মো ইয়ানের সাতকাহন | খোরশেদ আলম

ভোরের কাগজে প্রকাশিত 

১০৯তম নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন চীনের ঔপন্যাসিক মো ইয়ান। একটি সাধারণ কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন তিনি। নানা চড়াই-উৎরাই পেরোনো চরম ও বর্ণাঢ্য এক জীবনাভিজ্ঞতারও তিনি অংশীদার। চীনের একসময়ের শক্তিশালী লেখক লুশুনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ফকনারের আঞ্চলিকতা, অন্যদিকে মার্কেজের ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিটির শৈল্পিক অভিজ্ঞা যেন তাঁর কথাশিল্প। তবে শিল্পের নিজস্ব পথটাও তৈরি করেছেন তিনি। ম্যাজিক্যাল রিয়্যালিজম না বলে বরং হ্যালুসিনেটরি রিয়্যালিজম বলেই তাকে ব্যাখ্যা করা সমীচীন। ফ্রাঞ্জ কাফকা কিংবা জোসেফ হেলারের মতো পাশ্চাত্যের সাহিত্যিকদের শক্তিমত্ততার সঙ্গে তাঁর ক্ষমতাকে তুলনা করেছেন কেউ কেউ। তবে ঐতিহ্যবাহী চিনের সমস্ত শৈল্পিক ও সাহিত্যিক কলাকৌশলকে আত্মস্থ করে ইয়ান তাঁর শিল্পের মনোভূমি প্রস্তুত করেছেন। একদিন হংকং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবার সময় তিনি নিজের নাম পাল্টানোর ঘোষণা দেন। প্রকৃত নাম গুয়ান মোয়ে বদলে হন মো ইয়ান। চীনা ভাষায় এর অর্থ—‘কথা বলবো না’। একজন স্বতঃস্ফূর্ত বাগ্মী হওয়া সত্ত্বেও লেখক হিসেবে তাঁর এই নাম ধারণ একটু ব্যতিক্রমই বৈকি, যা ভাবিয়েও তোলে। আসলে কি তিনি কথা বলবেন না বলে ঠিক করেছিলেন? জবাব তাঁর কর্মপ্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত। মো ইয়ান তাঁর কথাশিল্পে কথা বলেছেন, তবে এক বিভ্রমাত্মক বাস্তবতার ঘোর সৃষ্টি করে। যার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘হ্যালুসিনেটরি রিয়েলিটি’। এই বিভ্রমাত্মক বাস্তবতা বা হ্যালুসিনেটরি রিয়্যালিটি সৃষ্টি করে তিনি যে জগতের সন্ধান দিয়েছেন তাকে ‘কথা বলবো না’ নাম না দিয়ে আর কীই বা দেয়া যেতো। লোককাহিনী, ইতিহাস ও সাম্প্রতিক চীনকে ধারণ করতেই তিনি ব্যবহার করেছেন এক বিভ্রম-সৃষ্টিকারী কল্পনার জগৎকে। গ্যাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতোই রাজনৈতিক ও সামাজিক জটিলতার এক বিশ্বকে উদ্ভাবনার শীর্ষ বিন্দু দিয়ে বয়ন করেছেন তিনি। তাতেই তিনি ব্যবহার করেছেন অতিমাত্রায় মানস-বিভ্রমকারী এক শৈল্পিক ভাঙচুরের পৃথিবী। ১৯৮১ সালে ফলিং রেন অন অ্যা স্প্রিং নাইট নামক উপন্যাসের মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যে অভিষেক ঘটে তাঁর। শ্যাঙডঙ প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম গাওমিতে তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালে। নানারকম শিক্ষা বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধানটাই তাঁর জীবন-জটিলতার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়ার জন্য ৩৬ বছর বয়স আমাদের হিসেবে একটু বেশিই বৈকি। একজন রাখালের জীবন থেকে পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে প্রতিস্থাপন করেছিলেন সাহিত্যজগতে। তাঁর ক্রুদ্ধ পিতা একরকম জোর করেই তাঁকে মাঠে গবাদি পশু চরাতে বাধ্য করতেন। চরম একাকীত্ব বোধ তাঁর শিল্পসৃষ্টির প্রেষণা হিসেবে কাজ করে। ‘একটি নিঃসঙ্গ বালক সারাদিন গরু চরিয়ে ফিরছে’— চীনের জাতীয় গণমাধ্যম সিসি টিভিতে সাক্ষাৎকারে তিনি সে কথাগুলোই বলেছেন— তাঁর সাহিত্য জীবনারম্ভের প্রাথমিক উপাদান বা প্রেরণা হিসেবে। সে অনুভূতিকে তিনি ব্যক্ত করেন এভাবে, “আমি তখন দেখতাম নীলাকাশ, সাদামেঘ, সবুজ ঘাস, ঘাস ফড়িং, ছোট ছোট বিচিত্র প্রাণী কিংবা গবাদি পশু। আমি সত্যি খুবই একাকী ছিলাম। কখনো কখনো আমি গান গাইতাম, হয়তো ঘুরে-ফিরে একই গান গাইতাম বিভিন্ন সুরে, কখনো গরুগুলোর সঙ্গে কথা বলতাম।” এই তিক্ত অভিজ্ঞতার এক কৈশোরকে ভাষায় প্রকাশ করতে শব্দ খুঁজে বেড়ান তিনি।
আঞ্চলিক সাহিত্য সমগ্র শিল্পবিশ্বের এখন আলোচিত ও প্রতিনিধিত্বশীল বিষয়ের একটি। আঞ্চলিক অভিজ্ঞতাকে একজন লেখক বৈশ্বিক অনুভবের মাধ্যমে শৈল্পিক করে তোলেন। মো ইয়ান সেই বৈশ্বিক শিল্পানুভূতির জগতটাকে ঠিকই ধরতে পেরেছেন। ফলে তিনি তাঁর সাহিত্যে আঞ্চলিকতার মধ্যে আন্তর্জাতিকতাকে স্থান দিতে পেরেছেন আন্তরিকতার সঙ্গেই। ভাবতে আশ্চর্য—অজপাড়া গাঁ গাওমিতে জন্মে কৈশোরত্তীর্র্ণ ২০ বছর বয়স অবধি নিজের গ্রামের বাইরেই তিনি পা রাখেননি। একথা সাহিত্যের পাঠকদের উইলিয়াম ফকনারকে মনে করিয়ে দিবে সহসাই। যিনি তাঁর সাহিত্য-পটভূমি ইয়োক্নাপাতোফা অঞ্চলের বিশ কিলোমিটারের মধ্যে বন্দী রেখেছিলেন। মো ইয়ান ২০ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে (পিএলএ) যোগ দেন। তারও আগে দারিদ্র্যের চরম কশাঘাত তাঁকে বাধ্য করে তেল উৎপাদনকারী একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতে। স্কুলের পড়ালেখায়ও ছন্দপতন ঘটে তাঁর। বাবা-মার চতুর্থ সন্তান মো ইয়ানের চরম দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও নিঃসীম জীবনযুদ্ধের সঙ্গে তখন থেকেই পরিচয়।
১৯৮১ সালে সেনাবাহিনীর সাংস্কৃতিক একাডেমিতে তাঁর শিক্ষকতা শুরু হয়, এর সঙ্গে শুরু হয় লেখক জীবনও। ১৯৮৭ সালে দ্য রেড সর্ঘাম নামক উপন্যাস চীনের সাহিত্য-জগতে বলা যায় একটি বিস্ফোরণের মতো। এ-উপন্যাস নিয়ে আমেরিকায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ঝাং ঈমন। দ্য রিপাবলিক অব ওয়াইন, লাইফ অ্যান্ড ডেথ আর ওয়েরিং মি আউট, বিগ ব্রেস্ট এন্ড ওয়াইড হিপস প্রভৃতি উপন্যাসসমূহ তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি। এছাড়াও দ্যা গার্লিক ব্যালাডস, হোয়াইট ডগ সুইং, ম্যান অ্যান্ড দ্য বিস্ট, সোয়ারিং, আয়রন চাইল্ড, দ্য কেয়ার, লাভ স্টোরি, শেন গার্ডেন অ্যান্ড এবান্ডন চাইল্ড, স্যান্ডালউড ডেথ, চেঞ্জ, পাউ প্রভৃতি উপন্যাস; গল্পসংকলন— এক্সপ্লোশন অ্যান্ড আদার স্টোরিজ এবং ইউ উইল ডু এনিথিং ফর আ লাফ ইত্যাদি রচনার কথাও উল্লেখ করা যায়। মো ইয়ান তাঁর সাহিত্যের জন্য চীনসহ বিশ্বের নানা উল্লেখযোগ্য পুরস্কার লাভ করেন নোবেল পাবার আগেই। ফ্রগ নামক উপন্যাসের জন্য চীনের মূল্যবান ‘মাও দুন’ পুরস্কার পান ২০১১ সালে। ২০০৯ সালে প্রকাশিত এ রচনা চীন সরকারের এক সন্তান নীতিকে ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরে। উপন্যাসে মধ্যবয়স্কা এক নারী চীনের এক সন্তান নীতির সমর্থক। কিন্তু একদিন অস্বাভাবিকভাবে হ্যালুসিনেশনের মধ্যে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক শুনতে পান তিনি। আসলে মাতাল অবস্থায় ঐ নারী তার গর্ভপাতকৃত সন্তানদের বিলাপ-ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন।
মো ইয়ান ইংরেজি ভাষায় অপারদর্শী। কিন্তু প্রায় ইংরেজি না জানা এই লেখক সম্পর্কে ‘চায়না ডেইলি’র কলামিস্ট র‌্যামন ঝউ-এর ভাষ্যে— মো ইয়ানের রচনার অনুবাদই অন্যান্য লেখকের তুলনায় সবচেয়ে বেশি হয়েছে চীনে। বহুদিনব্যাপী যেসব অনুবাদকগণ তাঁর রচনা অনুবাদে সহযোগিতা করেছেন মো-এর নোবেলপ্রাপ্তিতে তাঁদের অবদান অস্বীকার করার নয়। শুধু ইংরেজি নয় অন্যান্য ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে তাঁর একাধিক রচনা। চীনাসাহিত্যের একজন উচ্চাকাক্সক্ষী লেখকের অভিধাও তিনি অর্জন করেছেন এসব কারণে। আধুনিক চিনা উপন্যাসে মাস্টার পিস রচনায় তাঁর সাফল্য পৃথিবীর অনেক বড় মাস্টার পিস রচনাকারী মহৎ ঔপন্যাসিকদের কথা স্মরণ করায়। কৃষক জীবন নিয়ে লেখা দ্য রেড সর্ঘাম নিয়ে করা চলচ্চিত্র এ কারণে আমেরিকায়ও প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। সবচেয়ে আলোচিত এই উপন্যাস রাজনৈতিক হঠকারিতার শিকার কৃষক জীবন-জটিলতার আখ্যান। তাঁর উপন্যাস বাস্তবার্থেই বৃহত্তর ব্যাপ্তিকে ধারণ করে। চৈনিক জীবন, মানুষ ও তাদের মহান সাংস্কৃতিক উপাদান তথা লোক-ঐতিহ্যকে অঙ্গীকৃত করেছে এ রচনা। কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘পিপলস ডেইলি’ মো ইয়ানের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে যে মন্তব্য করে, “এই প্রথম একজন চাইনিজ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। তার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা ছিল। এমনকি চীনের সাধারণ মানুষরাও এ অপেক্ষার অংশীদার।”
বিগ ব্রেস্ট এন্ড ওয়াইড হিপস বিতর্কিত উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত। দশ বছর পূর্বে লেখা এ উপন্যাসটি রাষ্ট্র কর্তৃক বাতিল বলেও ঘোষিত হয়। কিন্তু চাইনিজ সিভিল ওয়্যার শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বইটি বেস্টসেলারে পরিণত হয়। মার্কিন অনুবাদক হাওয়ার্ড গোল্ডবাট কেটেছেঁটে অনুবাদ করলেও এ উপন্যাসের চরিত্রসমূহের কারণে এটি শেষপর্যন্ত দৈত্যসদৃশ। কাহিনীতে চরিত্রসমূহের ক্রিয়াশীলতা ইন্ডিয়ানা জোন্স মুভিকেও যেন হার মানায়। মো নিজেই বলেন, “আমার উপন্যাসকে অগ্রাহ্য করা যাবে কিন্তু বিগ ব্রেস্ট এন্ড ওয়াইড হিপস পড়তেই হবে।” এ উপন্যাসে আছে ইতিহাস, যুদ্ধ, রাজনীতি, ক্ষুধা, ধর্ম, ভালোবাসা এমনকি যৌনতার তীব্রতা। অনুবাদক গোল্ডবাট শঙ্কিত হয়ে বলেছিলেন, “আমি ভীত, উপন্যাসটির নামকরণের কারণে নারীবাদীরা আমাদেরকে ক্রুশবিদ্ধও করতে পারেন।” কিন্তু আসলে তা নয় বরং তারা আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন। কারণ বিগ ব্রেস্ট যেন নারীর ক্ষমতাপ্রাপ্তিরই অভিষেক। তৎসঙ্গে তা পুরুষদের প্রবঞ্চনার ও মেকিত্বের জ্বলন্ত এক উদাহরণ, যা পৃথিবীর পুরুষতান্ত্রিকতার প্রাচীনত্বকেই স্মরণ করায়। মো ইয়ান শাঙ্গুয়ান লু নামক এক নারীর গল্প বলেন যিনি কুইং রাজ্যে শেষ দিন জন্মগ্রহণ করেছেন। ছোটবেলা থেকে পদবন্ধ অবস্থায় তিনি পালিত হন। উত্তর গাওমি গ্রামের নপুংসক এক কামারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। হাঁ করা মুখের, নাকের শিকনি পড়া ও বাইরের পৃথিবীতে অচল এই লোক। সে আত্মবিশ্বাসহীন এবং মেনিবিড়ালের মতো মায়ের কাছে বন্দী থাকে সবসময়। একটি মাত্র সন্তান কামনায় অধীরা লু পরকীয় সম্পর্কের মধ্যে ৭টি সন্তান লাভ করে। লিডি (ভাইপ্রিয়), প্যান্ডি (ভাই-আভাস), লিয়ান্ডি (ভাই-প্রত্যাশী) প্রভৃতি নাম রাখা হয় তাদের। পাস্তর মালোয় নামক একজন সুইডিশ মিশনারির সঙ্গে মিলিত হয়ে লু একটি পুত্রসন্তান উৎপাদন করে। জিনটং নামক হলদেটে চুলের অধিকারী এই ছেলেটিই আবার এ উপন্যাসের ন্যারেটর। স্বভাবে সে চরম স্বার্থপর ও একগুঁয়ে ধরনের। বয়োসন্ধিকাল এলেও সে মাতৃস্তন্য পান করা ছাড়ে না। নির্লজ্জ জিনটং তার ধৈর্যচ্যুত মাকে প্রশ্ন করে, “তুমি কি নিঃশেষিত না হওয়া পর্যন্ত আমাকে দুগ্ধ পান করাতেই থাকবে?”
বস্তুত গণতান্ত্রিক চীনের জন্ম, জাপানের আগ্রাসন, জনযুদ্ধ, গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, মুদ্রাস্ফীতি, জিয়াওপিং শাসন নানা ঘটনার ঘনঘটায় পূর্ণ বিগ ব্রেস্ট এন্ড ওয়াইড হিপস উপন্যাসের জগৎ। কাহিনীতে জিনটং-এর বোনরা একে একে যুদ্ধে মারা যায় এবং অন্য ভাইবোনরাও নিঃশেষিত হয়। মো ইয়ানের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি অন্যান্য উপন্যাসের মতোই বিদ্রƒপাত্মক। কম্যুনিস্ট শাসনের পতনোন্মুখ সময়ে সাধারণ মানুষ জিনটং-এর মায়ের মতোই সমগ্র দেশের খাদ্য জোগাতে থাকে। জিনটং স্বীকার করে, ‘একটি সুন্দর স্তন দেখলেই আমার মুখে লালা জমতে থাকে’। এই দুর্বলতা তাকে পাহাড়সম মুশকিলের সামনে দাঁড় করায়। তাঁর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে তারই চাচাত ভাইয়ের নতুন এক ব্যবসায়। কিন্তু কিছুদিন পরে আবার ভাগ্য বিরূপ হতে থাকে। এটি তখন সেই সমাজ যা জিনটং-এর মতোই ব্যবহারেরও অযোগ্য। বস্তুত এর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে সমকালীন চীনের রাজনৈতিক জটিলতার সাতকাহন। সর্বোপরি নারীদের সামাজিক অবস্থাটাও এ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়। মাও-সে-তুঙ এর সেই মহান বাণী, ‘ওমেন হোল্ডস আপ হাফ অব দ্য স্কাই’—যেন খসে খসে পড়ছিল এক চরম দুর্দিনের মুখোমুখি হতে হতে। মো ইয়ানের দীর্ঘ বর্ণনায় শৈল্পিক শক্ত বাঁধনেই সে সব চিত্র যেন আঁকা হয়েছে অত্যন্ত ভীতিকর, অপ্রীতিপদ ও হৃদকম্পনযুক্ত এবং একইসঙ্গে মহাকাব্যিক ধরনের কাহিনী বয়ানে।
মো ইয়ানের লেখা শক্তিশালী, দৃশ্যপট বিশালায়তনিক ও ব্যাপ্তিতে সুবৃহৎ। হাজার বছরের বিক্ষুব্ধ ইতিহাসে তিনি অনায়াস পরিভ্রমণ করেছেন। স্মৃতি-বিধুরতা, ফ্যান্টাসি, অ্যাবসার্ডিটি—সমন্বয়ে চীনা জনজীবন অঙ্কনে প্রতিশ্রুতিশীল কথাকার তিনি। ২০০০ সালে জাও জিংজিয়ান নামক এক ফ্রেঞ্চ-চাইনিজ নোবেল পেলেও চীনা সরকার সে নোবেল পুরস্কারকে গ্রহণ করেননি। সাহিত্যে পাশ্চাত্য ধ্যাান-ধারণার অনুরক্তি তাকে বিতর্কিত লেখকের দুর্নাম এনে দেয়। উল্টোদিকে কঠোর বাস্তবতা ও তৃণমূল মানুষের চিত্রকে সাহিত্যে যথাযোগ্য স্থান দিয়ে মো ইয়ান স্বদেশবাসীর কাছে একজন বড় লেখক নয় শুধু বরং ব্যাপক পঠিত লেখকেরও সম্মান অর্জন করেছেন। সুইডিশ একাডেমির প্রধান পিটার ইংলান্ড মন্তব্য করেছেন, “তিনি এমনই একজন লেখক যার রচনার আধা পৃষ্ঠা পড়লেও মহৎ শিল্পসৃষ্টিকারী মহান এক সাহিত্যিককে চীনে নিতে বেগ পেতে হয় না।” বলাবাহুল্য মহৎ লেখক হিসেবে তাঁকে এই চিনে নিতে পারাটা মো ইয়ানের স্বাতন্ত্র্যকেই প্রকাশ করে।
এতোকিছুর পরও মো ইয়ান সম্পর্কে ভিন্ন মন্তব্যেরও অভাব নেই। ইউ শিচুন নামক একজন বেইজিং ভিত্তিক প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক মো ইয়ানের নোবেলপ্রাপ্তিকে নিতান্তই একটি ‘আকস্মিক ব্যাপার’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “তিনি সাহিত্যে নতুন কিছু করেছেন বলে আমি মনে করি না। ১৯৮০-র দিকে তিনি ল্যাটিন আমেরিকার লেখালেখি দ্বারা প্রভাবিত হন। তাই চৈনিক সাহিত্যে তিনি অভিনব ব্যাপার ঘটিয়েছেন এ-বিষয়ে আমি দ্বিমত পোষণ করি।”
কিন্তু সুইস একাডেমির প্রধান পিটার ইংলান্ড তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করেন তা ইউ শিচুনের ঐ খরখরে সমালোচনা থেকে পুরোপুরিই আলাদা। তিনি বলেন, মো ইয়েন এমন একজন লেখক যিনি, “অ্যা ইউনিক ইনসাইট ইন্টু অ্যা ইউনিক ওয়র্ল্ড ইন অ্যা কোয়াইট ইউনিক ম্যানার।” যার অর্থ হচ্ছে—“তিনি বিশালত্বের অনুভূতি ও অন্তর্ভেদী এক দৃষ্টি অভিষিক্ত হয়ে মহৎ এক শিল্পের জগত নির্মাণ করেছেন।” তিনি আরো বলেন, তাঁর শিল্প—“যেন শব্দের ঝর্ণাধারা, যার গল্পের ভেতরে গল্প, গল্পের সঙ্গে গল্প, তার ভেতরে গল্প এবং সেই গল্পের মধ্যে গল্প থাকে। তিনি এক ঐন্দ্রজালিক লেখক।”
অবশ্য মো ইয়ানের কিছু লেখা প্রতিক্রিয়াশীলতা কিংবা অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন কেউ কেউ। কেউ করেছেন নির্মম সমালোচনা। তবুও তা সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টাদের কাছে নিন্দনীয় হয়নি শুধু এ কারণে যে, তিনি চৈনিক জনজীবনের অন্তর্লোককে ধারণ করেছেন, তাকে অভিব্যক্ত করেছেন অত্যন্ত ঐতিহ্যিক ও স্বাদেশিক এবং শেকড়ের সঙ্গে সমীকৃত করে। বিক্ষুব্ধ সাম্প্রতিক রাজনীতি, জনজীবন, লোক-পরম্পরা ও জনপদের সুদীর্ঘ সময়ের ইতিহাসকে সঙ্গে করেই নিরীক্ষার সকল স্তর অতিক্রম করে গেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বোধ করি অকুণ্ঠভাবেই তিনি একজন সফল ও প্রথম শ্রেণীর আন্তর্জাতিক মানের লেখকের অভিধা পাওয়ার দাবি রাখেন।
লেখক : শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

(লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ভোরের কাগজে : শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর ২০১২)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন