মূল পত্রিকার লিঙ্ক : রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর গল্পের ভুবন
কবি হিসেবে তাকে চিনি, কিন্তু গল্পকার হিসেবে?
“সামগ্রিকভাবে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর গল্পের গড়ন, বিষয়-চয়ন ও বয়ান-বৈচিত্র্য আবিষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। কাহিনি-সংলাপ-কাব্যময়তা, কখনো গ্রামীণভাষা-প্রয়োগ এবং মুক্ত-ভাবনার খেলায় তা সতত সঞ্চরণশীল।”
স্বল্পায়ু জীবন, অথচ স্বল্পপ্রজ লেখক ছিলেন না রুদ্র শহিদুল্লাহ। তাঁকে কবি হিসেবেই চেনা সবার। কিন্তু সত্তায় কী মজ্জায়, তিনি এক বহুদর্শী শিল্পী। বেঁচে থাকতে রুদ্র-অনুজ কবি হিমেল বরকত বিষয়টি আমাকে ইঙ্গিতে বলেছিলেন। তখন খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম বৈকি। সত্যি একজন শিল্পীর ভেতরে বাঁধা থাকে এক বহুপরিশ্রুত মন। যাকে আপাতকাল ছুঁয়ে দেখতে পারে না। একজন কবি জীবনের পৃষ্ঠতলকে নানাভঙ্গিতে নেড়েচেড়ে দেখেন। আর রুদ্রের মতো কবি হলে তো কথাই নেই। সংগ্রামী কবির ভেতর থাকে বিপ্লবের শোণিত বিন্দু। তবু ব্যক্তি ও সমষ্টিকে তিনি আলাদা করেননি। ব্যক্তি-অনুভবের কবিতার মতো কথাশিল্পও তাঁর কাছে সত্তার সঙ্গ-প্রতিসঙ্গ, আবেগ-যন্ত্রণার বৈপ্লবিক স্বরগ্রাম।
কবিতার রুদ্রকে চেনা যায় পরতে-পরতে ছলকে ওঠা রক্তিম রঙে, নেশাতুর এক জীবনের আসক্তিতে। প্রেম দ্রোহ বিপ্লব ও আত্মলীন যন্ত্রণাকে তিনি ভাষার পোশাক পরিয়ে দেন। কবিতায় রোমান্টিক স্বপ্নাবেশেই এ-সবকিছু পূর্ণ করেন। শিল্পী রুদ্র যৌবনের অমিত বিক্রম প্রকাশে বিহ্বল। অন্যদিকে স্রোতের উল্টোদিকে চলার স্বভাবটাও যেন রপ্ত করেছিলেন। ফলে, ব্যক্তিবেদনার সমস্ত সুর মানব-সাগরের সুবিশাল তীরে আছড়ে পড়ে বারবার। মননে ও শিল্পচৈতন্যে তাই গাঁথা হয়ে যায় এক স্বর্ণসম্ভাবনার রৌদ্র-সকাল, মহাসম্মিলনের গান। কবিতার রুদ্র ধ্বংস প্রেম কাম দ্রোহ ও ক্ষয়ে উদ্ভিন্ন স্বপ্নের আমন্ত্রণে জীবনঘষা বারুদ। তাঁর কথাশিল্পও প্রায় সমান আবেশে অগ্নুৎপাতক্ষম। আবার কখনো তা থিতিয়ে পড়া জীবন, ব্যক্তি-সমষ্টির বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত-বিপন্ন স্বদেশ।
দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকলে এই কবির সত্তায় কথাশিল্প ঝলসে উঠতো। কিন্তু নিষ্ঠুর কাল তা হতে দেয়নি। রুদ্র গল্প লিখেছেন মাত্র কয়েকটি। এর মধ্যে প্রকাশিত ৬টি, অপ্রকাশিত ২টি এবং অসমাপ্ত ১টি। ‘ইতর’, ‘সোনালী শিশির’, ‘উপন্যাসের খসড়া’, ‘নিজস্ব লড়াই’, ‘নিসঙ্গতা’, ‘কৃষ্ণচূড়ার মৃতদেহে একখানি রঙিন ইনভেলাপ’, ‘যেখানে নরকে গোলাপ’, ‘সিগারেট ও কতিপয় ব্যক্তিগত স্কেচ’, ‘শিরোনামহীন’— এ-কটিই তাঁর গল্প। এই সমাপ্ত-অর্ধসমাপ্ত কথার জগৎ রূপে ও বিষয়ে সাবলীল, বৈচিত্র্যময়।
আধুনিক ও উদ্বাস্তু মানুষের মধ্যে বাসা বাঁধে নিরতিশয় যন্ত্রণা। আধুনিক মানুষের নিঃসঙ্গতা, ভঙ্গুরতা, বিচূর্ণতা, স্বপ্ন-ভাঙার তড়িতাবেশ সবকিছু আত্মস্থ করে নেয় তাঁর গল্প। শাহুরিক উচ্ছন্নতা, বিপন্নতা, ব্যক্তিত্বের সংক্ষোভ, ব্যক্তির অনিরাময়যোগ্য ব্যাধি, অর্ধসমাপ্ত বিপ্লবের হাহাকার সেখানে একাকার। শুধু শহর নয়, বিপ্লবী সত্তার পরাজয় ও টানাপড়েন গ্রামকে চিহ্নিত করে ভিন্নতর জটিল বাস্তবতায়। কখনো আশাহত মন স্বপ্নভাঙার তোড়ে গোঙায়। কখনো প্রলুব্ধ আপসের মহুয়ামদে আসক্ত মানুষ বৃন্তচ্যুত হয় স্বর্গীয় প্রতিবেশ থেকে চরম নারকীয়তায়। শরীরী বাস্তবতার কাছে কখনো আবদ্ধ হয় মনোলৌকিক বিকার।
শৈল্পিক অনন্যতার মাত্রায় নির্মিত ‘ইতর’। নিরাসক্ত গল্প কথনভঙ্গির উৎকৃষ্ট উদাহরণ এ-গল্প। মানবিক বিপর্যয় এর কাহিনিকে টেনে ধরে রাখে। এর প্রধানতম কারণ হয়তবা শিল্পীর ব্যক্তিক ক্ষয়-তাপ-যন্ত্রণা। তবুও ব্যক্তি নয়, শিল্পের ভেতরে কথা বলে ওঠে এক নৈর্ব্যক্তিক মানুষ। যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা ও যাপন-ক্লান্ত পরাভূত মানুষ সেখানে আশ্রিত। শিল্পীর নিজস্ব আবেগে স্বীকৃত হয় সত্যের প্রতীকী রূপ।
নিয়ত ভোগের শরীর স্থিতির সমিল বন্ধনে অপারগ। দাম্পত্য-কলহের নেপথ্যে দেহশুচিতা কি মনোশুচিতা, স্পষ্ট নয়। যদিও উভয়ই মানুষের আরাধ্য, তবু থাকে সংস্কারের ভৌতিকতা। আবার এই সংস্কার উড়িয়ে দিলেই যে যুযুধান ব্যবধান মুহূর্তে উবে যাবে সে-ভরসা কোথায়! তাই এক তীব্র উচ্ছন্ন জীবনে যন্ত্রণা ও অসারতা ঘিরে থাকে কুঁকড়ে যাওয়া অনুভবের মতো। সেখানে সঙ্গী যেন বিসঙ্গত এক সত্তার অন্য নাম। ব্যক্তিক কি সামষ্টিক শুচিতায় যাকে সঙ্গত করা যায় না। ফলে জেগে থাকে অতৃপ্তি তৃষ্ণা ও বিবমিষার নিরবলম্ব বোধ।
কায়েস-শরীফার দাম্পত্য সম্পর্ক একটি অসারতা—বিভীষিকা যার অপর নাম। পরস্পরের প্রতি আছে যন্ত্রণাময় প্রেম, অভাব কেবল বিশ্বাসের। “শরীফা সৌন্দর্য সচেতন মেয়ে। তবে আত্মনির্ভরশীল একটি বিজ্ঞানসম্মত পেশায় যুক্ত থেকেও রূপ নিয়ে গর্ব করার মত মধ্যযুগীয় মূর্খতাকে এখনো সে ত্যাগ করতে পারেনি।” শরীফা সাব্রীন তাই আধুনিক হলেও অজানা এক ‘নীল অহঙ্কার’। আত্মকুহরে আটকে পড়া ব্যক্তিক ক্ষয়ের চিহ্ন সে বহন করে। অভিযোগের শরে আবদ্ধ হয় কায়েসও। অনভিযোজন ভাঙন আর বীতশ্রদ্ধায় সিদ্ধান্তে উপনীত শরীফাও। “কায়েসের মতো একটা লম্পটের সাথে থেকে নিজের ক্যারিয়ারটা নষ্ট করার কোনো মানেই হতো না। সমাজ বদলের নামে ছোটলোকদের সাথে মিশে নিজেই একটা ইতরে পরিণত হয়েছে সে।”
মধ্যবিত্ত-টানাপড়েনের অবশেষ যেন আপসকামিতা। সে-বিষে নীল হয়ে যায় মানবিক শৌর্য-সৌকর্য। বিকারগ্রস্তের মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাস্তবতা গল্পের চরিত্র ও ভাষা-বিন্যাসে রূপান্বিত হয়। সামাজিক অধঃপতনের দলিল লিখিত হয় গল্প নামক কথাশিল্পের বিস্তৃত মোড়কে। শিল্পীর ব্যক্তিক বিপন্নতার সঙ্গে জমা হয় সামষ্টিকতার বোধ। সরকারি কর্মকর্তা আফসারের বর্তমান সঙ্গীন অবস্থার নিরেট চিত্র উঠে আসে। গল্পে উত্তম পুরুষের ভাষায় তা বর্ণিত :
সমাজে অর্থনৈতিক সমতার পক্ষে এবং শোষণের বিপক্ষে বহু মিছিলে সে নেমেছে। পুলিশের তাড়া খেয়েছে। এখন সে গণতন্ত্রের পোশাকে মোড়া সামরিক সরকারের কাগুজে উন্নয়নের মহাত্মপ্রচারের দায়িত্বে নিয়োজিত।
ভেতর-বাইরের সত্তা এক হওয়া অসম সমাজে দুর্মর বৈকি। শুধু ব্যক্তিক কুর্মবৃত্ত নয়, আরো কতকগুলো প্রলোভন-সংস্কার-দায়-বিচেতনা রাহুর মতো ঘূর্ণমান। পারস্পরিক দোষারোপ কেবল নিঃসীম অন্ধকারের প্রযোজনা। অজানিত মনুষ্য আবেগ আর স্বভাব বহুকামিতা অসুখি জীবনের অন্যতম কারণ। দ্বিধান্বিত মানবসত্তা দুঃসহ মনোবেদনায় শরীরী সংযোগ অন্বেষণ করে। তবু মুক্তি নেই, তা যেন অনির্দেশ্য আবেগের বশীভূত। মিলনক্ষান্ত কায়েস-শরীফা “পরস্পরের প্রতি আকর্ষণহীন উদাসিনতায় তারা একই রকম আচরণ করে।” সত্যি মানুষের শরীর যেন এক জঘন্য নিয়তি।
‘উপন্যাসের খসড়া’ একটি অনুগল্প। এটিও দাম্পত্য জটিলতার গল্প। কোনো চরিত্র বা বিশেষ কাহিনি নেই গল্পে। এতে আগের গল্পটির অব্যক্ত কথার বিস্তার যেন ঘটেছে। তবে জীবন সম্পর্কে বিশেষ ভাবনা, গভীরতা ও সঙ্কটের ভাষ্যে কাব্যময় অনুভূতির সঞ্চার ঘটে। নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও জটিলতার ধোঁয়াটে একটি ভাব পুরো গল্পকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
নারীটি চিরকালীন নারীর মত তার কুয়াশা বা আশা কোনোটিকে স্পষ্ট করতে পারলো না। অথবা স্পষ্ট করতে চাইলো না। … তবু আকাংখা জমে, মেঘ হয়। কখনো ঝড়, কখনো বৃষ্টি, আবার কখনো শুধু মেঘে মেঘে, অন্ধকারে।
এভাবেই একেকটি রহস্যময়-অনির্দেশ্য কাব্য-অনুভবে মৌন-গভীর যন্ত্রণাকে রূপায়ণ করেন রুদ্র। তিনি দেখান—মানবজীবন শেকলে আবদ্ধ নয়। শেকলে জড়াতে চাইলেও বন্দিত্ব থেকে পরিত্রাণ পেতে চায় মানুষ। নর-নারীর দাম্পত্য সম্পর্ক তাই বন্ধন নয়, বন্দিত্বের প্রতীক। এ-গল্পে অবরুদ্ধ জীবনে তারা কেউই প্রতিশ্রুত নয়। যুবকটি একার লড়াইয়ে পরাজিত। তাই সংগ্রামী সঙ্গী হিসেবে তাকে চায়, কিন্তু নারীটি পারে না। এ-নারী স্বপ্নাবেশের মতো নীল আকাশে পাখা মেলতে চায়, কিন্তু অক্ষম-আক্রোশে ডানা ঝাপটায়। দাম্পত্য-বাস্তবতায় দ্বৈত আকাঙ্ক্ষার নীতিতে দুজনই ভাস্বর; তাই সমুদ্র-ব্যবধানও ঘোচে না তাদের। কারণ :
যুবকটি চেনে স্বকালের অন্তর্গত মুখ, সভ্যতার খাঁচায় পোরা গিনিপিগ। যে কোনো শর্তেই সে নারীটির সঙ্গ চায়, স্বপ্ন চায়, মনোযোগ চায়। নারীটির অন্তর জুড়ে অপমান। ভালোবাসার মানুষ তো সে একার, একান্ত নিজের। অন্য চোখ অন্য শরীর তাকে ছুঁয়ে গেছে, নষ্ট করেছে।
নারীটির ক্ষেত্রে যে-চিত্র এখানে প্রত্যক্ষ, সেটাই যুবকের মর্মপীড়ার কারণ। আবার ঠিক এর বিপরীত আখ্যান তৈরি হয়, যখন পুরুষটি শরীরের চেয়েও মনের শুদ্ধতাকে ইঙ্গিত করে। এই দুইয়ের ব্যবধান সীমাহীন। এক ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত কিন্তু না-মেলানোর অকথ্য যন্ত্রণার আর্তিতে ভরা :
কাকে মনোযোগ বলি, একাগ্রতা বলি কাকে! যে মন হাজার মনের কাছে গিয়ে খুঁজেছে শান্তি অথচ শরীরে লাগেনি তার এতটুকু ছোঁয়া। অথবা যে শরীর শত শরীরের বাঁকে বাঁকে ঘুরেছে অথচ মনে যার লাগেনি এতটুকু অন্য স্পর্শ!
‘নিঃসঙ্গতা’ গল্পটিতে শৈশব স্মৃতিচারণ, একাকিত্ব, যৌন-অবদমন প্রভৃতি বিষয় উঠে আসে। শৈশব-স্মৃতি হয়তবা সবারই প্রিয়। কিন্তু এই গল্পের শৈশব নৈঃসঙ্গ্য বেদনায় ভারাতুর। সামাজিক জটিলতা এই বিকারের অন্যতম কারণ। স্মৃতিচারণার ধূসরতা সুন্দর এক বর্ণনার ভাষা তৈরি করে গল্পে। কাব্যচ্ছটার মধ্য দিয়ে ভেজা শৈশবের নিঃশব্দ শূন্যতার কথা ব্যক্ত হয়। সে-শৈশব আনন্দদায়ক নয়। আবার শৈশবের অসহায় আবেগ বর্তমানে যেদিকে তাকে চালিত করে, তা যেন এক দুর্বৃত্ত-স্বদেশ।
বন্ধুদের কেউ একজন বলেছিলো : “আমরা একটা নষ্ট যুগের মধ্যে জন্ম নিয়েছি। না পারছি শিকড়ের পচা প্রশাখাগুলোর মায়া ছাড়তে, না পারছি নতুন মাটিতে শিকড় গাঁথতে।”
অসংযত চিন্তাগুলো দলাপাকানো অনুভূতি হয়ে কণ্ঠরোধ করে থাকে বালকটির। কেননা তার স্মৃতিতে হানা দেয় সেই ইশা কসাই, যে ভোজালি হাতে নির্বিচারে মানুষ খুন করতো। গল্পে প্রতীকীভাবে প্রজাপতি ও টিকটিকি উপস্থাপিত। সুন্দর প্রজাপতিকে যেন গিলে খাবে অসুন্দর টিকটিকি। অথচ বালকের হাত বাঁধা। যেন কিছুই করবার নেই। নোংরামি আর দুঃসহ স্বদেশে তার অভিব্যক্তি :
ও কাউকে ঠেকাতে পারছে না। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে বর্বর ইশা কসাইয়েরা আদর্শের দেশি মদ আর ধর্মের তাড়ি খেয়ে বর্ন সম্প্রদায়ের নেশায় বুঁদ হয়ে ভোজালি হাতে ছুটে আসছে তার দিকে।
রুদ্রের গল্পে থাকে নিরেট এক রাষ্ট্রবোধ। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছিল। ‘শিরোনামহীন’ গল্পটি বক্তব্যধর্মী। বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে দুঃখিনী স্বদেশের মানচিত্র পাল্টে যাওয়ার কথা। বন্ধুরা একে অপরের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। কিন্তু তাদের ভেতরে কাজ করে চাপা ক্ষোভ। ক্ষমতার পালাবদলের পরিণতি আজ বড়ই করুণ।
রাজাকার তো প্রধানমন্ত্রী হয়েই গেল’; ‘যদি তোমরা আঘাতই করতে পারবে তাহলে তো আর রাজাকার প্রধানমন্ত্রী হতো না। তোমরা পারো মদের দোকানে গ্লাস ভাঙতে, আর কিছু না।
এইসব কথায় আছে লেখকের সততা আর বিপ্লবী রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন। আর সমকালের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের উদাহরণ।
‘সোনালী শিশির’ গল্পে কতিপয় বন্ধুর ক্রিয়াকলাপের চিত্র ফুটে ওঠে। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এদেশের তরুণদের অধোগতি লেখককে চিন্তাক্লিষ্ট করে। কয়েকজন ইয়ার-বন্ধু যারা প্রত্যেকেই শিল্পী তাদেরকে চরিত্র করেন তিনি। কিবরিয়ার চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দিয়ে গল্পের শুরু। আরেক বন্ধু সেই ছবিতে নায়ক হতে চায়। কিন্তু কিবরিয়ার মধ্যে কাজ করে বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা করে পয়সা কামানোর ধান্দা। তাই এ-ধারার বিপরীতমুখি বন্ধু ইসহাক তার কাছে একটি অযোগ্য ক্যারেক্টার।
গল্পটি বিশেষত্ব এখানেই যে, সামাজিক কমিটমেন্টের জায়গাগুলো যেভাবে ধসে পড়ছিল তার একটি জটিল স্কেচ লেখক দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন।
গল্পকার রুদ্রের কাছে প্রেম এক অসমীকরণযোগ্য জটিল বিষয়। শাসনহীন মন একে তৃপ্ত নয়, কিন্তু বহুতেও মুক্ত নয়।
রাজধানীর পুলিশ-প্রশাসনের দৈন্য বন্ধুদের আলাপের বিষয় হয়ে ওঠে। যে-সিনেমা ইসহাক বানাতে চায় তার প্রধান চরিত্র পুলিশ ইন্সপেক্টর। যে-লোকটি আবার প্রেম করছে খুনির বোনের সঙ্গে। এই ইয়ার-বন্ধুগোষ্ঠী মদের নেশায় চুর। বারে বসে তাদের আলাপের সূত্রপাত। তারা বিভিন্ন মদের বিভিন্ন নাম দেয়। সে নাম সৃষ্টিতে রয়েছে স্পষ্ট অবদমনের চিহ্ন। দৈনন্দিন বাস্তবতায় ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত যুবসমাজ। ‘গণ-অভ্যুত্থান’, ‘মাতৃভাষা’, ‘কালো কুত্তা’, ‘বংশীবাদক’, ‘নেপো কাকা’, ‘পরী’ সর্বোপরি ‘সোনালী শিশির’—নামগুলো রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক জটিল যন্ত্রণার প্রতিফলন। ঢাকায় রাতের আলোতে প্রায় নির্জন রাস্তায় বোহেমিয়ান এই যুবকরা ঘুরে বেড়ায়। তারা ভাবে : “সুবিধাভোগীরা যে যার কোলাপসিবল মোড়া খাঁচায় ফিরে যায়। সুবিধাহীনরা উন্মুক্ত খাঁচায়।”
সামাজিক অসাম্যের অসার গ্যাংগ্রিনকে আর জোর করে বুঝে নেবার দায় থাকে না পাঠকের।
গল্পকার রুদ্রের কাছে প্রেম এক অসমীকরণযোগ্য জটিল বিষয়। শাসনহীন মন একে তৃপ্ত নয়, কিন্তু বহুতেও মুক্ত নয়। ‘অন্য কোথা অন্য কোনো খানে’র ব্যকুলতা, যা মানবিক অস্তিত্বেরই একটি সংগুপ্ত অধ্যায়—তা-ই এই গল্পের বিষয়। ‘কৃষ্ণচূড়ার মৃতদেহে একখানি রঙিন ইনভেলাপ’, ‘সিগারেট এবং কতিপয় ব্যক্তিগত স্কেচ’—বৃহৎ শিরোনামের এই দুটো গল্পেরই প্রধান বিষয় অধরা-অস্পর্শী প্রেম। প্রথম গল্পে রুদ্র ও তন্দ্রা দুই বন্ধু। শরীরী কামনার চেয়ে প্রতিশ্রুত বিপ্লব, সমতার স্বদেশই তাদের আরাধ্য। তন্দ্রার প্রতি রুদ্রর অনুভব প্লেটোনিক। তাকে বিয়ে করে ‘ঘড়ায় তোলা জল’ করতে ভেতর থেকে সাড়া মেলে না। নীড় বাঁধতে দ্বিধাগ্রস্ত তন্দ্রাও।
বিশ বছর পর তাদের দেখা হয়। তখন দু-জনই বিবাহিত। শিলা নামক শান্ত কমনীয় মেয়ের সঙ্গে পারিবারিক অনুরোধেই সংসার পাতা। তার নাম সে দেয় ‘বিয়ে করে ভালবাসা’। অন্যদিকে শিলাও একদিন তার স্বামী শাহজান মাখনকে নিয়ে সামনে আসে। গল্পের ক্লাইমেক্স-বিন্দুটি শেষে ধরা পড়ে—শোকেস-বন্দি বিয়ের কার্ডে।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমাদের বিয়ের রঙিন কার্ডটি শোকেচের ভেতর স্পষ্ট জ্বলছে। বিয়ের পর শিলাই ওটাকে সাজিয়ে রেখেছিল ওখানে।
‘সিগারেট এবং কতিপয় ব্যক্তিগত স্কেচ’ টুকরো প্রেমের একক অনুভবের গল্প। নায়ক রুদ্রর প্রতি একতরফা প্রেমে পড়ে লাজ নামক মেয়েটি। তখনো প্রেমের অর্থ তৈরি নেই ঠিক রুদ্রর কাছে। লাজ তার চোখের ক্যানভাসে কার ছবি আঁকা দেখতে বলে প্রেমিককে। অথচ প্রেমিকের অনুভব, “আমি ওর আর্ট পেপারের মতো শাদা চোখের ভেতর গভীর কালো একটা তারকা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।” লাজের বিয়ে হয়ে যায়। পুরনো চিঠির স্মৃতিস্তুপ নীল অ্যালবামে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে প্রেমিক।
গল্পটির পরিসর খুবই ছোট। শুধু এই ব্যক্তিগত দুঃখমোড়ানো সুখস্মৃতিটি উদযাপন করেই যার পরিসমাপ্তি। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটির মতোই এর সময়কাল।
নিরেট সামাজিক বাস্তবতা কাব্যিকতাকে আড়াল করে। রুদ্রের ‘নিজস্ব লড়াই’ সে-রকমের একটি গল্প। গল্পটির আয়তন বড়। এর ভাষাও হয়ে উঠেছে সরল। পুরোপুরি গ্রামীণ আবহ এখানে উপস্থিত। গ্রামের সঙ্গে লেখকের যোগাযোগের বিষয়টি কমিটেড শিল্পীর মতো সুস্পষ্ট। ‘নিজস্ব লড়াই’ যেন এক কঠিন পর্যাবৃত্ত। আমাদের গ্রামীণ সমাজ, বেড়ে ওঠা মানুষ, ক্রম-শহরমুখিনতা এবং নিঃশেষে অসারতা। সব মিলিয়ে গল্পটি বেশ ইঙ্গিতময়।
বিপ্লবী নায়ক মফিজ গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুবাদে রাজধানী শহরের ছোঁয়া লাগে। এর মধ্যেই সুলতানা নামক বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু মফিজ একসময় গ্রামে ফিরে আসে। সেখানকার কৃষক ও মেহনতি মানুষের বন্ধু হয়ে তাদেরকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে থাকে। মফিজ বোঝে এই অশিক্ষিত ধর্মান্ধ সমাজের মানুষকে পাল্টানো সহজ নয়। তবুও সে হাল ছাড়ে না। চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার বচসা হয়। ধান কেটে কৃষকের গোলায় তোলার আন্দোলনে মফিজ নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু চেয়ারম্যানের ভয়াবহ চক্রান্তে গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় মফিজ। মফিজের বৃদ্ধ বাবা আর বড় ভাই (যে সদ্য চিংড়ির ঘের দিয়ে পয়সাওয়ালা) সবাই তাকে কোনো বিরোধে জড়াতে নিষেধ করে। কিন্তু স্বাপ্নিক মফিজ কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না। সহবিপ্লবী ফারুক-ভগ্নীর মধ্যেও সে খুঁজে পায় বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। সুলতানার চিঠি এলেও সে মাথা ঘামায় না। আসন্ন বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্র তাকে জাগিয়ে রাখে। এ-পর্যন্ত গল্পটি মফিজ-গাঁথা হয়ে ওঠে। কিন্তু গল্পের শেষে এক অনাকাঙ্ক্ষিত মোচড় পাঠককে বিধ্বস্ত এক স্বপ্ন-ভাঙার জগতে প্রবেশ করায়।
আদালতে মামলা খেয়ে মফিজ পালায় শহরের দিকে। তার চরিত্রে ভীষণ দোলাচল। প্রতিষ্ঠিত সমাজের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ থেকে সে পেছনে ফেরে। কিন্তু সহযোদ্ধা গ্রামীণ মানুষগুলোর যে পালাবার জায়গা নেই! মফিজের বিপ্লব তাই হঠকারি বিপ্লবের নামান্তর। বোঝা, না-বোঝার সঙ্কটও এই স্বাপ্নিক হঠাৎ বিপ্লবের অন্যতম শত্রু। মফিজ হাত নেড়ে পালাবার মুহূর্তে আশাবাদ ব্যক্ত করে “আবার আসবো, দেখা হবে”। শহরমুখি হয় সে। কিন্তু তার অন্তরই কেবল জানে গন্তব্যের প্রকৃত পরিচয়। মধ্যবিত্তের স্বপ্নমেদুরতা মফিজের স্বাপ্নিক বিপ্লবের মতোই হঠকারি। পলায়নপর মফিজ হয়তো বড়লোকের কন্যা সুলতানার মতো কাউকে নিয়ে সংসার পাতবে। অর্থগৃধ্নুতার কাছে মাথা সঁপে দেবে এক সময়ের বিপ্লবী নায়ক। লেখক তাই বলেন :
কিন্তু মফিজ জানে, সে আর আসবে না। মফিজেরা কখনো আসে না। আসতে পারে না। তবে ফারুক, নিতাইরা ইতিমধ্যে বুঝতে পারে লড়াইটা তাদের। তাদের লড়তে হবে এবং মফিজদের বিরুদ্ধে।
‘যেখানে নরকে গোলাপ’ একজন রূপোপজীবীর গল্প। গল্পে রহিমা প্রধান চরিত্র। এই রহিমা সমাজে নষ্ট-ভ্রষ্ট চরিত্র। তার সন্তানের বাবা অজ্ঞাত কোনো খদ্দের। একসময় সন্তানকে খুন করার কথাও ভাবে সে। তবুও মাতৃত্ববোধ জয়ী হয় বারবার। হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করা বাচ্চার দিকে তাকিয়ে উছলে ওঠে তার স্বপ্ন। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে জীবিকার অন্বেষণে সে হিমশিম। এই সন্তানটির মুখে খাবার তুলে দিতে তাকে বাড়তি কষ্টে পড়তে হয়। লেখকের সহানুভূতি যেন ঝরে পড়েছে চরিত্রটিতে। তার যন্ত্রণার ভাষাকে তিনি রূপায়িত করেন :
বারবার ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে এই জীবনটাকে। যৌবনের চরম উন্মত্ততায় কেন যে ও এ-পথে পা দিয়েছিলো আজ ভাবতে শিউরে ওঠে ও।
শহরের পার্কে এ-রকম হাজারো চরিত্রের ভিড়ে একজন রহিমা বিপন্নতার প্রতীক। শেষবার মাতৃত্ববোধ হেরে যায় তার বাধা উপার্জনের পথে। গল্পকার রহিমার মনোলোকে কিঞ্চিৎ ছায়া ফেলেন। আধিভৌতিক স্বপ্ন দেখার মতো ঘুমের ঘোরেই সে আতঙ্কিত হয়। ছেলেটি তার কাছে হয়ে ওঠে ভীতিকর। প্রকাণ্ড মাথাওয়ালা, ঠিকরে বেরিয়ে পড়া চোখ, হাত-পা সরু, মুখের মাংসগুলো খসে পড়া, দাঁত বেরিয়ে যাওয়া এক অমানবে রূপান্তরিত হয়েছে সেটি। তারপর রহিমা যা করে তা পাঠককে এক প্রবল ঝাঁকুনি দেয়। কারণ একজন মা-ই যে হয়ে ওঠে সন্তানের হন্তারক !
রহিমার চোখ জ্বলছে মার্বেলের মতো। আচম্বিতে সজোরে চেপে ধরে ছেলেটির কণ্ঠনালী—সামান্য গোঙানির শব্দ হয়। বার কয়েক হাত-পা ছুঁড়ে স্তব্ধ হয়ে যায় রহিমার জাতক, তার শত্রু।
চরম বীভৎসতা ও তীব্র ক্ষতের চিহ্ন হয়ে ওঠে এই সন্তানহত্যা। কিন্তু কে না জানে, যে-পরিস্থিতিতে একজন মা তার সন্তানকে খুন করতে পারে, তা আসলে কেমন? পাঠক ভাবনার অবকাশ পায়। একটি সাদামাটা গল্প হলেও নগরজীবনের টুকরো অভিজ্ঞতা থেকে জটিল এক অনুভবের কথা ব্যক্ত করেন গল্পকার।
রুদ্র শহিদুল্লাহ এই অল্প কটি গল্প দিয়ে কথাশিল্পীর স্থানটি অধিকার করেছেন। অনুর্ধ্ব ৩৫ বছরের জীবনে কবিতার বাইরে এই যা উপহার দিলেন—সে দান অসামান্য। গল্পের জন্য তিনি গল্প লিখেছেন। তার রচনা ছেঁকে একজন নিষ্ঠাবান কথাশিল্পীর অন্তর্জগৎ খুঁজে পাওয়া খুবই সম্ভব। তারপরও বলতে হয়—শুধু ব্যক্তিগত প্রেমানুভবকে বাদ দিলে রুদ্র আপাদমস্তক মানুষের শিল্পী। যে-দৃষ্টিকোণ থেকে বারবারই তাঁর বয়ান চলে যায় বঞ্চিতজনের প্রতি। সামাজিক বিপ্লব, পরিবর্তনের কথা তাঁর অন্যতম আগ্রহের বিষয়। বিপ্লবের ঝাণ্ডাধারীদের নিদারুণ ব্যর্থতাও খতিয়ে দেখার শিল্পী তিনি। আর এ-কারণে গল্পকার হিসেবে বক্তব্যধর্মিতার দায়ে হয়তো আবদ্ধ হবেন তিনি। সেখানে নৈর্ব্যক্তিক বা নিরাসক্ত বলার ভঙ্গিটিও সবসময় রক্ষিত হয়নি। কিন্তু তাঁর গল্পে সামাজিক দুর্ঘটের সঙ্গে শৈল্পিক সংযোগের তুল্যমূল্য বিচার্য নয়।
ব্যক্তি-অনুভূতির গীতিধর্ম রুদ্রের গল্পে চমৎকারিত্ব অর্জন করে। দুর্মর যন্ত্রণাকাতর ও নৈঃসঙ্গ্য-পীড়িত তাপিত অসহায় ব্যক্তিমানুষের আখ্যান হয়ে ওঠে সেগুলো। খররৌদ্রের মতো ঝাঁঝাঁ করা অনুভূতির রূপায়ণে পারঙ্গম শিল্পী তিনি। বর্ণনা ও প্রকাশের ভাষাও অধিক প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে কাব্যিক অন্তর্লীনতায়। ‘উপন্যাসের খসড়া’, ‘নিসঙ্গতা’, ‘কৃষ্ণচূড়ার মৃতদেহে একখানি রঙিন ইনভেলাপ’, ‘সিগারেট ও কতিপয় ব্যক্তিগত স্কেচ’—গল্পসমূহে গল্পকার নয়, একজন কবি এসে উপস্থিত হন। এসব গল্পে ভাষার বয়ান ও কুশলী গাঁথুনিও শক্তিশালী। ‘ইতর’ গল্পটি নিঃসন্দেহে কথাশিল্পীর শক্তিমত্ততায় পূর্ণ। তিনি ক্রাইসিস নামক এক ভয়ানক ব্যাধি ও দুঃসহ বাস্তবকে দেখান অনুপুঙ্খভাবে। তাঁর পক্ষে একজন বড় মাপের কথাশিল্পী হিসেবে তৈরি হবার ইঙ্গিত ছিল এ-গল্পটিতে। এটি কায়েস আহমদের ‘লাশ কাটা ঘরে’র হিমশীতল-জাড্য-পঙ্কিল-অসহায় অনুভবকে স্মরণ করায়। সামগ্রিকভাবে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর গল্পের গড়ন, বিষয়-চয়ন ও বয়ান-বৈচিত্র্য আবিষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। কাহিনি-সংলাপ-কাব্যময়তা, কখনো গ্রামীণভাষা-প্রয়োগ এবং মুক্ত-ভাবনার খেলায় তা সতত সঞ্চরণশীল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন