কারবালার শোকসাহিত্য : ‘মর্সিয়া’ ও ‘নওহা’

মর্সিয়া (مرثیہ) ও নওহা (نوحہ)—এই দুই প্রকার শোককবিতা কারবালার ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বহু শতাব্দীর পুরোনো সাহিত্যিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য রয়েছে এই ধারা দুটোর। বিশেষ করে উর্দু, ফারসি ও আরবি ভাষায় রচিত, পরে বাংলা সাহিত্য এর প্রভাবপুষ্ট হয়েছে। বাংলা ভাষার কবিরা কারবালার ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে মর্সিয়ার বৈশিষ্ট্যবাহী বহু শোকগীতি, ছড়া, গান, কবিতা রচনা করেছেন। মীর মশাররফ হোসেন গদ্যকার হলেও মর্সিয়ার আবেগ, কাঠামো ও উদ্দেশ্যকে রূপান্তর করেছেন। বস্তুত তিনি একটি স্বতন্ত্র শোকসাহিত্য নির্মাণ করেছেন। ‘বিষাদসিন্ধু’র অন্তস্থ ভাব ও আবেগ গদ্য-মর্সিয়া হিসেবে বাংলা সাহিত্যে অনন্য।

আলী আকবরের মৃত্যু এবং হোসেন (রা.)-এর কোলে তাঁর নিথর দেহ—মার্সিয়ার চরম বেদনাময় মুহূর্ত সৃষ্টি করে। যুদ্ধের আগে মায়ের মর্মবিদারক বিদায়, বোনের কান্না, পিতার নীরব সম্মতি সম্বলিত এই অংশটি মর্সিয়ার একেবারে কেন্দ্রীয় দৃশ্যের মতো। এ দৃশ্য উর্দু মর্সিয়ার ‘বিদায় দৃশ্যে’র পরম্পরা অনুসরণ করে। শুধু মুসলিম নয়, অন্য ধর্মের কবিরাও রচনা করেছেন মর্সিয়া। যেমন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮–১৯০৩) তাঁর কবিতায় লিখেছেন:

“হায় হোসেন! তব মহাবলী বক্ষে
নিদাঘ বর্শা বিদীর্ণ করে কে দিলে নিধন?”

মর্সিয়ার মূল থিম—শোক, বীরত্ব, আত্মত্যাগ প্রভৃতি ধ্বনিত হয়েছে এতে। যদিও তিনি সরাসরি মর্সিয়া লেখেননি, তবু ইমাম হোসেনকে নিয়ে তাঁর লেখায় যে আবেগ, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো, আত্মোৎসর্গের বন্দনা—তা মূলত মর্সিয়া ভাবের বহিঃপ্রকাশ। কবি কায়কোবাদের স্বরে সেই আবেগের প্রতিধ্বনি: 

কারবালা

এই কি কারবালা সেই? এই সেই স্থান?

এই সেই মহামরু? হেরিলে যাহারে

অশ্রু ঝরে দু’নয়নে কেঁদে ওঠে প্রাণ?

কত কথা পড়ে মনে, শিরায় শিরায়

প্রচণ্ড অনল-স্রোত হয় প্রবাহিত;

প্রাণের নিভৃত কক্ষে- হৃদয়ে- কন্দরে

কি যে এক শোক স্মৃতি হয় উচ্ছ্বসিত!...


গ্রামবাংলার মুসলিম সমাজে তাজিয়া, আশুরা, মিছিল উপলক্ষে আবৃত্তি ও গান আকারে যে সাহিত্য পরিবেশিত হয়, তা কার্যত মর্সিয়া-নওহারই রূপান্তর। বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলে আশুরা উপলক্ষে জারিগান ও নাটক হতো বা এখনো হয়। এতে কারবালার কাহিনি গীতিনাট্যের মতো পরিবেশিত হয়। আধুনিক বাংলা কবিরাও কারবালা ও ইমাম হোসেনের আত্মত্যাগকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যেমন কায়কোবাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ কবিতায়, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন তাঁর নাটকে ব্যবহার করেছেন। ‘চাকা’ নাটকে মৃত্যুর পর দেহ ফেরানো ও চূড়ান্ত শোক যেন আলী আকবর বা হোসেনের দেহ ফেরত না পাওয়ার ট্র্যাজেডির প্রতিধ্বনি। এই প্রতীকায়ন ও আবেগ মর্সিয়া ধারণার প্রভাবকে ইঙ্গিত করে। অনেকে সরাসরি মর্সিয়া না লিখলেও মর্সিয়ার অন্তস্থ বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেছেন। এটি সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে, যেখানে লোকঐতিহ্য, মরমী জ্ঞান ও শোকের অপূর্ব মিলন ঘটে।


‘মর্সিয়া’র মূল শব্দ "رثى" (রাছা) — যার অর্থ শোক প্রকাশ করা। আরবি ‘নওহা’র অনুসরণে তৈরি হয়েছে উর্দু মর্সিয়া বা শোককবিতা। লখনৌতে জন্মগ্রহণকারী উর্দু ভাষার সুবিখ্যাত মর্সিয়া-রচয়িতা মীর বাবর আলী আনিস (১৮০২–১৮৭৪)। মীর আনিস নামে খ্যাত এই কবি মর্সিয়া ও নওহা নামক কাব্যধারায় অমর কবি হিসেবে পরিচিত। ‘মুসাদ্দস’ ছন্দে তিনি লিখেছেন প্রায় দুই শতাধিক মর্সিয়া। ভাষার ব্যঞ্জনা, চরিত্রচিত্রণ ও আবেগে তাঁর কবিতাগুলো অতুলনীয়। মীর আনিসের মর্সিয়াগুলো দীর্ঘ, ছন্দবদ্ধ এবং গভীর আবেগপূর্ণ। তাঁর কবিতায় কারবালার ঘটনা অত্যন্ত হৃদয়বিদারকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, সেইসঙ্গে তা শৈল্পিকতারও অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর শোককাব্য ভাবের গভীর প্রকাশ, সেই সঙ্গে বেদনাবিধুর। মীর আনিসের মর্সিয়ার অংশবিশেষ— 

جبینِ شب پہ سحر کی لکیر چھوڑ گیا
حسین دشت میں کرب و بلا کی خِیر چھوڑ گیا

جو کربلا میں لُٹا، دین اُس کا وارث ہے
لہو کے سود میں قرآن کی تعبیر چھوڑ گیا۔


জবীন-এ শব পে সেহর কি লকীর ছোড় গয়া
হুসেন দশ্‌ত মে কার্‌বালার খায়ের ছোড় গয়া
জো কারবালা মে লুটা, দীন উস্‌ কা বারেস হ্যায়
লাহু কে সৌদ মে কুরআন কি তাবীর ছোড় গয়া।


[এর ভাবার্থ করলে যা দাঁড়ায় : হোসেন (রাঃ) এমন এক জ্যোতি এনে দিলেন, যা রাতের কপালে ঊষার রেখার মতো চিরন্তন আলোর চিহ্ন হয়ে রইলো। হোসেন কারবালার মরুভূমিতে দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও রেখে গেলেন শ্রেয় ও কল্যাণবোধ। যে ব্যক্তি কারবালায় সর্বস্ব উৎসর্গ করলেন, ধর্ম তো তারই উত্তরাধিকার। তিনি রক্তের বিনিময়ে রেখে গেলেন কুরআনের সত্য ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য।]


হোসেনের আত্মত্যাগ যেন অন্ধকার যুগে একটি নতুন সূর্যের সূচনা—যেন রাতের কপালেও তা জোৎস্নায় প্রতিফলিত আলোর প্রভা। তাঁর আত্মত্যাগ চরম দুঃখ ও যন্ত্রণার মধ্যেও মানবতার জন্য নিদর্শন ও আশীর্বাদ। আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে ন্যায়ের রক্ষক হিসেবে তিনি জগতবাসীর কাছে এক অনন্য দৃষ্টান্তরূপে প্রতিভাত হলেন। কারবালার আত্মত্যাগ কেবল যুদ্ধ নয়, বরং আত্মমর্যাদা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার প্রতীক হয়ে রইলো। দেখা যাক, মীর আনিসের আরও একটি মর্সিয়া— 

   ‘কারবালা কে ময়দান মেঁ যব শেরে-খুদা কা বেটা উত্রা’

কারবালা কে ময়দানে মে যব শেরে-খুদা কা বেটা উত্রা,
হর তরফ সে গম কে ছায়ে মে অন্ধেরা ঘিরা।

বচ্চা পিয়াসা, বুঢ়া পিয়াসা, ঔরতেঁ বেহাল,
খুদ হুসেন কা চেহরা ভি লাগা থা মালাল।

পর না রুকে থে, না ঝুকে থে, না ঝুকে ও কদম,
ক্যোঁকি থা উনকে সাথ, নানা কা দিয়া হুয়া আলম।


‘কারবালার প্রান্তরে যখন শের-এ-খুদা’র পুত্র অবতীর্ণ হলেন’

যখন আলীর বীর পুত্র নামলেন কারবালার প্রান্তরে ,

চারপাশে নেমে এলো ঘন আঁধারে ঘেরা বিষাদের ছায়া।

শিশু পিপাসার্ত, বৃদ্ধ পিপাসার্ত, নারীরা ক্লান্ত নিঃশেষে,
হুসেনের মুখেও তখন যেন বিষাদের চিহ্ন ভাসে।

তবুও চলেন না-থেমে, না মাথা নত করে, পেছনে না-হটে কিছুতেই,
কারণ তাঁর হাতে ছিল নানাজানের পতাকা – সত্যের মহিমায়।


মীর আনিস ছাড়াও মর্সিয়া রচয়িতাদের মধ্যে রয়েছেন—মির্জা দাবির, সিবত-ই-জাফর, জোশ মালিহাবাদি, অলতাফ হুসেন হালী, মুজফ্‌ফর আলী সিদ্দিকী প্রমুখ। ১৮০৩ সালে লখনৌতে জন্মগ্রহণ করেন মির্জা দাবির। তিনি ছিলেন মীর আনিসের সমসাময়িক ও প্রতিদ্বন্দ্বী কবি। মর্যাদাবোধ ও আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক ভাবনা অভিনিবেশে তাঁর কাব্যভাষা ছিল গভীর, সংক্ষিপ্ত, সামঞ্জস্যপূর্ণ তথা পরিমিতবোধের। তুলনা করতে গেলে—মীর আনিস ছিলেন সংলাপ-প্রধান আর দাবির ছিলেন ভাষা-প্রধান। অন্যদিকে আধুনিক উর্দু মার্সিয়া শিল্পী সিবত-ই-জাফর কেবল কবি নন, তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। তিনি একাধারে কবি, আবৃত্তিকার ও মজলিশের ধ্রুপদী গায়ক। মার্সিয়া পাঠে তিনি আবেগ ও আবৃত্তির ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করেন।


উত্তরপ্রদেশের জোশ মালিহাবাদি (১৮৯৮-১৯৮২) ‘শায়ের-ই-ইনকিলাব’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। বিপ্লবী স্বরে ইমাম হোসেনের আত্মত্যাগকে তিনি বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখিয়েছেন। প্রথাগত মর্সিয়ার বাইরে গিয়ে আধুনিক চৈতন্যে কারবালাকে ব্যাখ্যা করেছেন অলতাফ হুসেন হালী (১৮৩৭–১৯১৪)। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের সশস্ত্র বিদ্রোহ ও বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষদর্শী এই কবি ভারতের পানিপথে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মর্সিয়া ও নওহা মাতমের আবেগ নয়, বরং যুক্তি ও নৈতিকতার বোধে অতুল্য। ঐতিহাসিক ও চিন্তক শিবলী নোমানির (১৮৫৭ - ১৯১৪) কবিতা সংখ্যায় কম, কিন্তু ইমাম হোসেনের জীবন ও শাহাদত নিয়ে গদ্যরচনায় তিনি মার্সিয়ার মহত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। মুজফ্‌ফর ওয়ারসি (১৯৩৩ - ২০১১), মুজাফফর উদ্দীন সিদ্দিকী নামে আলহাজ্ব মুহম্মদ শরফ উদ্দীন আহমদের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যিনি সুফি ওয়ারসি নামে পরিচিত হন। তাঁর জন্ম ছিল মিরাটে, বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ, ভারতে। তিনি মর্সিয়ার সঙ্গে আধুনিক ইসলামি সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন ঘটান। তাঁর রচনায় কারবালা শুধু অতীতের ট্র্যাজেডি নয়, তা যেন সমকালীন চেতনার অগ্নিদাহন। 


‘নওহা’ (نوحہ) : আরবি কাব্যে কারবালা

يا حُسَينُ، غَرَّبَكَ القَومُ، وتركوكَ على الرِّمالِ ظَمآنَا.

হে হুসাইন! স্বজাতির মানুষ তোমাকে পরবাসে পাঠালো,

আর তৃষ্ণার্ত করে মরুভূমির বালুতে ফেলে রেখে গেল। 


মর্সিয়ার সমরূপী আরবি কবিতার ধারা নওহা (نوحہ)। নওহা-র অর্থ ‘বিলাপ’ বা ‘শোক প্রকাশ’। শব্দটি "نوح" (নূহ) ধাতু থেকে অর্থপ্রাপ্ত—যা বিলাপ, কান্না বা দুঃখপ্রকাশের কবিতা। একসময় আরবে যুদ্ধ বা কারও মৃত্যুর পরে নারীরা মুখে মুখে বিলাপ করতেন। তারা ছন্দে ছন্দে কবিতাকারে তাদের শোক প্রকাশ করতেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই রীতিই ধীরে ধীরে শোককাব্যে রূপান্তর লাভ করে, বিশেষত কারবালার (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) পরে। ইসলামপূর্ব আরব নারী কবি আল খানসা (জন্ম: আনুমানিক ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) যুদ্ধে তাঁর দুই ভাই শুমায়ল ও সাকারের মৃত্যুতে শোকগীতি প্রকাশ করেন। এই শোকগাথা আরব শোকসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। উম্মে সালমা ও উম্মে লুবাবা ইমাম হোসেনের শাহাদতের পরে শোক-নওহা পরিবেশন করেন। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) যুদ্ধ ও শাহাদত বিষয়ে আবেগঘন কবিতা লিখেছেন—যদিও তাকে সরাসরি নওহা বলা হয় না, কিন্তু ঐ কাব্যের আবহ ও শোকধারার উৎস তিনি নিজেই। তের শতকের একজন বিখ্যাত মিশরীয় সুফি কবি মুহাম্মাদ ইবনে সাঈদ আল-বুসায়রির কাসীদা আল-বুরদা কাব্য ধর্মীয় আবেগের উপর ভিত্তি করে রচিত—যদিও নওহা নয়, তবুও তা একই আবেগীয় ধারার পরিচয়বাহী হয়ে ওঠে।


মূলত কারবালার শহিদদের স্মরণে মর্সিয়ারূপ শোকগীতি গাওয়া হয় ইমাম হোসেন ও তাঁর পরিবার-পরিজনের জন্য। কারবালার ময়দানে হযরত আলী (রা.) ও ফাতেমা (রা.)-র কন্যা হযরত জয়নাব (রা.)-এর আর্তনাদ নিয়ে প্রচুর নওহা, মর্সিয়া, কবিতা, নাটক প্রভৃতি রচিত হয়েছে। নওহা কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর মজলিশি আবহ। যেমন—

(نَادَت زَيْنَبُ يَا حُسَيْنُ! — ‘নাদাত জাইনাবু ইয়া হুসাইন’— ‘জয়নাব বললেন, হে হুসেন!’)

نادَت زَيْنَبُ يا حُسَين، قُمْ وانظُر إلينا،
الرُّؤوسُ على الرِّماح، والأَطفالُ عَطاشى.
يا سَيِّدَ الشُّهَداء، دَمُكَ يُنادي: "أينَ العَدْل؟"
يا ابنَ فاطِمة، لِمَ تُتْرَكُ جُثَّتُكَ على التُّراب؟

জয়নাব বললেন: হায়! হুসেন! উঠে দেখো আমাদের দিকে,
বর্শার ফলার চূড়ায় মাথাগুলো উঠেছে, শিশুরা কাঁদছে তৃষ্ণায়।
হে শহিদদের নেতা, তোমার খুন যেন টগবগ করছে: “ন্যায় কোথায়?”
হে ফাতেমার পুত্র, কেন তোমার দেহ লুটায় মাটির ধূলায়? (অজ্ঞাত কবি)


উক্ত কবিতায় জয়নাব (রা.)-এর কথা বর্ণিত হয়েছে। হোসেন (রা.) শহিদ হন এবং বাকি পরিবারকে বন্দি করা হয়। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পরও অনেকে থাকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে। এই মানুষদের মধ্যে জয়নাব অন্যতম। তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা ও জুলুমের সত্য সবাইকে জানান দিতেন। কারবালার ঘটনার বৃত্তান্ত বিশ্বের সামনে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কারবালার পরপরই শাম শহরে বন্দি জীবন কাটাতে হয় তাঁকে। সে সময় তাঁর নেতৃত্ব ও ধৈর্যের জন্য তিনি প্রখ্যাত হয়ে ওঠেন। অসাধারণ বক্তৃতা ও তর্কের মাধ্যমে তিনি নানারকম বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। ইমাম হোসেন (রা.)-এর ত্যাগকে অক্ষুন্ন রাখার সংগ্রামে তিনি যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। তাঁর সাহস, ত্যাগ ও নেতৃত্ব আজও স্মরণীয়, যা নওহা নামক আরবি কবিতার পরম্পরাগত ঐতিহ্যিক সম্পদ হয়ে উঠেছে।  


কখনো এককভাবে, কখনো সমবেতভাবে নওহা পাঠের সংস্কৃতি প্রচলিত। এগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে, রুদ্ধ ও কান্নাভেজা কণ্ঠে পাঠ করা হয়। নওহা এমনভাবে সুরের দোলা দিয়ে আবৃত্তি করা হয় যেন প্রতিটি শব্দে যথার্থ শোক ফুটে ওঠে। যে শোকে গোটা কারবালা মুহ্যমান, হৃদয়শোকে তা দ্রবীভূত হয়ে যায়।


ফারসি কবিতায় মর্সিয়া

ষোড়শ শতাব্দীর সাফাভি আমল থেকে ফারসি ভাষায় মর্সিয়া কবিতা গঠনশৈলীতে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। উপমা, রূপক, বর্ণনাত্মক দৃশ্য ব্যবহারে ফারসি মর্সিয়ার আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। ফারসি কবিতায় কারবালার যুদ্ধ, তৃষ্ণা, শহিদ হওয়া ও জয়নাব (রা.)-এর বিলাপ দৃশ্য চিত্রধর্মীভাবে উপস্থাপিত। হৃদয়স্পর্শী আবেগ, কান্না, আহাজারি—সবই এই সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। মুহতশাম কাশানী (১৫২৮/২৯–১৫৮৮) তাঁর ‘হোসাইনিয়া দেহ্-বন্দ’ (দশপদী মার্সিয়া) কারবালার কাহিনি। ওয়াহশি বাকফি (১৫৩২-১৫৮৩) তাঁর মার্সিয়া ‘হোসেন নামা’ অতুলনীয়, যা কারবালার দৃশ্যাবলি তুলে ধরে। তিনি একাধিক আবেগঘন মর্সিয়া রচনা করেন, যেখানে বিশেষভাবে আলী আকবর, হযরত আব্বাস এবং অন্যান্য শহিদদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগকে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন মমতা ও বর্ণনামূলক জীবন্ত ভাষার মিশ্রণে—যেমন: শহিদদের মা বা বোনদের হৃদয়বিদারক যন্ত্রণার চিত্র-অঙ্কনে তাঁর কবিতা ছিল অনন্য। তিনি ফারসিতে মার্সিয়ার এই দশপদী রচনাকে এতটা জনপ্রিয় করেন যে ‘হোসাইনিয়া দেহ্-বন্দ’ বলতে মুহতশাম কাশানী রচিত দশ-পঙ্‌ক্তির ছন্দে গ্রথিত কারবালার শোকগাথা বোঝায়।


ফারসি মার্সিয়া শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। ফারসি সাহিত্যে মর্সিয়া একদিকে যেমন ধর্মীয় শোক-আচারের সাহিত্যময় রূপ, অন্যদিকে তেমনই মানবতাবাদ, প্রতিবাদ ও নৈতিকতার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। কারবালা এখানে শুধু ইতিহাস নয়, বরং চেতনার এক জীবন্ত উৎস।


বাংলায় প্রভাব

কারবালার চিরশোকে আচ্ছন্ন আরবি শোককবিতা ‘নওহা’র ঐতিহ্য থেকে ফারসি ও উর্দু সাহিত্যে মর্সিয়ার উদ্ভব। সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যে এর প্রবেশ ও বিকাশ। অন্যদিকে আঠারো শতকে বাংলা দোভাষী পুথিসাহিত্য উর্দু ও ফারসি মর্সিয়ার সুস্পষ্ট প্রভাবে রচিত। মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতান, শেখ ফয়জুল্লাহ, মুহম্মদ খান, হায়াৎ মাহমুদ, ফকির গরীবুল্লাহসহ অন্যান্য মুসলিম কবিরা কারবালার ঘটনাবলি—বিশেষত ইমাম হোসেনের আত্মত্যাগ, আলী আকবর, হযরত আব্বাস ও শহিদ পরিবারের বেদনাকে কেন্দ্র করে বাংলা ও ফারসির সংমিশ্রণে শোককাব্য রচনা করেন। ফারসি সাহিত্যের ‘দাস্তান-ই-জং’ ঘরানা ছিল মৌখিক কাহিনিমূলক কাব্য, যা মুসলিম বিশ্বের নানা যুদ্ধের ঘটনাকে তুলে ধরতো। বাংলা মুসলিম কবিরা এখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কারবালার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ‘জঙ্গনামা’ লিখেছেন, যা অনেকটা মর্সিয়া-ঘরানার সাথে মিলে যায়। এই রচনাগুলোতে রয়েছে মর্সিয়ার বর্ণনাশৈলী, আবেগঘনত্ব, ধর্মীয়ব্যঞ্জনা ও আত্মদানের কথা। মর্সিয়ার মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত ‘বিদায়ের দৃশ্য’, ‘মাতম’, ‘বীরত্বের মুহূর্ত’ ইত্যাদি এই কবিতাগুলোর বৈশিষ্ট্য। এ কবিতার ছন্দে কখনো কখনো পাওয়া যায় ‘মুসাদ্দস’ বা দীর্ঘ পঙ্‌ক্তিযুক্ত গদ্যকবিতার ছাপ। এগুলোর ভাষা সহজ, বর্ণনা বেশ সরল ধাঁচের এবং অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। নানাকারণে তা গ্রামীণ মুসলিম সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এমনকি অন্য ধর্মাবলম্বীরাও কারবালার শোক ও আবেগে আন্দোলিত হন। এসব কবিতা পুথি আকারে আশুরা, তাজিয়া ও মজলিশি আসরে পাঠের জন্য ব্যবহৃত হতো।


বাংলা সাহিত্যে এই মর্সিয়া নামক শোকধারার প্রভাব অনেক। এটি বাংলা সাহিত্যকে ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করে দিয়েছে। আবেগ, নৈতিকতা ও আত্মত্যাগের কাহিনির মাধ্যমে উৎপত্তি ঘটে এক নতুন কাব্যরসের। নারী চরিত্রগুলোর (যেমন: জয়নাব, রুকাইয়া) কণ্ঠে ব্যথা ও প্রতিবাদের প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে নারী-চৈতন্যের রূপরেখা তৈরিতে সহায়ক হয়। দোভাষী রীতি বাংলা সাহিত্যে ফারসি-উর্দুর শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে এবং সাহিত্যকে নতুন অভিব্যক্তি দান করে। এসব শোককাব্যের মাধ্যমে চিরায়ত গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ তাদের নিজস্ব আবেগ ও ভাষা লাভ করে, যা তাদেরকে আত্মোৎসর্গের আদর্শ অনুধাবন করতে শেখায়। ক্রমশ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নওহা ও মর্সিয়ার প্রভাব প্রতীকী ও মানবিক চৈতন্যে উদ্ভাসিত হয়। ইমাম হোসেন (রা.) নামটি আজও আত্মত্যাগ, প্রতিবাদ, ন্যায়, সংগ্রাম ও আত্মশক্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক কবিতায় ‘কারবালা’ হয়ে ওঠে নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতীকী যুদ্ধক্ষেত্র। কাজী নজরুল ইসলামের ‘মোহররম’ যেন সেই চৈতন্যের ফসল—যা একই সঙ্গে চরম বেদনাবহ এবং পরম ঐতিহ্যের স্মারক—

“নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া –/

আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া,/

কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে?/

সে কাঁদনে আসু আনে সিমারের ও ছোরাতে।

…মহরম কারবালা কাঁদো হায় হোসেনা/

দেখ মরু সূর্য এ খুন যেন শোষে না।”




খোরশেদ আলম, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন