“সংগ্রাম ও শান্তির প্রতীক হিসাবে তরবারি ও লাঙ্গল ইউরোপের মানুষেরা এতো বেশি প্রচার করেছে যে এখন আমাদের পক্ষে লাঙ্গলের সঙ্গে লোভ শব্দটাকে যুক্ত করতে সঙ্কোচ দেখা দিয়েছে।”—মহিষকুড়ার উপকথা
মহিষকুড়ার উপকথায় অমিয়ভূষণ মজুমদার অঙ্কন করেন জাফরুল্লা নামক এক সামন্ত প্রভুর চরিত্র। মহান রুশ লেখক লিয়েফ তলস্তয় ভূমিকেন্দ্রিক মালিক ও দাসের সম্পর্ক তুলে ধরেছিলেন। বিশ্বসাহিত্যে বাংলাসহ নানা ভাষার সাহিত্যেই এই সম্পর্কের রসায়ন তুলে ধরা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদিত শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টভাবে সামন্ত সমাজের ভাঙন নিয়ে উপন্যাস রচনা করেছেন। মহিষকুড়ার উপকথায় জাফরুল্লা এবং তাকে ঘিরে থাকা ভূমিদাস আসফাকরা যেন সেই উত্তরাধিকার। কালের ব্যবধান সত্ত্বেও, আসফাকের সমান্তরালে রয়েছে যেন করালীর মতো চরিত্র। মহিষকুড়ার উপকথায় জাফরুল্লা বাদেও সামন্তশ্রেণির অপর একজন প্রতিনিধি বুধাই রায়, যার প্রতাপে বাবার মৃত্যুর পর আসফাককে গৃহত্যাগ করতে হয়। সমগ্র বিশ্বেই দেখা যায়—সাব-অলটার্ন বা নিম্নবর্গ সর্বদাই থাকে শোষকের শোষণযন্ত্রের তলায়। তারা জীবনের সবকিছুকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়। নিজেদের সংস্কৃতি, ধর্ম, বিশ্বাসনির্ভরতায় তাদের মধ্যে থাকে সহজ জীবন-অনুভব। তাদের আদিম প্রাকৃতিক জীবনের সরল অনুভবকে নষ্ট করে অর্থ-প্রতিপত্তির মালিকরা।
জাফরুল্লারা আসফাককে কেবল ভূমি থেকে উৎখাত করে না, তাকে ব্যক্তিগত সুখের জায়গা থেকেও সরিয়ে দেয়। আসফাকের প্রেমিকা কমরুণ ছিল ‘বাউদিয়া’ সম্প্রদায়ের নারী। কমরুণের স্বামীর মৃত্যু হয় বসন্ত রোগে। ঘটনাচক্রে পরিচিত এই নারীর সঙ্গে হয় প্রণয়সম্পর্ক। কমরুণ এখন জাফরুল্লার বাড়ির চার নম্বর বিবি। নিম্নবর্গের বেঁচে থাকার লড়াই, জমির দাবি, ক্ষুধার লড়াই প্রভৃতি এ-উপন্যাসে উপজীব্য হয়ে উঠেছে। মহিষকুড়ার উপকথা নানাভাবেই হয়ে উঠেছে জীবনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। ছোট পরিসরের মধ্য দিয়েও তা হয়ে উঠেছে মহাকাব্যিক জীবনোপম—ক্ষমতা ও সম্পত্তির বিশ্বে যার প্রাসঙ্গিকতা যুগযুগান্তরে ব্যাপ্ত।
কাফকার উপন্যাসরীতি বারবার ফিরে এসেছে অমিয়ভূষণের লেখায়। মহিষকুড়ার উপকথাতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। হাকিমের চরিত্রটির সঙ্গে ঢিবি খোবলানো মোরগের তুলনা, অন্যদিকে আসফাকের সঙ্গে ঝুঁটি ফুলিয়ে ঘুরে-বেড়ানো মোরগের তুলনা ফ্রয়েডীয় চৈতন্য-সঞ্জাত। লোভী সামন্ত জাফরুল্লা ব্যাপারী, হাকিম, মেজিস্ট্রেট বা প্রশাসন কি কংগ্রেসি ভোটবাবু একই পাটাতনে বন্দি। সাধারণ মানুষের দাবিকে রুদ্ধ করে শাসকের শোষণ টিকে থাকে। পুঁজির অমিতবিক্রমশালী বিকাশে কীভাবে পতন হয় নিম্নবর্গের, তারই প্রতীকী ও কাব্যিক বয়ানে সমৃদ্ধ এ-আখ্যান। আসফাক দ্বারিঘরের সামনে এসে দেখে চাকর, আধিয়ার ও গ্রামের মানুষের ভিড়ের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড গাড়ি। ঠিক সেই সময়েই সাত্তারের মুখে সে শুনতে পায় জাফরুল্লা ব্যাপারীর ‘পঞ্চায়েত পিধান’ (সমাজ প্রধান) হওয়ার কথা। বস্তুত নিম্নবর্গের জীবনে শেষ কুঠারের কোপ ওই অশোকের লে ল্যান্ডের ট্রাক। যার অসীম ক্ষমতায় দৈহিক শক্তিসম্পন্ন মানুষের পরাজয় ঘনীভূত। মোদ্দাকথা, উচ্চশ্রেণির লোভের আগুনে নিম্নশ্রেণির মানুষের পতন ঘটে।
হাকিম আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘গ্রামে আর, জমি জিরাৎ নিয়ে অন্যায় থাকবে না’। সেই বিশ্বাসে ভর করেই আসফাক হাকিমের কাছে জাফরুল্লা ব্যাপারীর নামে নালিশ করে। আসফাক জানে না, বিচারের পাল্লা বিত্তবানদের দিকে অবনত। ধনীক তোষণের সমাজে বিচারব্যবস্থা মানেই প্রহসন। আইন ও বিচারের ফল সবসময় ভোগ করে উচ্চবর্গ। তারাই সমাজের ধর্তাকর্তা, বিচারের রায় তাদের দিকে পক্ষপাতদুষ্ট। লক্ষণীয় যে, ফিওদর দস্তয়েভস্কির ‘ব্রাদারস কারামাজভ’ উপন্যাস আইন, নৈতিকতা, অপরাধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। যদিও এটি বাবার হত্যা এবং তার ছেলেদের বিচারের পটভূমিতে লেখা। তবুও এই উপন্যাসে বিচারের নামে প্রহসনের সত্য উদ্ভাসিত। ঠিক এমন করেই দেখা যাবে ফরাসি বিপ্লবের অব্যবহিত পূর্বে রচিত সমাজে আইনের নামে প্রহসন ও সমাজ পরিবর্তনের পটভূমি-নির্ভর ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’ নামক উপন্যাস। জাঁ ভালজা নামক চরিত্রটি উচ্চবর্গ নির্মিত সমাজকাঠামো ও আইনি ব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করে। সে দেখে যে, দোষ না থাকলেও সমাজ খলনায়ক তথা ভিলেন বানায় নিম্নবর্গের অভাবী মানুষকে। গোটা সমাজ ধনীদের তৈরি মূল্যবোধকে মেনে চলে, পক্ষান্তরে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। কিন্তু সেই অপরাধের দায়ভার চাপানো হয় দরিদ্র মানুষের ওপর, যাদের হাতে আইন ও বিচারকে ক্রয় করার সামর্থ্য নেই।
মহিষকুড়ার উপকথায় আসফাকদের পক্ষে ন্যায়বিচার বালিতে মুখ গোঁজে, কারণ শোষক জাফরুল্লাই আজ গ্রামের সম্পূর্ণ ক্ষমতার কেন্দ্র। সাব-অলটার্নদের বিচার তাদের কাছে প্রহসন। লেখকের ভাষায়, ‘লোহার শিকল পরানোর মতো কালো পিচের রাস্তা-সড়ক দিয়ে আমরা অরণ্যকে বেঁধে ফেলেছি। … যেদিন অরণ্যকে মানুষের লোভ গ্রাস করতে শুরু করেছে, সেদিন লাঙল শুধু মানুষের অগ্রগতির চিহ্ন না হয়ে আগ্রাসনের চিহ্ন হয়ে উঠেছে। অরণ্য হ্রাস পেয়েছে, সেখানে জেলা জন্ম নিয়েছে। সরকারি নির্দেশে যেটুকু অরণ্যসম্পদ ধরে রাখা আছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে রিজার্ভ ফরেস্ট।’ এই রিজার্ভ ফরেস্ট এখন ঔপনিবেশিক ও দেশীয় সামন্তপ্রভুদের প্রতাপী চারণক্ষেত্র। অথচ তা ছিল একসময় সর্ব সাধারণের। আইনের বলে বনের জমির দখলিস্বত্ব ভোগ করছে জাফরুল্লার মতো নয়া সামন্তরা। এরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলভোগী তথা জমি ও কৃষির উৎপাদনভোগী গোষ্ঠী। তাদের কৃষিব্যবস্থার সহযোগী দরিদ্র চাকররা। তাদেরকে মিথ্যা দেনার ‘রেহনিখত’ লিখিয়ে নিয়ে প্রায় হাজার বিঘে জমির দখল ভোগ করে জাফরুল্লা একাই।
মহিষকুড়া নামটির মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির উপকরণের এক গভীর যোগ। ১৯৮৬ সালে রাজনগর উপন্যাসের জন্য ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া-স্বরূপ অমিয়ভূষণ জানিয়েছিলেন, ‘আশির দশকের একজন উদীয়মান লেখক হিসেবে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থিত হতে আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করছিলাম।’ সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন,
জীবন আমাকে জাগিয়ে রেখেছে এবং জগতে আমার ভালো লাগছে না। এই জাগরণে আমার বৃদ্ধি নেই … আমি ওই পার্টিকুলার ধরনের এস্কেপ চাচ্ছি। মায়ের জঠরে যে এস্কেপ করেছিলাম জীবনকে ছোঁয়ার, জীবনকে আদিরূপে দেখবার, জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়ার চেষ্টা … দর্শন জ্ঞানবিজ্ঞান ইত্যাদি দিয়ে তো নিজেকে জানা হলো না। সেসব দিয়ে যা জেনেছি তা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। সাহিত্য সৃষ্টির মূলে হয়তো অস্বস্তি থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা।
লেখক হিসেবে অমিয়ভূষণ মনে করেন, তিনি জগতে এক ভয়াবহ ‘ট্রমা’র শিকার। এই ট্রমা মানুষের পক্ষে মায়ের জঠরে ফিরে যাওয়ার মনস্তত্ত্ব। মানুষ মায়ের উদরে ছিল পরম শান্তিতে, তা ছিল স্বর্গীয় সুধায় পূর্ণ। সেখান থেকে বাস্তব পৃথিবীতে পদার্পণ একটা প্রবল বিচ্ছিন্নতা। বস্তুত মানুষ এই অবদমনমূলক কর্কশ (বাস্তবঠাসা কৃত্রিম) পৃথিবীতে ‘ট্রমা’র শিকার। এ-উপন্যাসে অরণ্যভূমির প্রসঙ্গেও একই কথা বলা চলে। বাইবেলের উক্তি, “গ্রাম ঈশ্বরের আর শহর মানুষের।” অর্থাৎ, গ্রাম যদি প্রকৃতি হয়, সেই গ্রাম ভেদে নগর বা সভ্যতা হচ্ছে নষ্টামির চিত্র। এই সভ্যতা তৈরি করে তথাকথিত চৈতন্যশীল মানুষরাই। অমিয়ভূষণের ‘মহিষকুড়ার উপকথা’র ভাবনায় মানুষের সহজাত মাতৃজঠর অভাবহীন আনন্দময়। তাই অরণ্যময় জগতে মানুষ প্রগলভ ও স্বতশ্চল তথা প্রাণচঞ্চল। সেই সহজিয়া জগতের পতন ঘটে পৃথিবীতে মানবজন্মের সঙ্গে সঙ্গে। তারপর সারাজীবন তাকে শূন্যতার মধ্য দিয়ে গমন করতে হয়। পৃথিবীর প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে তাকে চলতে হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সরে যাওয়ার অর্থ মধুময় সহজ জীবন থেকে সরে যাওয়া। মানুষের এই বিচ্ছিন্নতার সূত্র তৈরি করে নগর, যা সম্পন্ন হয় বিত্তশালীদের সম্পদ আহরণের লোভে।
আটশ বিঘা জমির মালিক জাফরুল্লা ব্যাপারির চারজন স্ত্রী, বহু চাকর-নোকর, গরু-মহিষ, বাথান। ক্রমবর্ধমান সম্পদ, খামার, জমি ও বনের মালিক জাফরুল্লা। জঙ্গল কেটে চাষের জমি বাড়াতেও তার জুড়ি নেই। সরকারি আইনকে ফাঁকি দিয়ে জঙ্গলের জমি নিজের করে নেয় সে। অন্যদের নামে জমির ‘রেহনিখত’ লিখে নেওয়ার কৌশল ভালোভাবেই জানা আছে তার। আসফাক, চাউটিয়া বর্মণ, ছমির, সাত্তার, সোভানসহ নাম-গোত্রহীন বহু মানুষ তার খামারে কাজ করে। আসফাক ও জাফরুল্লা ক্রমশ দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়। কারণ আসফাকের প্রেয়সী কমরুণকে কব্জা করেছে মালিক। কিন্তু প্রতিশোধ তার কতোটা হাতের নাগালে?
তীব্র মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কটে নিপতিত আসফাক ‘ভুলুয়া’য় আক্রান্ত হয়। আসলে ক্ষমতার সঙ্গে পেরে না-ওঠার অব্যক্ত ক্রোধ জাগ্রত হয় তার মধ্যে। এই ক্রোধই তার মধ্যে তৈরি করে হতাশা, যা অবচেতনে ঠাঁই নেয়। ‘ভুলুয়া’ কুসংস্কার হলেও তা নিম্নবর্গের জীবনসত্যের মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত। এটি তাদের মানসিক বৈকল্য, অবসাদ ও ক্লান্তির ফল। আসফাকের পথ ভুল করা তীব্র মানস সংক্ষোভের চিহ্ন। সামাজিক বিধিব্যবস্থার হাত ধরে তার মানসীকে সম্পূর্ণ দখলে নিয়েছে জাফরুল্লা। সেই সংক্ষুব্ধতা কাঁটা হয়ে আসফাকের হৃদয়ে বিদ্ধ হচ্ছে। পথ ভুল করা তার জন্য বাস্তব, যা ভুলুয়া নামক সংস্কারের আবরণে ঢাকা মাত্র। আসলে অক্ষম মানবতার কান্না গুমড়ে ওঠে তার মধ্যে। ফলে সে ভৌতিক দর্শনের মুখোমুখি। জাফরুল্লার বাড়ির বিবিসহ অন্যরাও তাতে সায় দেয়। কারণ তারাও সামন্তপ্রভুর ক্ষমতা নামক চোখধাঁধানো ইন্দ্রজালে মন্ত্রপূত। ফলে সেখানে বিভ্রমই সত্য হয়ে ওঠে আর সত্য হয়ে ওঠে অন্ধ-সংস্কার।
আসফাক ‘আ আ আড়’ করে ডেকে ওঠে মোষের মতো। এই ডাক তার বৃথা আস্ফালন, যা ‘নির্জ্ঞান’ অস্তিত্ব হয়ে তাকে পথ ভুলিয়ে দেয়। টাউনে গিয়ে জাফরুল্লার যৌনবর্ধক ওষুধ আনতে গিয়ে সে ব্যর্থ হয়। এই ওষুধ না আনতে পেরে মালিকের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্তও হয়। জাফরুল্লার লোভের চক্রে বন্দি কমরুণ প্রেমিক আসফাককে কাছে আসতে নিবৃত্ত করে। অথচ এই কমরুণই একদিন সহজ স্বকীয় চৈতন্যে ভাস্বর হয়েছিল। তার সঙ্গে ঝোরার জল পান করেছিল আর যৌনসম্পর্কও স্থাপন করেছিল। তখন ছিল সভ্যতার তৈরি আইন-কানুন মুক্ত সহজাত আদিম মানুষের অনুভব। ফলে সামাজিক রীতিনীতির তোয়াক্কা ছিল না। সেই কমরুণ আজ তাকে দরজার বাইরে রাখে। এমনকি স্বীয় ঔরসজাত ছেলে মুন্নাফকেও দখলে নেয় নির্বীর্য জাফরুল্লা। কমরুণও তা মেনে চলে। আসফাক কৈফিয়তের সুরে সেই নালিশ জানায় কমরুণকে। কিন্তু কমরুণ তার উপযুক্ত জবাব দিতে ব্যর্থ। একবার অভিমানে আসফাক বলে ওঠে, “দুয়ার দেও কমরুণবিবি।” এই বিচ্ছেদের দেয়ালের অপর নাম সম্পর্কের অবসান। যেন দরাম করা দরজা-বন্ধের শব্দ পাঠকের মনে ধ্বনিত হয়। বেজে ওঠে বিচ্ছেদের বেহালা-বেহাগ। যবনিকাপাত হয়ে যায় আসফাক-কমরুণে। সেই তো একদিন আসফাককে জাফরুল্লার গাবতান ভৈষ (গর্ভবতী মোষ) ধরে পালাতে বলেছিল। সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে মুন্নাফের আচরণ। আসফাকের সঙ্গে সে জাফরুল্লার নির্দেশে মালিকের মতো আচরণ করে। ‘মিঞা সাহেব’ সম্বোধন বাদ দিয়ে সে আসফাককে তার নাম ধরে ডেকে ওঠে।
এসব কিছু দেখে প্রতিশোধস্পৃহায় অন্তরে জ্বলে ওঠে অসহায় আসফাক। সে ষাঁড়ের মতো ক্রোধে আক্রান্ত হয়। আসফাক যেন মোষ মানুষের প্রতীক-চিহ্নিত আদিম মানব হয়ে ওঠে। কিন্তু মোষের মতো স্বাধীন হতে চাইলেও আসফাক স্বাধীন নয়। জাফরুল্লার বাথানে সারাজীবনের জন্য আবদ্ধ সে। একদিন বড়বিবি তাকে বলে, “তা আসফাক, এই পিথিমিতে যত জমি দেখো, তা সবই কোনো না কোনো জাফরের। এই যে বন দেখো, তাও একজনের।” পৃথিবীর জমির এই মালিকানা সত্যিই তাজ্জব ব্যাপার ! তা কখন কোন আইনের বলে দখল হয়ে, কবে কখন জানি, কারো-না-কারো অধিকারে চলে গেলো ! ভাবতে অবাক লাগলেও তা বুদ্ধিমান মানুষের লোভের ফল। একসঙ্গে দৃশ্যমান হওয়া অসম্ভব গোটা অরণ্য। আয়তনে এই এতো বিশাল অরণ্যের দিশা খুঁজে পায় না আসফাক। আশ্চর্যান্বিত হয়ে সে বলে: “এই এত বড় বন। যে বনের মালিক সে কি এতবড় বনকে আগাগোড়া চোখেই দেখেছে, যে তার হবে?” তখন বড়বিবি আবার বলে, “এই দেশের সীমার মধ্যে যত কিছু দেখো সবই কারো না কারো। বন তো শুনি এক মালিকের। তা তুমি যত দূরে যেখানে যাও, বনে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবে, সেই বনও, যাকে তুমি নতুন মনে করো, তাও সেই মালিকের।” আসফাকের কল্পনায় না আঁটা এই বিশালায়তন বনের মালিক জাফরুল্লা। তাই বড়বিবির গল্প শুনতে শুনতে তার ঘুম পেয়ে যায়। জমি ও জীবনের অধিকার-বঞ্চিত অসহায় আসফাকের মনে হয়: “কোথায় যাবে আসফাক জাফরুল্লার এক্তিয়ার ছাড়িয়ে?”
একটি অজ্ঞাত খুনে জাফরুল্লার হাজতবাস হয়। কিন্তু ফেরার সময় লক্ষণীয়, জাফরুল্লা ব্যাপারি বিশাল একটি ট্রাক্টর সঙ্গে নিয়ে আসে। বুনো মোষের জায়গা দখল করে আধুনিক কলের মোষ। আসফাক এই ট্রাকটাকে কলের মোষ হিসেবেই সম্বোধন করে। মানুষের কাঁধ সমান উঁচু কলের মোষের সঙ্গে কোনো মোষেরই লড়াই-জেতার ক্ষমতা হবে না। সে যতো দেখে ততোই অবাক হয়। যন্ত্রশক্তি আমদানির মধ্য দিয়ে এভাবেই মহিষকুড়া গ্রামের আধুনিকতার যাত্রা। পুঁজিতন্ত্রের লোভের ধারালো চকচকে ছুরির নিচে চাপা পড়ে অরণ্যের স্বাভাবিকতা। এভাবেই শোষিত-নির্যাতিত সাধারণ মানুষের অবজ্ঞাত ইতিহাস তৈরি হয়। এই ইতিহাসকে অমিয়ভূষণ যুক্ত করেন তাবৎ বিশ্বের ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে। যন্ত্র মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য উদ্ভাবন। কিন্তু তার দখল নিয়ে বসে আছে বিত্তবান গোষ্ঠী। তারা তৈরি হয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে।
তথাকথিত যে উপনিবেশ তৃতীয় বিশ্বের মানুষকে সভ্য করার ভার নিয়েছিল, তারা প্রকৃত অর্থে অবিমৃশ্যকারী। এই ভণ্ড ও ভাণ করা সভ্যতার প্রতিভূদের একহাত দেখে নেন লেখক। তারা তরবারিকে বানিয়েছে সংগ্রামের প্রতীক। লাঙ্গলকে প্রচার করেছে শান্তির প্রতীক হিসেবে। অথচ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ব্যধিগ্রস্ত করেছে বিশ্বকে। আর লাঙ্গল প্রত্নতাত্ত্বিক সভ্যতার প্রতীক হয়েও হয়েছে অমোঘ শোষণযন্ত্র। কৃষিজমি দখলের জন্য ঔপনিবেশিক শক্তির তৎপরতার ইতিহাস সে-কথাই স্মরণ করায়। তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষকে দাস বানিয়ে তারা তাদের লাভের ফসল নিজেদের ঘরে তুলেছে। তাদের ফরমায়েশ মাফিক তাবৎ বিশ্বের জমিহারা কৃষককে করতে হয়েছে কখনো নীলচাষ, কখনো তামাক, আফিম, মসলা কিংবা কফির চাষ। এদেরই ধ্বজাধারী হয়ে মানুষকে শোষণে নেমেছে জাফরুল্লার মতো দেশীয় শোষকরা। মহিষকুড়ার উপকথায় অমিয়ভূষণ মজুমদার তাই বলেন,
কিন্তু মুশকিল এই, সংগ্রাম ও শান্তির প্রতীক হিসাবে তরবারি ও লাঙ্গল ইউরোপের মানুষেরা এতো বেশি প্রচার করেছে যে এখন আমাদের পক্ষে লাঙ্গলের সঙ্গে লোভ শব্দটাকে যুক্ত করতে সঙ্কোচ দেখা দিয়েছে। লাঙ্গল যে মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির চিহ্ন হতে পারে, তা ভাবতেও অনিচ্ছা হয়।
লেখক: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন