাড়ির মাঠ থেকে খানিক দূরত্বে গিয়ে কাঁচা রাস্তার মাথায় মিলেছে। রাস্তাটি যখন কাঁচা ছিল তখন দূর-দূরান্তের মানুষ মেলায় পায়ে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে আসতো। কখনও রিক্সা ভ্যান বা গরুর গাড়িও চলতো। এখন এসব নস্টালজিয়া। মেলা বসে আগের মতোই, তবে সেদিনের কাঁচা ঔজ্জ্বল্য যেন নেই। 

এই ওকড়াবাড়ির মেলা এখনো স্বপ্নের মতো চোখে ভাসে। পুরনো দিনগুলো ফিরে ফিরে পাই। অনির্বচনীয় আনন্দে মনে কী যে এক অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তা প্রকাশের ভাষা নেই। ভোরের আলো না ফুটতেই আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তাটি দিয়ে ভারের ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে মেলার দোকানিরা চলে যেতো। তাদের নিজেদের ঘাড়ের ওপর রাখা বাঁশের ভার, তার দুই দিকে থাকতো পণ্যের পসরা। বাঁশের মাথার দুই দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়া ঝাঁকা বা টুকরিগুলোতে ঝনঝন শব্দ হতো। কখনো গরুর গাড়িতে মাল-সামানা যেতো। কাঠের চাকার ঘর্ষণে শব্দ হতো ক্যাচর ক্যাচর। সেই শব্দে আমরা সহসাই বাড়ির বাইরে বের হয়ে সচকিত হয়ে তাকাতাম। বিশেষত মনে পড়ে রঙ-বেরঙের হাঁড়ি-কুড়িগুলোর কথা। মাটির পাতিলের ভার সাজিয়ে কুমোররা চলছে মেলা অভিমুখে। সেই হাঁড়িগুলো সাদা-গোলাপি-হলুদ-লাল কতো রকম রঙে অঙ্কন করা। বাইরের সাদা ও লালের দাগগুলো নানা আঁকাবাঁকা রেখায় টানা অপূর্ব চিত্রকর্ম। মেলায় ওগুলোর প্রয়োগও বিচিত্র। নানা রকমের পণ্যসামগ্রী কিনে হাঁড়িগুলোতে ভরে গ্রামের মানুষ ছোট কি বড় সকলেই হেঁটে হেঁটে দল বেঁধে বাড়ি ফিরতো। হাঁড়িগুলোর মুখের দিকে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি ডাঁটা তৈরি করা হতো, যাতে সেগুলো ধরতে সহজ হয়। এর আরেক নাম সাজের ডোগা’।

মেলার বিশেষ আকর্ষণ ওই রঙ-বেরঙের সাজের ডোগা’য় করে সাজ, বাতাসা, লাড্ডু, খোরমা, চ্যাংটা, কটকটি, কানমুচড়ি, গুড়ে মাখা জোয়ারের খই, জিলাপি ইত্যাদি নিয়ে বাড়িতে ফিরতাম। সারি সারি দোকানগুলোর বেশিরভাগই হরেক রকমের খাদ্যদ্রব্যে ভরপুর থাকতো, আজও থাকে। সকালের দিকে লোকজন কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেলায় ভিড় বাড়তে থাকে। সাজ-বাতাসা-লাড্ডু-খোরমা বেঁচতে বেঁচতে দোকানিদের যেন ক্লান্তি নেই। বেশুমার বেচাবিক্রি, তাদের হাত চলছে একবার দাঁড়িপাল্লার হাতায়, আরেকবার ব্যাগ কিংবা হাঁড়ির মুখে। গুড় ও চিনি দিয়ে তৈরি করা হাতি-ঘোড়া-সেনাপতি-রাজা নানা প্রতিকৃতিতে গড়া সাজ; যেন শোকেসে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শোকেসে কে আর সাজিয়ে রাখে? হাঁড়িগুলো ঘরের বিশেষ স্থানে রেখে কয়েকদিন ধরে হাতি-ঘোড়া-মন্ত্রী-রাজা-সেনাপতির লেজ-কান-মাথা-ঠ্যাং কামড়িয়ে কামড়িয়ে খাওয়া চলতো। এছাড়া মাটির তৈরি রঙ-বেরঙের হাতি-ঘোড়া-বাঘ-ভালুক কিনে আমরা বাড়িতে ফিরতাম। মাটি দিয়ে তৈরি করা ছবিগুলোতে মিলতো গ্রামের কারুশিল্পীদের হাতের ছাপ। দেখতে খুব মিহি সুন্দর না হলেও কালী, সরস্বতী, কৃষ্ণ-রাধা, বাবা লোকনাথ,  শ্রী শ্রী অনুকূল ঠাকুরের ছবি আঁকা সেখানে। 

কিশোর বয়সীদের অন্যরকম আকর্ষণ ছিল ঘুড়ি উড়ানো, নজর বন্ধ বা যাদু খেলা ও  মেয়েদের লেচ ফিতা, রেশমি চুড়ি পাবার জন্য রিং খেলা। বিকেল হতেই মেলার মাঠের ধূলা পায়ে পায়ে ধূসর করে তুলতো মেলার পরিবেশ। হাজার মানুষের চলা পথগুলোও ধুলো উড়িয়ে জানান দেয় মেলার অস্তিত্ব। সেই ধুলোমাখা রাস্তা দিয়ে বাচ্চাদের দল প্যাঁ-পোঁ শব্দে বাঁশি বাজিয়ে চলে যায়।

নলখাগড়া দিয়ে বানানো বাঁশি। একটি বড় নলের মধ্যে ছোট নল, তার ওপরে ছুরি দিয়ে চেঁছে বাঁশি বানানো। কখনো নলের মাথায় ফু দিয়ে রঙিন বেলুন ফুলিয়ে বাঁশি বাজানো হতো। অবশ্য সে স্থান দখল করেছে এখন প্লাস্টিকের বাঁশি। তাছাড়া ঢং ঢং করে বেজে চলা মাটির চাকার টমটম গাড়ি সাড়ম্বরে আওয়াজ দিতো মেলা থেকে ফিরতি পথের। তারপর আবার বাড়িতে নিয়ে এসে প্রতিযোগিতা করে খেলা চলতো। যতক্ষণ ভেঙে গুড়িয়ে না যায়, ততক্ষণ চলতো সারবেঁধে চলা টমটমের বিশেষ টংটং আওয়াজ। এই টমটম শহরের মেলায় খুঁজে না পাওয়া গেলেও গ্রামের মেলায় সেই আগের মতোই পাওয়া যায়।

অর্ধ গোলাকৃতির মাটির বাটির ওপরে এক ধরনের রঙিন কাগজ বসিয়ে তৈরি করা হয় ঢোলের মতো একটা গড়ন। ঢোলাকৃতির বাটিটি বসোনো হয় মাটির চাকাওয়ালা বাঁশের ফ্রেমের ওপর। তারপর সামনে ঝুলানো দড়িটা টানলেই দুটো চিকন বাঁশের কাঠি দমাদম পড়ে রঙিন কাগজ মোড়া মাটির বাটির ওপর। টং টং করে বাজতে বাজতে চলবে গাড়ি। নিরবচ্ছিন্ন ফূর্তিতে বেশ কদিন চালাবে বাচ্চারা অন্তত মাটির চাকা আর সংযোগ কাঠিটা না ভাঙা পর্যন্ত।

মেলাটার নাম অষ্টুমি কেন? অষ্টুমিতে গঙ্গাস্নান হয় বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে। নারায়ণগঞ্জ লাঙ্গলবন্দ এলাকার অষ্টুমি স্নানের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বিভিন্ন স্থানে স্নানোৎসব ও মেলা বসে। পুরাণ মতে, হিন্দু দেবতা পরশুরাম হিমালয়ের মানস সরোবরে স্নান করে পাপমুক্ত হন। লাঙ্গল দিয়ে চষে হিমালয় থেকে এ পানিকে ব্রহ্মপুত্র নদরূপে নামিয়ে আনেন সমভূমিতে। পৌরাণিক এই কাহিনি স্মরণ করে প্রতি বছর নির্ধারিত দিনে লাখ লাখ তীর্থযাত্রী পুণ্য লাভের আশায় জড়ো হন নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদে। দিন তিথি ক্ষণের ওপর নির্ভর করে এই মেলা বসে সাধারণত বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহে।

এদিকে গাইবান্ধা জেলার দুটো পয়েন্টে পুণ্যস্নান হয়। কামারজানী নদীবন্দরের ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এবং জেলাশহরের অদূরে বালাসী ঘাট যমুনা নদীর পাড়ে। পুণ্যস্নানের সঙ্গে মেলাও বসে। এছাড়া কুড়িগ্রামের চিলমারি থানায় স্থানীয় ব্রহ্মপুত্র নদীতে পুণ্যার্থীরা স্নান করে পরিশুদ্ধির আশায়। 

আমাদের এলাকায় বৈশাখ মাসের ওকড়াবাড়ি মেলা বসে ওই পুণ্যস্নানকে স্মরণ করেই। এর মূল জায়গা দারিয়াপুরের পশ্চিমে হাট লক্ষ্মীপুরের রাস্তায় মালিবাড়ী নামক স্থানে। এই ওকড়াবাড়ির মেলা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা বাসা বাঁধতো আমাদের শিশুকিশোর মনে। মেলা শুরুর বেশ কদিন আগে থেকেই নানা রকম হৈচৈ আর কথার তুবড়ি ছুটতো। একসঙ্গে দলবেঁধে ভীষণ আনন্দে মেলায় যাওয়ার প্রস্তুতি চলতো। সাত সকালে জামা কাপড় গায়ে চড়িয়ে মেলার উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হতাম। বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাঁচ দশ কিংবা বিশ টাকা চেয়ে নিতাম। আগে থেকেও কিছু কিছু পয়সা জমানো চলতো। আজ থেকে ত্রিশ/পয়ত্রিশ বছর আগে এই টাকা সামান্য নয়। কেনাকাটা যা হতো তা দিয়ে সবাইকে বিলানো যেতো। সেটাও ছিল একটা রীতি ও পরম আনন্দের ব্যাপার। বাড়ির সকলে তার ভাগ পেতো। পাশের বাড়ির মানুষরাও বাদ পড়তো না। অন্তত একটু খই-মুড়ি-বাতাসা তো বটেই, সাজ-খোরমা, কানমুচড়ি, গুড় মাখা জোয়ারের খই অনেক কিছুই হাতে পড়তো।

শুধু খাদ্যদ্রব্যের লোভে আমরা যে মেলায় যেতাম, তা নয়। সারি সারি মেলার দোকানগুলোতে বাঁশি, রঙিন বেলুন, ঝুনঝুনি আর বাহারি খেলনা দেখতাম। পছন্দ হলে কিনে নিতাম আর মুগ্ধতা নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। মেলায় দোকানে বসে গুড়ের জিলাপি খেয়ে নিতাম ভাইবোনরা মিলে। সুলতানের বায়োস্কোপ দেখতাম। কুটিরাকৃতির একটি ছোট্ট কাঠের ঘরের মধ্যে রাখা নানা রকমের ছবি বান্ডিলে মোড়ানো। সেটার ভেতরে একটা ঘূর্ণি যন্ত্র থাকত। ছোট্ট কুটিরের খোলা পাশটিতে চলতো একেকটি ছবি প্রদর্শনী। বায়োস্কোপঅলা বলতো, এই যে দেখেন তাজমহল, এই যে মক্কা-মদিনা, এই যে দেখেন লড়াই, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, কারবালা, হাতি ঘোড়া, সৈন্য-সেনাপতি আরো কতো কি! ওখানে দাঁড়ালে চারআনা কি আটআনা পয়সা দিন। পয়সা তোলার জন্য আলাদা লোক আছে। 

ওদিকে আছে রকেট খেলনা। কাঁচের লম্বা নলের ভেতরে রঙিন পানি, তার মধ্যে জরি মেশানো। একদিকে কাত করো তো, ভেতরের ছোট রকেটটি অন্যদিকে উঠে যাবে। আইসক্রিম অলারা চৌকোণা কাঠের বাকসোটির ঢাকনা দিয়েই ঢক ঢক শব্দ করে চার আনার সস্তা লাল নীল আইসক্রিম খাবার প্রলোভন দেখাচ্ছে। শুধু পানি সামান্য চিনি আর স্যাকারিন দিয়ে ঘন মিষ্টি করা আইসক্রিম। কেউ কেউ খেতে বারণ করছে, বলছে ওগুলো পঁচা পুকুরের পানির বরফ দিয়ে বানানো। 

মেলার একদিক ঘিরে রঙ-বেরঙের ঝালরওয়ালা কাপড়ে মোড়ানো কোমর পর্যন্ত উঁচু করা প্যান্ডেল। সেখান থেকে লোহার রিং ফিকিয়ে স্নো, পাউডার, সাবান, চুরি, ফিতা, প্রসাধনী, সিগারেটের প্যাকেট দখল করার খেলা। লুডুর মতো কিন্তু বৃহৎ সাইজের ফোটকা ফুটকি ছাপমারা ছক্কা দিয়ে জুয়া খেলা। তিন তাসের জুয়ারিরা রাস্তার ধারে এখানে সেখানে একটি রুমাল পেতেই খেলা শুরু করে দিয়েছে। গ্রাম থেকে আসা নিতান্ত সাধারণ মানুষের চোখে ভেলকি লাগিয়ে পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে, কেউ নেশায় পড়ে খেলছে। পুলিশ মাঝে মাঝে টহল দিয়ে জুয়ারির দলকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু চিনিতে মাছি পড়ার মতোই দ্রুত নিজেদের অবস্থানে ফিরে আসছে তারা। মেলার বিভিন্ন কোনা-কাঞ্চিতে ছোট ছোট জটলা, কোথাও নেশার আসর। গেরুয়া কাপড় পড়া জটাধারি সন্ন্যাসী থেকে শুরু করে ভণ্ড তপস্বীর দল হাজির; নানা কিসিমের ভিক্ষুকও বাকি নেই।


মেলার একদিকে রাস্তা বের করে ঘোড়দৌড়ের ব্যবস্থা থাকতো। প্রতিযোগিতায় আসা বিভিন্ন এলাকার ঘোড়দৌড় বিশেষজ্ঞ দল। কেউ ব্যক্তিগত ঘোড়া নিয়ে হাজির। কেউ ভাড়া করা ঘোড়ায় অংশগ্রহণ করছে। ঘোড়ার খুরের ধুলো উড়িয়ে সন্ধ্যাটা যেন আগেই নামিয়ে নিয়ে আসে তারা। বড় বড় বাজি হয়, বাজিতে কেউ জেতে, কেউ আহত হয়, কেউ শুকনো মুখ করে ফিরে যায়। পরের বছর তারাও আসে, নতুন লোকেরও আমদানি ঘটে। বড় বড় ঢাক পিটিয়ে রাতের বেলা আরতি বসে। সেখানে ধূপ-ধুনো সহ বাতি জ্বালিয়ে নাচের আসর। কাছের মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণ মূর্তির কাছে মানুষজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। প্রেমিক কি ভগবান আমাদের তখন জানা নেই— একটি গরুর পাশে কালো রাখাল সঙ্গে একটি নারীমূর্তি, নাম রাধা। তাদের গলায় সাদা-লাল কাগজের মালা। পানিতে জন্মানো একধরনের শুভ্র রঙের উদ্ভিদ (শোলা) থেকে বানানো ফুল দিয়ে তৈরি করা মালা। ফুল-চন্দন, বাতাসা, খইয়ে ভরা পাত্রগুলো ঝকমক করছে। ঢাক-ঢোল-করতাল-খঞ্জরির মিলিত ছন্দে মুখরিত পরিবেশ। মৃদু ঘণ্টার আওয়াজ বাতাসে মিশে মোহনীয় এক বিকেল। যেন দেবতা নেমে এসেছে পৃথিবীর ওপর।

মেলা থেকে একটু দূরে যাত্রা-পুতুলনাচ-হাউজি খেলার প্যান্ডেল। সন্ধ্যার পর সেখানকার পৃথিবীর দরজা খোলে। ছোটবেলায় পুতুল নাচ ছাড়া অন্য স্থানগুলোতে আমাদের প্রবেশাধিকার থাকতো না। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে বলে দিনের বেলায় যতটুকু দেখা যায়, পুতুলনাচের অংশবিশেষ দেখা।

বিরাট আকৃতির ঢাক বাজিয়ে মেলা শেষের দিন আয়োজকরা পয়সা তোলে। দোকানগুলোতে শেষের দিন থাকে উপচে পড়া ভিড়। সাধারণত ওকড়াবাড়িতে দুই দিন মেলা বসে। কালে ভদ্রে দু দিন অতিক্রম করে তিনদিন। মেলা শেষের দিন বিশেষ কষ্ট হয় মনের ভেতরে। আর ভীষণভাবে জেগে থাকে সামনের বছরের অপেক্ষা। পুণ্যস্নানের অষ্টুমিতে ওকড়াবাড়ির মেলাই যেন তীর্থস্থানে পরিণত হয় কারো কারো। গয়া কাশী মথুরা বৃন্দাবন ধামে যাদের যাবার অবস্থা নেই, তারা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়। আটপৌরে শাড়ি-জামা থেকে শুরু করে শাঁখা-সিঁদুর পড়া মেয়ে, নানাবয়সী ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ বিচিত্রশ্রেণি-পেশার মানুষ সবার মিলন কেন্দ্র হয়ে ওঠে এই মেলা। হিন্দু মুসলমান আলাদা কোনো জাতি নেই এখানে।

বছর গড়িয়ে যায়, ওকড়া দিয়ে ভরে ওঠে মাঠ, মাঠের কোণা-কাঞ্চিগুলো। যদিও পুরো মাঠজুড়ে (ওকড়া) গজায় না আর আগের মতো, গরুর গাড়িগুলোর ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দেও কান বিমোহিত হয় না, কিংবা ভোরের আলো না ফুটতেই ময়লা ধূতি পড়া আধবয়সী লোকের কাঁধে মেলার খাবার ও খেলনার ভার নিয়ে হেঁকে হেঁকে চলার দিনও প্রায় শেষ হয়ে এলো, তবুও ওকড়াবাড়ির মেলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষ তাদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। এখনো তারা অষ্টুমির পুণ্যস্নানের বিশেষ দিনটি এলে বলে, চলো ওকড়াবাড়ির অষ্টুমির মেলায় যাই …


লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন