ঔপন্যাসিক জহির রায়হান

 দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত : লিঙ্ক.খবরের কাগজ.কম

পিতামাতার ইচ্ছে ছিল মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ খান ডাক্তার হবেন। কিন্তু অনুরাগবশত বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হলেন। রায়হান নামে প্রবেশ করলেন লেখার জগতে। তারপর মূল নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হলেন জহির রায়হান। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ফিকহ্ শাস্ত্রের শিক্ষক হয়েও পিতা ছিলেন ধর্মপ্রাণ, আদর্শবান ও উদারপ্রাণ। মাতা সৈয়দা সুফিয়া খাতুনের লেখাপড়া নবম শ্রেণি পর্যন্ত কিন্তু ছিলেন সচেতন মানুষ। বৃত্ত ভাঙার অন্তর্দৃষ্টি ও সত্যনিষ্ঠা ছিল তাঁর মধ্যে।  

ঔপন্যাসিক জহির রায়হান : সময়, সমাজ ও মানুষের অন্তরঙ্গ পাঠ


৩৬ বছরের জীবন! ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি নিখোঁজ হলেন। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে আর ফিরে আসা হলো না। বেঁচে থাকলে জহির রায়হানের হাত দিয়ে নির্মিত হতো অগ্নিঝরা জীবনের আরো অনেক কথকতা। তিনি হতে পারতেন পৃথিবীখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা। তবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এদেশের রাজনীতিসচেতন সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং আপোসহীন সাংবাদিক। তিনি একাধারে কাহিনিকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা, চিত্রগ্রাহক ও প্রযোজক। সেকালের প্রথম রঙিন ছবি ‘সংগম’, প্রথম সিনেমাস্কোপ ‘বাহানা’ তিনিই নির্মাণ করেন। 


তখন তিনি হাইস্কুলের ছাত্র। নিরীহ বাঙালির ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার চলছে। খুবই অল্প বয়সের লেখা কবিতায় তাঁর যে মনোভাব প্রকাশিত, তা যেন বহমান থেকেছে আমৃত্যু: “ওদের জানিয়ে দাও,/ওরা আমার ভাই-বোনকে কুকুর বিড়ালের মত মেরেছে/ওদের স্টীম রোলারের নিচে…।” প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দেশকালের সংকটের মধ্য দিয়ে কেটেছে জহির রায়হানের ছাত্রজীবন। ঢাকাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজের স্বপ্ন  সম্ভাবনার নতুন দেশ ও চৈতন্য নির্মাণের অংশীদার হয়েছেন তিনি। দেশের অনুভবেই স্নাত হয়েছেন আজীবন। 


বাংলা উপন্যাসে জহির রায়হান জীবন, রাজনীতি ও ইতিহাসকে এক করে গড়ে তুলেছেন বহুমাত্রিক ও বাস্তব শিল্প। ভাষা-আন্দোলন, নিপীড়িত মানুষ, স্বপ্ন, নাগরিক সংকট কিংবা বিশ্ব রাজনীতি—সবকিছুই সেখানে প্রতিফলিত। মাত্র আটটি উপন্যাস লিখেও তিনি কথাশিল্পের আঙিনাকে ঋদ্ধ করেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলোতে সময়ের বিবর্তন স্পষ্ট। তাঁর চিন্তায় মানবতাবাদ তীব্র অন্তঃস্রোতী। 


‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ (১৯৬০) জহির রায়হানের প্রথম উপন্যাস। মানুষের একাকিত্ব, আবেগ, প্রেম ও প্রত্যাখ্যান এর কেন্দ্রীয় ভাবনা। কাসেদের জীবনযাপন একেবারে সাধারণ হলেও তার ভেতরে অসংখ্য না বলা কথা, চাপা আবেগ ও শূন্যতা। অপ্রকাশিত প্রেম যেন নাড়ার আগুন। দহন ও নিঃসঙ্গতার আখ্যানটি যেন হয়ে ওঠে নিঃশব্দ মানুষের আত্মপ্রতিবেদন। ‘তৃষ্ণা’ (১৯৬২) উপন্যাসেও রয়েছে প্রেম ও যাপনের মধ্যে দ্বন্দ্বের ছবি। এটি যেন ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’র রোমান্টিক উত্তরসূরি। কিন্তু এখানে প্রেম শুধু হৃদয়াকাঙ্ক্ষা নয়, সামাজিক বাস্তবতার নিরিখ। তা কেবল বাধা আর অনিশ্চয়তার সুতীব্র দোলাচল।


পরবর্তী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ (১৯৬৪) আবহমান গ্রামীণ বাংলার বহুল পরিচিত ছবি। ধর্ম, সংস্কার, দারিদ্র্য ও প্রেম—সবকিছু এখানে নিত্যসঙ্গী। তারা ছায়ার মতো চলেছে চরিত্রগুলোর পেছনে। টুনির চরিত্র, মকবুলের মৃত্যু কিংবা পরীর দীঘির পাড়ে দাঁড়ানোর দৃশ্য—এসব শুধু গ্রামের গল্প নয়, বরং হাজার বছরের বঞ্চনার হলাহল। এখানে রয়েছে কৃষকের প্রবল দুর্দশা, সমাজের সীমাহীন স্তব্ধতা। এক অনুপম ভাষায় পরিবর্তনের অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা এখানে প্রকাশিত।


ঐতিহাসিকভাবে ‘আরেক ফাল্গুন’ (১৯৬৯) ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা প্রথম উপন্যাস। মুনিম, আসাদ, সালমা, ডলি—চরিত্রগুলো রাজনৈতিক আদর্শে দীপ্ত, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বেও জর্জরিত। প্রেম ও রাজনীতির দোদুল্যমান সংকট এতে জটিল অভিজ্ঞতায় সঞ্চারিত। লেখকের দৃঢ় বিশ্বাস, অন্যায়ের সঙ্গে থাকতে হবে নিরাপোষ। এই চেতনা পাঠকের রক্তে আগুন জ্বালিয়ে রাখে।


চতুর্থ উপন্যাস ‘বরফ গলা নদী’ (১৯৬৯) প্রতিবাদ ও নিঃশেষিত স্বপ্নের কথকতা। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা এক শহুরে মুসলিম পরিবারের অসহায়ত্ব, ক্ষোভ, যন্ত্রণা প্রভৃতি প্রকাশ পেয়েছে এতে। রাজনীতিসচেতন মাহমুদ বাস্তবে অসহায়, ভুক্তভোগী। পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে তার ভিতরে জমে থাকে তীব্র সংক্ষোভ। বৃহত্তর সমাজ-সংকটের রূপ তুলে ধরে এ উপন্যাস যেন হয়ে ওঠে এক প্রবল জাগরণ—সামন্ততন্ত্র ও শহুরে ভণ্ডামি যেখানে সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ। 


‘আর কত দিন’ (১৯৭০) উপন্যাসটি লেখকের অনবদ্য নির্মাণকৌশলের উদাহরণ। এখানে বাস্তবতা ও প্রতীকের অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে। কাঠের বাক্সে বন্দি যন্ত্রণাদগ্ধ একদল মানুষ। তপু ও ইভা পালিয়ে বেড়ায়। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার সংকট দেখা দেয়। এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর সন্তানের মৃত্যুদৃশ্য অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। সব মিলিয়ে এতে যুদ্ধ ও মানবতার দ্বন্দ্ব প্রতীকী ভাষায় উপস্থাপিত। আখ্যানে যেন এক পরম বিশ্ববোধ ছড়ানো। 


‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ (১৯৭০), নামেই বোঝা যায় এটি ভাষা আন্দোলনের সাহসী শিল্প-চিত্র। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার চরিত্রে উঠে আসে রাষ্ট্রভাষার দাবির প্রতি জনগণের প্রত্যয়। চাষি গফুর, ছাত্র তসলিম, কবি আনোয়ার কিংবা রিকশাচালক সেলিম—সকলেই নতুন চৈতন্যের বাহক। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামী চেতনা পাঠকের হৃদয়েও স্পন্দন তোলে। অন্যদিকে ‘কয়েকটি মৃত্যু’ স্বপ্ন তাত্ত্বিক উপন্যাস। একসময় স্বপ্ন, হস্তরেখা, আধিভৌতিকতার চর্চা করেছেন জহির রায়হান। পিতা ও পিতৃব্যের আকস্মিক মৃত্যুর স্মৃতি তাঁকে তাড়া করেছে সবসময়। আহমদ আলী চরিত্রের অবচেতন মানসলোক যেন সেখান থেকেই তৈরি। মৃত্যু-সংকেতময় দুঃস্বপ্ন দর্শন করে সে। সংকটগ্রস্ত মনের চিত্র-অংকনে উপযুক্ত আলোক ফেলতে সক্ষম হয়েছেন লেখক। নারী চরিত্রে তিনি দেখান যে, আত্মকেন্দ্রিক ভাবনা কখনো মাতৃত্বকে স্পর্শ করে না। এক অনন্য স্বপ্নকল্পনাময় পরিস্থিতির উপস্থাপনায় তিনি অন্তর্গত জীবনসত্যকেই উদ্ভাসিত করেছেন। প্রতীকী মৃত্যুর অবভাস তৈরি করে তিনি ব্যতিক্রমী এক আখ্যান নির্মাণ করেছেন।  


জহির রায়হানের উপন্যাসগুলো ধারাবাহিকভাবে পাঠ করলে সময় ও পরিস্থিতির বিচিত্র অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মানুষের ছবি পাওয়া যায়। লেখক হিসেবে তিনি সময়ের প্রতি সম্পূর্ণ দায়বদ্ধ। তবে সেই দায় তিনি চাপিয়ে দেননি, বরং চরিত্রদের মধ্য দিয়ে তা প্রগলভ বয়ানে উঠে এসেছে। তাঁর উপন্যাসের ভাষা সংযত, প্রাঞ্জল ও অতলস্পর্শী। আখ্যানে সঞ্চারিত আবেগ, সমাজের নিষ্ঠুর বাস্তবতা ও মানবতার স্বপ্ন—সবকিছুর সংমিশ্রণে জহির রায়হানের উপন্যাস হয়ে উঠেছে অবিস্মরণীয় কালের কথন। তাঁর উপন্যাসে বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্তর্গত বিবর্তন ধরা পড়েছে। তাঁর প্রতিটি রচনায় প্রতিধ্বনিত হয় একেকটি প্রবল বার্তা। তিনি যেন বলতে চান—প্রতিবাদ করো, প্রশ্ন তোলো, আর স্বপ্ন দেখো অনাগত সুন্দর দিনের।


লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন