১৯২৫ সাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জসীম উদ্দীন। ‘কল্লোল’ পত্রিকায় ‘কবর’ কবিতা ছাপা হলো। তিন বছরের ব্যবধানে তা পাঠ্যপুস্তকেও স্থান পেল। ‘কবর’ গ্রামজীবনকে ধারণ করে নিরেট ভাবাবেগের, সত্য ও সুন্দরে মোহবিষ্ট কবিতা। বাংলার প্রকৃতি, মাটি ও মননকে জসীম উদ্দীন ভালোবেসেছিলেন হৃদয়ের গভীর থেকে। বোদ্ধা সাহিত্যমহলে একরকম উপেক্ষিত ছিল পল্লি-প্রকৃতি ও লোক-ঐতিহ্য। শহর তখন আমাদের আধুনিক কবিদের তীর্থভূমি।
বিশ শতকের তৃতীয় দশকে জসীম উদ্দীনের আগমন। বাংলার কাব্য-অঙ্গন তখন সংখ্যাহীন গুণী লেখকে মুখর। আধুনিক কবিরা শহরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছেন পল্লিজীবনকে। দূর থেকে, কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে সেই দেখা। জসীম উদ্দীনের দৃষ্টি নৈর্ব্যক্তিক নয়, নিবিড়, সরল, আত্মগন্ধী। লোকজীবনে বসতি করা বাংলার পরম অংশীজনরা তখনো গেয়ে চলেছেন নিজেদের কথা, লিখে যাচ্ছেন হৃদয়গাথা। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র মধ্যে ধ্বনিত হয়েছিল গ্রামজীবনের মধুর স্বর। শহরের পাষাণ দেয়াল ভেদ করেছিল তার অন্তরঙ্গ অর্থ। তবুও গ্রামের কথা ও ভাষা থেকে গিয়েছিল গ্রামের মানুষেরই কাছে।
বাংলার পল্লিজীবন ছিল প্রকৃতির কোলে নিবিড়, প্রেমময় ও আবেগঘন। কিন্তু আধুনিক শহর মানে সংকট, জটিলতা ও নিঃসঙ্গতার কর্কশ ধ্বনি। মানুষ যে জীবনকে পূজা করছে, সে জীবনে শূন্যতার হাহাকার। বুদ্ধদেব বসু বলেন- ‘আমাদের জীবনের কেন্দ্র এখন সরে এসেছে শহরে, শহর এখন জীবনকে রূপায়িত করে, ধ্বংস করে, পরিপূর্ণ করে। শহরের মধ্যে, শহরে প্রাণের মধ্যে আমরা বাঁচি।’ স্পষ্ট যে, শহর কেবল ভৌগোলিক নিবাস নয়, এটি আধুনিক মানুষের বোধ, সংকট, আকাঙ্ক্ষা ও দ্বন্দ্বের প্রতীক হয়ে ওঠে।
অস্থির এই জীবনচিত্র- গ্রামীণ সরল আবহ থেকে আলাদা। বিপরীতে জসীম উদ্দীন ঐশ্বর্যময় পরম সুন্দর পল্লিজীবনের কথা বলেন। বাংলা কাব্যে প্রবেশ করা তার জন্য নিষ্কম্প পুকুরের সহজ সাঁতার ছিল না। তখন দুকূলপ্লাবী সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। তার স্মৃতিকথায় বলেছেন- ‘‘আমার কবিতা ‘প্রবাসী’তে পর্যন্ত ছাপা হইয়াছে। কিন্তু বাংলাদেশের চাষী জীবন ও পল্লী প্রকৃতি লইয়া যখন নিজস্ব স্টাইলে কবিতা লিখিতে আরম্ভ করিলাম, কোন পত্রিকাই আর আমার কবিতা ছাপে না।” ছয় মাস পড়ে থাকার পর ‘কল্লোলে’র পেছনের পাতায় ছাপা হলো ‘কবর’। দীনেশচন্দ্র সেন আন্তরিক ভাষায় লিখলেন: ‘দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মতো তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে কেঁদেছি।’ শিশুর সরলতায় ছাত্রের জবাব- ‘এমন কত কবিতাই ত রচনা করেছি; কিন্তু কোন ভাল মাসিক পত্রিকাই তা ছাপায় না। কবিতা লিখে আর কি হবে?’ পেছনে আরও এক ইতিহাস- ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ফেরত পাঠায় ‘মোহাম্মদী’ ও ‘প্রবাসী’। পরে বই হিসেবে ছাপা হলেও করতে হয় পুশ সেলিং। ‘বিচিত্রা’য় দীনেশচন্দ্রের সপ্রশংস প্রবন্ধ বের হলে বইটি হুড়মুড় করে বিক্রি হতে থাকে। নামকরা সব মাসিক পত্রিকা থেকে লেখার আমন্ত্রণ শুরু হয়। শুধু গুণী ছাত্রের কবিতার প্রশংসায় তিনি ক্ষান্ত হননি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে বিএ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালেই ‘কবর’ কবিতা পাঠ্য হয়। ১৯২৭ সালে ‘রাখালী’ কাব্যের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী নন্দলাল বসু। ‘গ্রামে আমার শিল্প কে বুঝবে?’ -কবির এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন শিক্ষাগুরু নন্দলাল। তিনি বলেছিলেন- ‘গ্রামীণ শিল্পের মধ্যেই আধুনিক শিল্পের মর্মবোধ।’
জসীম উদ্দীনের কাল আধুনিকতার, নাগরিকতার। ঠিক সেই সময়ে গ্রামীণ ভাষা আবেগ জীবন আর মাটির বর্ণ গন্ধ নিয়ে নতুনধারা সৃজন কঠিন বৈকি। তার কবিতা নস্টালজিক ও পরম মধুর, শোক ভাঙন বিচ্ছেদ প্রেম ও আত্মিকতায় ভরপুর। ‘কবর’ কবিতায়, ‘এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা, কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।’ -এ নিছক শব্দবন্ধন নয়। এর মধ্যে নিহিত গণনাহীন সময়ের বর্ণময় আবেগ। তাই জসীম উদ্দীন শুধু ‘লোককবি’ নন- তিনি ধ্রুপদী বাংলার কবি। মুখ ফেরানো শহুরে মধ্যবিত্তের কানে তিনি গ্রামীণ কবিতা পৌঁছে দিয়েছেন। তার কবিতা মাটির মতো, নরম ভালোবাসার, বিষাদঘন, হারানো কালের কথন। সবমিলে তা লোকজ আধুনিকতার স্মারক।
‘কবর’ প্রিয়জন হারানোর বেদনা ও স্মৃতি-রোমন্থনে ভরপুর। এটি মোহনীয় ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় লিখিত কাহিনি কবিতা, যাকে ‘ড্রামাটিক মনোলগ’ও বলা যায়। সন্দেহ নেই যে, ষাণ্মাত্রিক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত ১১৮ চরণের এ কবিতা জসীম উদ্দীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। এ ধরনের ব্যালাডের বৈশ্বিক তুলনা মেলে স্কটল্যান্ডের অজ্ঞাত কবির লেখা ‘Edward, Edward’, ইংরেজি সাহিত্যের ‘Lord Randal’, বা ওয়ার্ডসওয়ার্থের Lyrical Ballads অন্তর্ভুক্ত ‘Lucy Gray’-এর মতো কবিতায়। ইউরোপের বহু ভাষায় এ ব্যালাড পাওয়া যায়, যেমন ড্যানিশ, জার্মান, মাজার (হাঙ্গেরিয়ান), আইরিশ, সুইডিশ ও ভেন্ডিশ। এসব কবিতাও ‘কবর’-এর মতো সংবেদনশীল ও মৃত্যুকেন্দ্রিক- পারিবারিক শোকাচ্ছন্ন, বেদনাঘন, গ্রামীণ সরল। ‘কবর’ কবিতায় দাদি বাপ মা ফুপু ও বোন- প্রতিটি চরিত্র যেন বাংলার একেকটি সাধারণ পরিবারের প্রতিচ্ছবি। ভালোবাসা, আবেগ ও ভাঙা হৃদয়গাথায় দাদির মুখে নারীজীবনের মর্মান্তিকতা। কবিতাটি একদিকে শোকের, অন্যদিকে কৃষিনির্ভর পল্লির কথকতা।
শেমাস হিনি তার ‘Digging’ কবিতায় তুলে ধরেছিলেন আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস-রাজনীতি, কৃষিজীবনের স্মৃতি এবং পিতৃপুরুষের কথা। কৃষিজীবী পিতার প্রসঙ্গে তিনি পাঠককে নিয়ে যান শেকড়ের কথায়। জসীম উদ্দীনের ‘কবর’ পরম স্মৃতি ও মমতার। দাদুর কণ্ঠে ব্যক্ত হয় শোকাবহ স্মৃতির পারিবারিক ইতিহাস, অন্তরঙ্গ গ্রামজীবন। কবি রবার্ট ফ্রস্ট নির্মাণ করেছিলেন এক দার্শনিক, নির্জন ও অন্তর্মুখী পল্লিজগৎ। তার ‘The Road Not Taken’ কিংবা ‘Stopping by Woods on a Snowy Evening’-এ আমরা আত্ম-অন্বেষী চিরন্তন পথিকের দেখা পাই। জসীম উদ্দীনের কবিতা ‘কবর’ বা ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এও রয়েছে সেই অন্বেষণ, তবে তা দার্শনিক নয়, আবেগতাড়িত। ফ্রস্ট গ্রামকে দেখেন আত্মজিজ্ঞাসায়, জসীম উদ্দীন দেখেন ভালোবাসার পবিত্র সংলাপে। অন্যদিকে থমাস হার্ডি চিত্রিত করেছিলেন পল্লিজীবনের ক্ষয়, জসীম উদ্দীন সেখানে রচনা করেন জীবনের মোহনীয় আবেশ।
‘কবর’ কবিতার নস্টালজিয়া কোনো ব্যক্তির বিষাদ নয়, বরং তা হয়ে ওঠে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আবেগের সেতুবন্ধন। এখানে প্রতিটি কবর যেন একেকটি স্মৃতির মিনার। তাতে বিজড়িত হাসি কান্না বিয়ে খেলা প্রেম আশাভঙ্গ ও হাহাকার- যা মৃত্যুকে অতিক্রম করে যায়। তার স্বতন্ত্র কাব্যভাষা তাকে শুধু বাংলায় নয়, বিশ্বকবিতারও সমান্তরালে ধরে রাখে। এই কবিরা গ্রামজীবনের কোনো-না-কোনো দিককে তুলে ধরেছেন। গৌরবজনক কাব্য-ঐতিহ্যে, স্বতন্ত্রতার উজ্জ্বলতা নিয়ে জসীম উদ্দীন তাদের সঙ্গে একাকার। তার কবিতায় গ্রাম কেবল বিষয় নয়- তা তার হৃদয়ের ভাষ্য, আত্মপরিচয়ের চিহ্ন। শহুরে আধুনিকতার বিরুদ্ধ প্রবাহে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আর এভাবেই তিনি বাংলার গ্রামীণ জীবনকে কবিতায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন। ১৯৭৬ সালে জীবনাবসান ঘটে কবির। ফরিদপুর জেলার আম্বিকাপুর গ্রামে দাদির কবরের পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন