অ্যারিস্টটল (Aristotle) প্রাচীন গ্রিসের একজন মহান দার্শনিক ও বিজ্ঞানী। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ সালে গ্রিসের স্ট্যাগিরা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ সালে তিনি মারা যান, গ্রিসের চালকিস (Chalcis) নামক স্থানে, যা বর্তমানের ইউবোয়া (Euboea) দ্বীপে অবস্থিত। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর মৃত্যুর (৩২৩ খ্রিস্টপূর্ব) পর এথেন্সে ম্যাসিডোনীয় বিরোধিতা তীব্র হয়ে ওঠে।
অ্যারিস্টটল ছিলেন ম্যাসিডোনীয় রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ। ফলে এথেন্সে রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেছিলেন — "I will not allow the Athenians to sin twice against philosophy." অর্থাৎ, “আমি অ্যাথেনীয়দের দিয়ে আবার যেন দর্শনের বিরুদ্ধে অন্যায় না করাই।” কারণ প্রথমবার তারা সক্রেটিসকে হত্যা করেছিল। এই পরিস্থিতিতে তিনি এথেন্স ছেড়ে চলে যান চালকিসে, যেখানে পরের বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।অ্যারিস্টটলের জন্মস্থান স্ট্যাগিরা শহর ছিল গ্রিসের উত্তরাঞ্চলের চ্যালকিডিকি উপদ্বীপে। এটি বেশ প্রাচীন শহর। বর্তমানে তা আধুনিক গ্রিসের সেন্ট্রাল ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলের অন্তর্গত। আধুনিক স্ট্যাগিরা একটি ছোট ও মনোরম গ্রাম হিসেবে পরিচিত। তবে তা আজও তার সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এটি এমন একটি ভূখণ্ড যার তিন দিক পানি (সমুদ্র বা মহাসাগর) দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং এক দিক মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।
ম্যাপে পুরো সাদা অংশটি আধুনিক গ্রিস
অ্যারিস্টটল প্লেটোর শিষ্য ছিলেন এবং প্রায় ২০ বছর এথেন্সের প্লেটোর অ্যাকাডেমিতে শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি ম্যাসিডোনিয়ার যুবরাজ আলেকজান্ডার (পরবর্তীতে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট) এর গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। দার্শনিক হিসেবে অ্যারিস্টটল বাস্তববাদী দর্শন প্রচার করতেন, যা প্লেটোর আদর্শবাদী দর্শন থেকে আলাদা। এথেন্সে তিনি ‘লাইসিয়াম’ নামক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী বিশ্ব এই ‘লাইসিয়াম’-এ উৎপাদিত জ্ঞানকাণ্ডের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। অ্যারিস্টটল জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে আলাদা আলাদা ভাগ করেন, যেমন: পদার্থবিদ্যা, অধিবিদ্যা, আবহাওয়া বিদ্যা, জীববিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, রাজনীতি, কাব্যশাস্ত্র ইত্যাদি। অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রীয় অর্থে কল্যাণ চিন্তা করেছেন। এই চিন্তা তাঁকে শিল্পচিন্তায়ও প্রভাবিত করে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের “সর্বোচ্চ মঙ্গল” বা “Eudaimonia” নিশ্চিত করা।
[Eu (εὐ): যার অর্থ ভালো, শুভ আর Daimon (δαίμων): অর্থ দৈবশক্তি, বা আত্মিক সত্তা।]
প্লেটোর অনুকরণ
অ্যারিস্টটলের অনুকরণতত্ত্ব বুঝতে হলে, প্লেটোর অনুকরণতত্ত্ব বুঝে নেওয়া জরুরি। প্লেটো মনে করতেন — কবিরা দৈবী অনুপ্রেরণায় অভিষিক্ত আর এই বিশ্বজগত হচ্ছে মূল জগতের ছায়া। এই ছায়াজগতে শিল্পীদের স্বাধীন অস্তিত্ব বলে কিছু নেই। কারণ কবিরা ডিভাইন বা স্বর্গীয় জগতের অনুকারক মাত্র। তারা নিজে থেকে কিছুই সৃষ্টি করতে পারেন না। তবে ‘সোফিস্ট' গ্রন্থে অনুকরণকে তিনি একজাতীয় সৃষ্টি বলে মেনে নিয়েছেন। তবুও মিথ্যা অনুকরণকে তিনি বাদ দিয়েছেন। তিনি চেয়েছেন শিল্পীরা সত্যের স্পষ্ট অনুকারক হয়ে উঠুক। 'Eikastike' বা সত্যের অনুকরণকে তিনি মেনে নিয়েছেন। আর 'Phantastike'কে মিথ্যা অনুকরণ বলে বর্জন করার কথা বলেছেন। প্লেটো মনে করতেন, শিল্প বাস্তবতার বিকৃত প্রতিফলন এবং এটি মানবজ্ঞানকে বিভ্রান্ত করতে পারে। প্লেটোর "Forms" বা আদর্শ রূপ তত্ত্ব অনুসারে, বাস্তব জগতে আমরা যা কিছু দেখি, তা আসলে আদর্শ রূপের (Ideal Forms) একটি ক্ষীণ প্রতিচ্ছবি।
প্লেটোর মতে শিল্পের তিন রূপ : আদর্শ রূপ, বাস্তব বস্তু এবং শিল্পকর্ম।
আদর্শ রূপ (আসল সত্য) – Theory of Forms অনুযায়ী, এটি চিরস্থায়ী সত্য।
বাস্তব বস্তু (আদর্শ রূপের অনুকরণ) – ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, দৈনন্দিন বস্তু ও ঘটনা (যা আদর্শ রূপের ছায়া মাত্র)।
শিল্পকর্ম (বাস্তব বস্তুর অনুকরণ) – বাস্তব বা আদর্শ জগতের অনুকরণের অনুকরণ (যা প্রকৃত সত্য থেকে আরও একধাপ দূরবর্তী)
প্লেটোর তত্ত্বে এই আদর্শ ফর্ম বা রূপই বস্তুর প্রকৃত রূপ। শুধুমাত্র চিন্তায় বা দর্শনে তা উপলব্ধি করা যায়। সেখান থেকে তৈরি হয়েছে একটি বাস্তব জগত। এই বাস্তব আবার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্য, অর্থাৎ আপাত সত্য। শিল্পীরা যখন এই বস্তু জগতের (আপাত সত্য/ছায়ার) অনুকরণ করে চিত্রকলা, ভাস্কর্য বা সাহিত্য সৃষ্টি করেন, তখন তা আসল রূপ থেকে দ্বিতীয়বার বিচ্যুত হয়। অর্থাৎ—
ক. প্রথম বিচ্যুতি: আমরা যা কিছু দেখি সেসব বস্তু আদর্শ রূপ/ফর্মের প্রতিচ্ছবি মাত্র।
খ. দ্বিতীয় বিচ্যুতি: শিল্প (যেমন চিত্রকলা, কবিতা) সেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর অনুকরণ, যা আদর্শ রূপের চেয়েও দূরবর্তী।
অ্যারিস্টটলের অনুকরণ
অনুকরণ সম্পর্কে অ্যারিস্টটল তাঁর গুরু প্লেটোর সব কথা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেননি। তিনি সত্য তথা বাস্তব জগতের অনুকরণের কথা বলেছেন কিন্তু নানাকারণেই তা প্লেটোর দর্শন থেকে আলাদা । তিনি বলতেন, “প্লেটো প্রিয় কিন্তু তারও চেয়ে প্রিয়তর হচ্ছে সত্য।” অর্থাৎ গুরুর চেয়েও সত্যের মূল্য বেশি। গুরুকে তিনি কখনো অবজ্ঞা করেননি। সেটা প্রকৃত শিষ্যের কাজও নয়। কিন্তু জ্ঞানের জগতে তিনি গুরুকে অতিক্রম করে গেছেন। প্লেটোর একাডেমিতে যখন তিনি পড়াশুনা করতেন তখনই ছাত্র অ্যারিস্টটল সম্পর্কে তাঁর একটি চমৎকার ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তিনি শিষ্যকে Nous বলে অভিহিত করেছিলেন।
[গ্রিক দার্শনিক অ্যানাক্সাগোরাস (Anaxagoras) সম্ভবত প্রথম দর্শনচিন্তায় Nous শব্দটি ব্যবহার করেন একটি সর্বজনীন বুদ্ধিমত্তা বা আধ্যাত্মিক শক্তি বোঝায়। তাঁর মতে, Nous এমন এক শক্তি, যা জগতকে গঠন ও গতিশীল করে। প্লেটো ভাবতেন যে, Nous দিয়ে মানুষ Form বা Ideal জগতকে উপলব্ধি করতে পারে। Nous জগতের আদর্শ, ভাব, এবং ঈশ্বরীয় জ্ঞান বহন করে। Nous থেকে আত্মা (psyche) জন্ম নেয়, আর তারপর বস্তুজগত। এটি অনেকটা ঈশ্বরীয় জ্ঞানচেতনার রূপ। অ্যারিস্টটল মানুষের আত্মার একটি অংশকে nous বলে ভাবতেন। এই আত্মা চিন্তা করে এবং যুক্তি দিয়ে সত্যকে বোঝে।]
প্লেটোর অনুকরণ-তত্ত্বসমন্বিত সংজ্ঞাকে অ্যারিস্টটল তাৎপর্যমণ্ডিত করেন। অন্যদিকে কবিদের প্রতি তাঁর আক্রমণের যুক্তিনিষ্ঠ প্রতিবাদ হিসাবে অ্যারিস্টটল তাঁর তত্ত্বটিকে পোয়েটিক্স গ্রন্থে উপযুক্ত পরিমার্জনা করে প্রকাশ করেন। ‘পোয়েটিকস’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে অ্যারিস্টটল বলেছেন—
“Epic poetry and Tragedy, as also Comedy, Dithyrambic poetry, and most flute-playing and lyre-playing, are all viewed as a whole, modes of imitation."
অর্থ : “মহাকাব্য ও ট্র্যাজেডি, যেমনভাবে কমেডি, দিথিরাম্বিক কবিতা, এবং অধিকাংশ বাঁশি ও বীণাবাদন—এই সবই সামগ্রিকভাবে অনুকরণের একেকটি ধরন হিসেবে বিবেচিত।”
এই পর্যন্ত প্লেটোর সঙ্গে অ্যারিস্টটলের বিশেষ পার্থক্য নেই। শিল্পের বিশেষ লক্ষণ হিসাবে তিনি অনুকরণের কথা বলেছেন। তাঁর মতে মাইমেসিস/মিমেসিস (Mimesis) অর্থ "অনুকরণ" বা "অনুসরণ।" সাহিত্য ও শিল্প হচ্ছে জীবন ও প্রকৃতির অনুকরণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ সহজাতভাবেই অনুকরণপ্রবণ এবং এই অনুকরণ থেকেই শিল্পের জন্ম হয়। তবে অ্যারিস্টটল শিল্পের সৃজনপ্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করতেন। এক্ষেত্রে তিনি প্লেটোর মতো অনুকরণকে নকল বলতে চাননি। তাঁর কাছে "Art imitates life." (কলা জীবনের অনুকরণ) কথাটির অর্থ এই নয় যে, আর্ট বা কলা জীবনের অন্ধ অনুকরণ করে। তাঁর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে :
“Poetry is more philosophical and more elevated than history; for poetry tends to express the universal, history the particular.”
"কবিতা দর্শনচিন্তার দিক থেকে ইতিহাসের চেয়ে অধিক এবং মর্যাদায়ও উচ্চতর; কারণ কবিতা বিশ্বজনীনত্ব/সার্বজনীনতা/সাধারণকে প্রকাশ করতে চায়, আর ইতিহাস প্রকাশ করে নির্দিষ্ট ঘটনা।"
অ্যারিস্টটল তাঁর "Poetics" (কাব্যতত্ত্ব)-এ বলেছেন, শিল্পকলার মাধ্যমে মানুষ বাস্তবতার নানান রূপকে অনুকরণ করে। তিনি তিনটি প্রধান উপায়ে অনুকরণ সংঘটিত হয় বলে ব্যাখ্যা করেছেন: ১. অনুকরণের মাধ্যম (Mode of Imitation); ২. অনুকরণের বিষয় (Object of Imitation); ৩. উপস্থাপনের রীতি (Mode of Presentation)
১. অনুকরণের মাধ্যম (Mode of Imitation): “For the medium being different, the art must be different.” অর্থাৎ, “মাধ্যম ভিন্ন হলে, শিল্পের প্রকৃতিও ভিন্ন হতে বাধ্য।” অনুকরণ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেমন: চিত্রকলা, ভাস্কর্য প্রভৃতি রং ও রেখার মাধ্যমে তৈরি হয়। শব্দের মাধ্যমে তৈরি হয় কবিতা, নাটক, সংগীত। এরপর নৃত্য বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সৃষ্টি হয় অভিনয় ও নৃত্য।
২. অনুকরণের বিষয় (Object of Imitation): অ্যারিস্টটলের কাছে মানুষই হচ্ছে অনুকরণের প্রধান বিষয় বা অবলম্বন। অ্যারিস্টটলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি হলো:
“Since those who imitate imitate men in action, these men must be either of a higher or a lower type (for moral character mainly answers to these divisions, goodness and badness being the distinguishing marks of moral differences).”
“যেহেতু অনুকরণকারী ব্যক্তি সাধারণত মানুষ ও তাদের কর্মকে অনুকরণ করেন, সুতরাং এই মানুষরা হয় উন্নত চরিত্রের হবে, নয়তো নিম্ন চরিত্রের (চরিত্র মূলত এই দুই ভাগে বিভক্ত — মহৎ ও হীন)।”
শিল্পকলায় অনুকরণ করা হয় মানুষের কর্ম ও চরিত্রকে, এবং তা সাধারণত তিনভাবে প্রকাশ পায় : উচ্চ নৈতিক চরিত্র, গড়পড়তা বা সাধারণ চরিত্র এবং নিম্নশ্রেণির চরিত্র।
উচ্চ নৈতিক চরিত্র: ট্রাজেডি বা মহাকাব্যে নায়কের সংগ্রাম ও মহত্ত্ব দেখানো হয়।
গড়পড়তা বা সাধারণ চরিত্র: বাস্তববাদী সাহিত্য বা নাটকে সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিফলন ঘটে।
নিম্নশ্রেণির চরিত্র: কমেডিতে ত্রুটি ও হাস্যরসের মাধ্যমে মানবপ্রকৃতি উপস্থাপন করা হয়।
৩. উপস্থাপনের রীতি (Mode of Presentation): তিনি মূলত তিনটি ভিন্ন উপস্থাপনার রীতি চিহ্নিত করেছেন, যার মাধ্যমে শিল্পকলায় অনুকরণ প্রকাশিত হয়। অনুকরণ বিভিন্ন রীতিতে প্রকাশিত হয়:
বর্ণনা বা কাহিনির মাধ্যমে: মহাকাব্য বা উপন্যাসে কাহিনিবর্ণনার মাধ্যমে ঘটনা উপস্থাপন করা হয়।
অভিনয়ের মাধ্যমে: নাটক বা ট্রাজেডিতে চরিত্রেরা সরাসরি সংলাপ ও কর্মের মাধ্যমে ঘটনাকে উপস্থাপন করে।
মিশ্র রীতিতে: কখনো কখনো বর্ণনা ও অভিনয় মিলিয়ে উপস্থাপিত হয়।
এ বিষয়ে অ্যারিস্টটলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপনযোগ্য:
“The poet may imitate by narration — in which case he can either take another personality as Homer does, or speak in his own person, unchanged — or he may present all his characters as living and moving before us.”
“কবি অনুকরণ করতে পারেন বর্ণনার মাধ্যমে — সে ক্ষেত্রে তিনি হোমারের মতো অন্য কোনো চরিত্রের দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করতে পারেন, কিংবা নিজের কণ্ঠে কাহিনি বলতে পারেন — অথবা তিনি সমস্ত চরিত্রকে আমাদের সামনে জীবন্ত ও সক্রিয় করে উপস্থাপন করতে পারেন।”
সহজাত শৈল্পিকতা
জন্ম থেকেই মানুষের মধ্যে অনুকরণবৃত্তি অত্যন্ত প্রবল। আমরা সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকেই সে-কথা বুঝতে পারি। শিশুর সহজাত আচরণে তা উপলব্ধিযোগ্য। অন্যদিকে পরিণত মানুষের কাছে অনুকরণের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত আন্দদায়ক। অরিস্টটলের মতে, আনন্দ ও সহজাত বৃত্তির বশেই পরিদৃশ্যমান জগতকে মানুষ অনুকরণ করে থাকে। অনুকরণের সাহায্যেই কাব্য, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা প্রভৃতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব অনুকরণকে সাহিত্যসৃষ্টির লক্ষ্য মনে করে না। তাঁর ধারণায় অনুকরণ শিল্পসৃষ্টির উপায়মাত্র। অনুকরণের প্রকৃতি সম্বন্ধে দীর্ঘকাল তিনি চিন্তা করেছেন। শুধু পোয়েটিকস নয়, বরং তাঁর অন্যান্য গ্রন্থেও বিভিন্ন চিন্তনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা প্রকাশ করেছেন — যে-গ্রন্থগুলো ঠিক শিল্পের নয়, বরং বিজ্ঞান, অধিবিদ্যা ইত্যাদি সম্পর্কিত। ‘পোয়েটিক্স' রচনার পূর্বেই বিভিন্নভাবে তিনি এই চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অ্যারিস্টটল তাঁর ‘মিটিওরলজি' গ্রন্থে শিল্পকে প্রকৃতির অনুকারক বলেছেন। অর্থাৎ, “শিল্প প্রকৃতিকে অনুকরণ করে। ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে তিনি জানালেন, প্রত্যেকটি শিল্পের উদ্দেশ্য প্রকৃতির মধ্যে যে অপূর্ণতা আছে তা দূর করা—তাকে সম্পূর্ণ করে তোলা। তিনি ‘ফিজিক্স’ গ্রন্থে বলেছেন, শিল্পী প্রকৃতির মধ্যে প্রচ্ছন্ন সত্যকে আবিষ্কার করেন এবং সত্যবদ্ধ প্রকৃতির পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতি রচনা করেন। ‘মেটাফিজিক্স' গ্রন্থে তিনি শিল্পের স্বরূপ এবং প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক বিষয়ে আরো স্পষ্ট কথা বলেছেন। এখানে তিনি বলেছেন, প্রকৃতি এবং শিল্প এই বস্তুবিশ্বের দুটি প্রধান ‘initiating force'। প্রাকৃতিক জগতে সৃষ্টির প্রবর্তনা যখন প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত, শিল্পসৃষ্টির প্রবর্তনা তখন রয়েছে শিল্পীর হৃদয়ে।”
অ্যারিস্টটল এখানেই শিল্পসৃজনের বিষয়ে মানুষের অন্তকরণকে গুরুত্ব দিয়েছেন। প্লেটোর মতো তিনি শিল্পকে ডিভাইনের ছায়া বলে প্রচার করেননি। তাঁর ধারণায় শিল্প একটি রূপান্তর, তবে এই রূপান্তর সৃষ্টিশীল। তাঁর মতে, ডিভাইন থেকে প্রকৃতি নির্মিত হলেও, শিল্পী তার সৃজনশীল ক্ষমতাবলে তাকে নতুন সৃষ্টি করে তোলে। শিল্পীর কল্পনা ও প্রতিভাকে অ্যারিস্টটল অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সে-সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্য পেশ করেছেন। ঈশ্বরের সৃজিত জগতকে আসলে শিল্পীরা নতুন রূপে গড়ে তোলেন। এখানেই মানুষের অনুকরণবৃত্তির মাহাত্ম্য। সে প্রকৃতি সদৃশ বস্তু তৈরি করলেও তা তার সৃজনকৌশলের অনন্য বাহাদুরি। তাই যেকোনো জিনিস দর্শনীয় বাহ্যিক বস্তু অপেক্ষা ভিন্নরূপ গঠন করতে পারে। প্লেটোর মতো তা আদর্শ রূপ বা ডিভাইনের ছায়া বলা থেকে তিনি বিরত থেকেছেন। তাই অনুকরণ সেখানে উপায় হয়ে উঠেছে, লক্ষ্য নয়। মানুষের লক্ষ্য নৈতিক জগতের নির্মাণ। আর তা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তায় স্পষ্ট হলেও, শৈল্পিক সৃজনশীলতার বিষয়ে ভিন্নরকম উচ্চ ধারণাই পোষণ করেছেন।
প্লেটো ও অ্যারিস্টটলে চিন্তার পার্থক্য
প্লেটো শিল্পকে দেখেছেন বাস্তবের ছায়া হিসেবে, আর অ্যারিস্টটল শিল্পকে দেখেছেন বাস্তবতর সত্যের সন্ধান হিসেবে। ‘পোয়েটিক্স’ গ্রন্থে অ্যারিস্টটল অনুকরণের যে বিশেষ তাৎপর্য তুলে ধরেছেন, তাতে প্লেটোর সঙ্গে যে পার্থক্য সূচিত হয়েছে, তা এই তিনরকম সূত্রে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে — ১. ‘আইডিয়াল’ ও বাস্তবতার ধারণা; ২. কাব্যের অনুকরণ; ৩. অনুকরণের গন্তব্য ও কবির ধর্ম।
১. ‘আইডিয়াল’ ও বাস্তবতার ধারণা:
প্লেটো মনে করেন, আইডিয়াল বা ভাবরূপ হচ্ছে ঈশ্বরের মনে থাকা বাস্তব সত্য; বস্তুজগৎ তার অনুরূপ এক অপরিপূর্ণ ছায়া।
অ্যারিস্টটল এই আদর্শ/ভাবরূপের স্বাধীন অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তাঁর মতে, আদর্শ/ভাবরূপ বস্তুর ভেতরেই নিহিত এবং বাস্তবতা হচ্ছে বস্তুবিশ্ব, যা নিজেই সত্য, অনুকরণ নয়।
২. কাব্যের অনুকরণ: নিন্দা না নন্দন:
প্লেটো বলেন, কাব্য অনুকরণেরও অনুকরণ; অতএব তা সত্য থেকে দূরে এবং বিভ্রান্তিকর, তাই নিন্দনীয়।
অ্যারিস্টটল বলেন, কাব্য অনুকরণ করে বটে, তবে তা সৃজনশীল রূপান্তর; কবি বাস্তবের মধ্যে নিহিত সার্বজনীন রূপ অন্বেষণ করেন, যা মানুষকে আনন্দ ও বিমোক্ষণের অনুভব প্রদান করে।
৩. অনুকরণের গন্তব্য ও কবির ধর্ম:
প্লেটোর মতে, কবিকে সত্য ও সৌন্দর্যের যথাযথ প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে হবে। অ্যারিস্টটল বলেন, কবির উদ্দেশ্য সত্য অনুকরণ নয়, বরং সত্যকে রূপায়ণ; ইতিহাস যেভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দেয়, কাব্য তেমন সম্ভাব্য সত্যের রূপ দেয়। তাই শিল্পে আদর্শায়িত অনুকরণই সৌন্দর্য সৃষ্টি করে—এমনকি কুৎসিত বস্তু অনুকরণেও সৌন্দর্য সৃষ্টি হতে পারে। অ্যারিস্টটলের মতে, যান্ত্রিক অনুকরণ নয়—আদর্শায়িত অনুকরণের দ্বারাই মহৎ কাব্য সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেছেন – “Imitation is the idealistic representation of universal element in human nature and sight." অর্থ : “অনুকরণ হলো মানব প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতার সার্বজনীন উপাদানের ভাববাদী রূপায়ণ।”
অর্থাৎ, মানবচরিত্র এবং দৃশ্যমান জগতের মধ্যে সার্বজনীন বা সামগ্রিক সত্য প্রচ্ছন্ন রূপে আছে। আর তাকেই রূপ দান করা কবির কর্তব্য। তাই আইডিয়াল কিংবা সামগ্রিকতা অবলম্বন করলেই তা শিল্প হয়ে ওঠে না। বরং শিল্পকে সামগ্রিক ‘সম্ভাব্য সত্য’ হয়ে উঠতে হয় সাধনার মধ্য দিয়ে। যেমন মহাকাব্য নামক যে শিল্পটি রয়েছে তাতে যুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু সমগ্র যুদ্ধের বর্ণনা সেখানে নাও থাকতে পারে। শিল্পী মানবজীবনের সামগ্রিক রূপ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন কিনা সেটাই প্রধান বিবেচ্য। আরও সহজ করে বলা যেতে পারে যে, শিল্পী সঙ্গতিপূর্ণ একটি সময়েরই ছবি আঁকেন তাদের রচনায় বা শিল্পকর্মে। একটি গোলাপ ফুটতে যতক্ষণ সময় লাগে, শিল্পী তাঁর রচনার মধ্যে সেই গোলাপ ফোটাতে কি ততোটাই সময় ব্যয় করেন? তাঁর বর্ণনায় কি ততোখানি ডিটেইলস তুলে ধরেন? এককথায় উত্তর হবে—না। এ-ধারণার মতো কোনো শিল্পীই মানবজীবনের সামগ্রিক সত্যের উপস্থাপনায় সবটা বর্ণনা করেন না। তিনি বেছে নেন কতটুকু নেবেন আর কতটুকু বাদ দেবেন।
সামগ্রিক/সার্বজনীন সত্য এবং শিল্পসাহিত্যের সত্য
প্রকৃতপক্ষে কোনো একটি শিল্পকর্মে এভাবেই জীবনের সামগ্রিক সত্য বা ‘Universal Truth’ তৈরি হয়। সত্যের সন্ধান এবং নৈমিত্তিক ঘটনা থেকে শাশ্বত জীবনের রূপ দেওয়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নই অ্যারিস্টটলের বক্তব্যে উপস্থাপিত। এখানেই হয়তো ইতিহাসের সঙ্গে কাব্যের পার্থক্যের সূত্রটি স্পষ্ট। তিনি বলেছেন—“By the universal I mean how a person of certain type will on occasion speak or act according to the law of probability or necessity.” অর্থাৎ, “আমি ‘সার্বজনীন’ বলতে বুঝি—কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রের মানুষ কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে সম্ভাবনা বা প্রয়োজনের নিয়ম অনুযায়ী কীভাবে কথা বলবে বা আচরণ করবে।” বিশাল সময়ে উপস্থিত মানুষ বিশেষ অবস্থায় ‘সম্ভাব্য’ আচরণ করে। কবি বা শিল্পী যাচাই করে একেই ফুটিয়ে তোলেন। আর সেই সম্ভাব্যতার মধ্যেও শ্বাশ্বত সত্য থাকে।
বর্তমানে উপস্থিত মানুষগুলো একসময় ইতিহাসের মানুষ হয়। আবার ইতিহাসের মানুষগুলো নিয়ে শিল্পী তার রচনা তৈরি করেন। ঐতিহাসিকরা একটি possible ঘটনা এবং বিশেষ ঘটনাকেই লিপিবদ্ধ করেন। সামগ্রিক সত্য সেখানে আছে কি নেই তা দেখার দায় ঐতিহাসিকের নেই। কাব্যের সঙ্গে ইতিহাসের এখানেই পার্থক্য। কবি ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রকে আশ্রয় করে ঘটনার বিবরণ দেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটলেও সব ঘটনার ব্যাখ্যা তিনি দেন না। আবার যে ঘটনা শিল্পীর জীবনে ঘটেনি অথচ ঘটবার সম্ভাব্য সূত্র আছে, সেটাও প্রকাশ করেন। তিনি আসলে বিশ্বাসযোগ্যতাকেই যাচাই করেন। এখানেই কবির কল্পনা ডানা মেলে প্রকাশিত হয়। তাই কবি কেবল অনুকারক হয়ে থাকেন না। তিনি জীবনের সামগ্রিক রূপ দেবার জন্য কল্পনাকে অনুসরণ করেন। তাই সেটি আর যান্ত্রিক অনুকরণ বা বাহ্যবস্তুর ছায়া হয়ে থাকে না। অনুকরণ হয়েও তা হয় শিল্পসৃজনের একটা উপায়।
অনুকরণ-তত্ত্বে অ্যারিস্টটল তাঁর গুরু প্লেটোকে অনুকরণ করেননি। তা না করলেও অনুসরণ করেছেন। তাঁর চিন্তা ও দর্শনের অনুগামী হয়ে নতুন তত্ত্ব উপহার দিয়েছেন। প্লেটোর মতো কাব্যসৃষ্টির জন্য দৈবী প্রেরণা আবশ্যক, এ কথা তিনি অস্বীকার করেননি। তবে অ্যারিস্টটলের মতে সৃজনকৌশলে শিল্প নতুন জগতেরই প্রতিনিধিত্ব করে। বিধাতা ও শিল্পী সেখানে একে অপরের পরিপূরক। ফলে শিল্প কখনোই আইডিয়াল বা আদর্শরূপের হুবহু অনুকরণ নয়। শিল্প জগতকে নতুনরূপে সৃষ্টি করে। এভাবেই অ্যারিস্টটল ভবিষ্যৎ পৃথিবীর শিল্পচিন্তার পথকে প্রশস্ত করেছেন। পরবর্তী বিশ্ব তাঁর চিন্তা ও দর্শনের কাছে ঋণী হয়ে উঠেছে।
*খোরশেদ আলম, শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন