সাত বছর আগে (২৪ এপ্রিল ২০১৮) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি বেলাল চৌধুরী চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আজীবন স্বপ্ন ফেরি করা মানুষটির জোটেনি স্থায়ী আবাস, এমনকি হয়নি স্থায়ী জীবিকার উপায়। সুদর্শন বলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাকে ডাকতেন ‘যুবরাজ’। সিনেমার নায়কের মতো এক জীবন যাপন করেছেন তিনি। শৈশব-কৈশোরের ফেলে যাওয়া অতীত তাকে টানত। ছোটবেলায় রেলগাড়ির ড্রাইভারকে ভাবতেন অসাধারণ স্বপ্নময় মানুষ। ঠিক একদিন সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলারে চেপে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। কুমির চাষ, পেরেকের ব্যবসা, পুস্তক বাণিজ্য- বিচিত্র পেশা ধরেছেন ও ছেড়েছেন। স্বাপ্নিক, সাহসী, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষের মতো সব ঘটনা। তবে ওসব কিছুতেই ফেল করে তিনি হয়ে উঠলেন কবি, কথাকার, সাহিত্য সংগঠক। বোহেমিয়ান জীবনযাপনের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের চেয়েও তিনি যেন একধাপ অগ্রসর।
বেলাল চৌধুরী ছিলেন ‘পদাবলী’ কবিতা সংগঠনের প্রাণপুরুষ। কলকাতায় ‘কৃত্তিবাস’, বাংলাদেশে ‘পদাবলী’- উভয়ের লক্ষ্য অগ্রবর্তী চৈতন্য নির্মাণ। ‘পদাবলী’ জনভিত্তিক, আধ্যাত্মিক, ঐতিহ্যনিষ্ঠ, আধুনিকতার সংমিশ্রণ- যার প্রভাব পড়েছে তার রূপক, উপমা, প্রকৃতি ও ভাবরুচিতে। এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য না হলেও তার কাব্যচিন্তা, ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীল নেতৃত্ব উত্তরকালেও স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শক্তির প্রভাব আত্মস্থ করে এক নতুন শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তরুণ কবিদের পথনির্দেশে তার উৎসাহ ও ঔদার্যের মধ্যে ছিল সেই ছায়া। বিশেষত নব্বইয়ের দশকের প্রজন্ম তার ভাষার স্বাচ্ছন্দ্য, চিন্তা ও আলোকধারায় আবেশিত।
ব্যতিক্রমী এই মানুষটির গ্রন্থপাঠ কিংবদন্তিতুল্য। বিশ্বসাহিত্যের সর্বভুক পাঠক হিসেবে শুধু নয়, তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তচিন্তক, অসাম্প্রদায়িক, অমায়িক, বন্ধুপ্রিয় ও তারুণ্যঘেঁষা। নিঃস্বার্থ ও পরোপকারী বৈশিষ্ট্যের জন্য তিনি ছিলেন দুই বাংলার লেখকদের সংযোগ সেতু। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- ‘নিষাদ প্রদেশে’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘স্থিরজীবন ও নিসর্গ’, ‘স্বপ্নবন্দী’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘কবিতার কমলবনে’, ‘যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে’ ও ‘বত্রিশ নম্বর’।
বেলাল চৌধুরীর কবিতায় প্রকৃতি প্রেম, সহচর ও দর্শনের প্রতীক। তার স্মৃতি-নস্টালজিক কবিতার উপকরণ যেন প্রকৃতির স্নিগ্ধস্বর। গন্ধমাখা ‘নীল জামা’ তার বাল্যস্মৃতির প্রতীক। ‘আত্মপ্রতিকৃতি’তে চিহ্নিত সরল সৌন্দর্য- ‘সারাদিন আমি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে/ কী দেখেছিলাম? ভাট ফুল, আকন্দের ঝোপঝাপ/ মাছরাঙাদের অকারণ খিটিমিটি?/ গ্রামীণ ছবিতে আজ আর নেই সেই কিংবদন্তীখ্যাত/ মসলিন, নকশিকাঁথার দিন!/ রোগা দুঃখী নদী,/ কুলুকুলু শব্দ বা গরুর খুরে ধুলো ওড়া কাব্যিক গোধূলি।’ গ্রামীণ রূপক-প্রতীকের আড়ালে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে অন্তর্জগতের ভাষ্য। ‘সেই সুখ’ কবিতায়ও মেলে সমপ্রতিধ্বনি। আসলে জীবন মানে অপূর্ব হৃদস্পন্দন। পাখিদের এ ডালে ও ডালে ঘোরাঘুরি আনন্দময় স্বভাব-প্রতীক। ‘তুমি সেই বৃক্ষ’ কবিতায় ‘বিটপী’, ‘শাল’, ‘সেগুন’, ‘ঝাউ’- প্রকৃতির রহস্যঘেরা- অটল হয়েও তা নমনীয় কোমল। বৃক্ষখুনি সেখানে কুঠার ফেলে রচনা করে ভালোবাসার গান। জীবনের জটিলতা-বিভ্রান্তি-বিশৃঙ্খলার বিপরীতে তিনি হতে চেয়েছেন দৃঢ়-পরিশীলিত-নান্দনিক। কঠোরতা ও কোমলতার ভারসাম্যে রয়েছে মুক্তির দর্শন। মানুষ এমন বদলে যাবে- সহিংসতাও যেখানে স্থবির হয়ে যায়।
‘স্বদেশ’ কবিতায় প্রেমিকার ‘আঁচল ছোঁয়া নীলাম্বরী মেঘে’ জীবনের গভীর প্রশান্তি। এই জীবন বেলাশেষের রোদের মতো আত্মনিবেদিত। আবেশপূর্ণ জীবনের জলছবিতে প্রভাসিত চিরায়ত গ্রামবাংলা- ‘তোমার যেমন ইচ্ছে, আছি আমি-/ ঝিরিঝিরি পাতার ভেতর ভেতর হাওয়ার নাচে/ রাত্রিদিন তোমার ধানের ক্ষেতে/ উদাসী বাউল; ভাটিয়ালি গান ভেসে/ যায় কোন নিরুদ্দেশে; আছি আমি/ বেলা শেষের রোদের মতো/ গড়িয়ে তোমার পায়ে পায়ে’...। প্রকৃতি ও প্রেমিকার শরীর ও মানস যেন একাকার। প্রেম পরম, কখনো চরম ব্যথার; কখনো তা স্মৃতিছায়াচ্ছন্ন, নিরেট নিঃসঙ্গ। ‘সন্ধ্যার মত নিঃসঙ্গ’ ধ্রুপদী উপমা হয়ে ওঠে, যেখানে লীন হয়েছে সময় ও আবেগ, কিন্তু উবে গেছে প্রেম- ‘এখন আমি সন্ধ্যার মত নিঃসঙ্গ/ কেউ ফিরে আসে না ঘরে, যেমন ফিরে আসে না ছায়া/ নির্দিষ্ট কাঠামো থেকে…।’
বেলাল চৌধুরীর কবিতায় রাজনীতি প্রকট নয়, বাংলাদেশের ইতিহাস, স্বাধীনতা, দেশভাগ আসে প্রতীকীভাবে। ‘যে ধ্বনি চৈত্র শিমুলে/ রক্তের মতো ফুটে ওঠে প্রান্তরের ধুলোয়/ সে ধ্বনির ভাষা আমি বুঝি না/ তবু কান পেতে শুনি।’ চৈত্র, শিমুল, রক্ত, প্রান্তর, ধুলো শব্দগুচ্ছ বাংলার ভূমি, ঋতু, সময় ও ইতিহাস। ইতিহাস এখানে রহস্যময়তার অন্তরালবর্তী। জীবনানন্দের মতো তা ‘কবিতার অস্থির ভিতরে’ ‘ইতিহাস চেতনা’, যার ‘মর্মে’ ‘পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।’ তার অনেক কবিতা অস্তিত্ব, কাল ও নৈঃসঙ্গের অপ্রতিম চিহ্ন। পৌরাণিক দেবতা বা বীরযোদ্ধা হয়ে ওঠে তার অনুভব- ‘আমার গোপন পাপগুলি এতদিন পর/ বিরূপ-বৈরিতায় শস্ত্রপাণি হয়ে উঠেছে’। অন্যদিকে ‘কুলাঙ্গার’ কবিতায় মেকি গণতন্ত্রের উল্লাসী কুরাজনীতিকে তিনি অভিশপ্ত বলতে নির্দ্বিধ।
শিল্পীর আত্মজিজ্ঞাসা, সামাজিক দ্বিধা কবিতায় তৈরি করে একধরনের আত্মজৈবনিক নাট্যরূপ। ফলে গালমন্দও হয়ে ওঠে শৈল্পিক। তার কণ্ঠে মানিয়ে যায়- ‘শালা শুয়ারের বাচ্চা’। ‘খর্বকায় বামনের গান’ কবিতায় আত্মগর্বিত মিথ্যাকে তিনি আক্রমণ করেন- ‘ওরে ও, বুড়ো হাবড়া’, ‘বরকনদাজি গুল গল্প’, ‘বার ফট্টাই’ ইত্যাদি বলে। আবার চরম একাকিত্বে অনিকেত-উদ্বাহু হয়ে আত্মপ্রতারক আধুনিকতাকে তিনি পরিহাস করেন, যার পূর্বপুরুষ হয়তো বাংলাদেশের অখ্যাত গ্রামগঞ্জের কৃষিজীবী। এজন্য বলেছেন- ‘অধুনা আত্মপ্রতারণায় নগরনিবাসী আমি…’
বেলাল চৌধুরী জীবদ্দশায় যা পেয়েছেন, তা একজীবনে অতুল্য। দেশ-বিদেশে স্বীকৃতি, পুরস্কার, সম্মাননা, সর্বোপরি তিনি জনপ্রেমে সিক্ত হয়েছেন। ভৌগোলিক সীমানার ঊর্ধ্বে কবি বেলাল চৌধুরী ছিলেন সার্বভৌম মানব। তার অনুপম হাতে অনূদিত হয়েছে বোর্হেস, নেরুদা, ডিলান টমাস, অক্তাভিও পাস প্রমুখ। তিনি ছিলেন জীবনের পাঠশালায় স্বশিক্ষিত মানুষ। দিলদরিয়া, বন্ধুপ্রতিম, অন্তরঙ্গ সুহৃদ মানুষটির প্রয়াণের বেহাগ সুর বেজে উঠেছিল তার নিজেরই কবিতায়-
‘নির্বাসনে মৃত্যুদণ্ড- ঠাণ্ডা চোখে দেখছি আমি
নীল কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে আমার দেহ।’
https://www.khaborerkagoj.com/golden-line/860497
খোরশেদ আলম, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন