রবীন্দ্রনাথকে সরলীকরন, ভুলবোঝা এবং আরো

এই গদ্য চিহ্ন লিটলম্যাগে প্রকাশিত প্রবন্ধের অংশবিশেষ
*রবীন্দ্রনাথের নোবেল নিয়ে বিতর্ক কেন?  
*রবীন্দ্রনাথ কি সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের লোক?
*কী ছিল তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবনা। 
*ভ্রমণ ও চিঠিপত্রের রবীন্দ্রনাথ কেমন?
                                                      
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তির শত বছর অতিক্রান্ত। ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাল কিংবা মন্দ দু ধরনের সমালোচনাই হয়েছে এবং বিস্তর। তাঁকে কেউ প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়েছেন, কেউ নিন্দার ভারে তরীটিই ডুবিয়েছেন। নোবেল পাওয়া বা না-পাওয়া রবীন্দ্রনাথকে আড়াল করলেও রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বদল হয়নি। প্রশ্ন জাগে, সাহিত্য-রসিক তথা বোদ্ধাজনের কাছে তাঁর প্রতি আবেগের খুব কম-বেশি হত কি? 


অনেকেই বলে থাকেন, রবীন্দ্রনাথ তো নোবেল পেয়েছেন ইংরেজি গীতাঞ্জলি লিখে। তাদের কথাও ঠিক (!!) নইলে বছর বছর ইংরেজি-বিভাষীরা নোবেল পেতে যাবেন কেন? তাদের নিজের ভাষাতেই নোবেল পান কীনা (!!)।

অনুবাদের হাত ধরেই তো এ-পুরস্কারটা হাতে ওঠে। সি.এফ.এনড্রুজ তাঁকে লিখে দিয়েছিলেন (!!) কবি ইয়েটস, রোদেনস্টাইন প্রমুখ তাঁর জন্য ধন্না দিয়েছিলেন (!!)- এইসব বাখোয়াজিও কম হয়নি। রবীন্দ্র-বিরোধিতার এরকম অনাচার শুরু তাঁর নোবেল পাবার কিছুদিন পরেই। মূলত ইউরোপ আমেরিকার বিখ্যাত বিখ্যাত পত্র-পত্রিকা নানাভাবেই এ-বিষয়টাকে কুটিল করে তোলে। বাদবাকী বিশ্বেও সমানভাবে তারা উপস্থাপন করে। নোবেল পরবর্তী জটিল ইউরোপবিশ্বে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে ব্যাখ্যাত হলেন-- সে-কথা আমাদের সবারই প্রায় জানা। এর অনেকখানিই তাদের অসূয়াবশত। অশ্বেতাঙ্গ আর ইউরো-মার্কিন সেন্টারের বাইরের একজন লেখকের প্রতি তীব্র ঈর্ষা। আরো বলা যায়, নয়া যুদ্ধ, দমন আর উপনিবেশ নামক খপ্পরের মধ্য দিয়ে আধিপত্য লাভের বিকৃত ইচ্ছা। অন্যদিকে শান্তিকামী, অপেক্ষাকৃত কোমল ও আধ্যাত্মিক সুরের রবীন্দ্রনাথকে একহাত দেখে নেয়া।

এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু ও আবু সয়ীদ আইয়ুব রবীন্দ্রনাথকে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করেছেন। বুদ্ধদেব বসুর মতে, রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ইউরোপীয়দের চোখে ঋষি কবি। গীতাঞ্জলির আত্মনিবেদনের সুর খটমটে ইংরেজদের মনে ধরেনি। কারণ যুদ্ধ ও রক্তপাত করে, সভ্যতার কলঙ্ক গায়ে মেখে, শান্ত সুরের রবীন্দ্রনাথ তাদের আর ভাল লাগার কথা নয়। 

অনেকে বলেন, নোবেল না পেলেই বরং বাংলা সাহিত্যজগতে রবীন্দ্রনাথ অবিতর্কিত থাকতেন। এসব কথাবার্তা আসলে একধরনের উটকো মজরা রবীন্দ্রনাথের এই কথাটা স্মরণ রাখা জরুরি- মোর নাম/ এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদেরই লোক/ আর কিছু নয়-/এই হোক মোর পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের আপন মানুষ- এর চেয়ে বড় পরিচয়  তিনি দেননি। 

রবীন্দ্রনাথকে তেলতেলে-জ্যালজ্যালে ভাবের কবিও ভাবেন কেউ কেউ। দূরাচারী রোমান্টিক, রহস্যময় প্রহেলিকাময় কল্পনার কবি হিসেবে তাকে বহু আগেই পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তাদের কাছে বোধকরি রবীন্দ্রচিত্তের এই গভীর অনুভববেদ্যতা ধরা পড়েনি :

চাষি খেতে চালাইছে হাল,/
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-/
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার,/
তারি পরে ভর দিয়া চলিতেছে সমস্ত সংসার।/
অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চির নির্বাসনে/
সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।
(ঐক্যতান, জন্মদিনে)

রবীন্দ্রনাথ জমিদার ছিলেন। সেটা তাঁর জন্ম-নিয়তি, নিজের দোষ নয়। এই পারিবারিক জমিদারিত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজেই নতজানুও হয়েছেন বারবার।‘সমাজের উচ্চমঞ্চে সংকীর্ণ বাতায়নে’ বসা নিয়ে তাঁর সঙ্কোচভাব ওপরের কবিতায় লক্ষণীয়।  পত্রপূটে’ও রবীন্দ্রনাথ তা খণ্ডন করেছেন,

আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন,/
সকল মন্দিরের বাহিরে/
আমার পূজা আজ সমাপ্ত হল/
দেবলোক থেকে মানবলোকে

তবুও আমাদের ভরিল না চিত্ত ! মনের ভেতরে তিনি কী পুষে রাখতেন আর কী যন্ত্রণার ভার বয়ে বেরিয়েছেন সারাজীবন তা তাঁর আত্মস্মৃতিগুলো সন্ধান করলে পাওয়া যায়। অচিনপুরে সহসা যাঁর মন যেতে চায়, নিম্নজনের মাঝেও সেই-কবিকেই প্রত্যক্ষ করা  যায়নি কি বারংবার? কি শিলাইদহে কি নাটোরে কি বোলপুরের শান্তিনিকেতনে-সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথের সমাজ-উপলব্ধির দিকে আমাদের দৃষ্টি যায়। তিনি শিল্পমননে জীবনযাপনে ছিলেন অনেকখানি সাম্যসুধী। 

বিশেষ এক তর্কে একজনকে বলেছিলাম, বড় বড় কথা বলছেন, আপনাকে জমিদার বানানো হোক, দেখা যাবে জলসাঘরে পড়ে আছেন সারাক্ষণ।

এ-কথা বলার পর রবীন্দ্র-বিষয়ক তর্কটা আর বিশেষ জমেনি। কেন জমেনি, তা বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক এই জমিদারির তর্কটি খুব ভালোও শোনায় না-- কি পক্ষে কি বিপক্ষে। রবীন্দ্রনাথে সবচে বড় সত্য ছিল জীবন-জিজ্ঞাসা। যার ফলেই তিনি দার্শনিক কবি। তিনি যে এখনো আমাদের ভাবনাজগতকে এতখানি আবিষ্ট করে রাখেন তার কারণও বোধ হয় তা-ই।

যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত না গাওয়াই ভালো। আমার আলোচ্য রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদী চিন্তার ধরন-ধারন। অন্যদিকে তাঁর কম আলোচিত বিষয় চিঠিপত্র ও ভ্রমণের রবীন্দ্রনাথ। আর সেসবেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কতটা শক্তিমত্ত চিন্তা ও প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন তা নিয়ে।

আত্মশক্তিকালান্তর কিংবা সভ্যতার সঙ্কট নামক প্রবন্ধগ্রন্থসমূহে জাতি-জাতিগঠন-রাষ্ট্র-রাজনীতি-সভ্যতা প্রভৃতি নিয়ে তিনি বিস্তর কথা বলেছেন। ব্যক্তিগত চিঠিপত্র কিংবা ভ্রমণকাহিনি-এসবে আটঘাট বেধে শক্ত কথা বলার দরকার পড়ে না। তবুও তাঁকে আজানু রোমান্টিক-কল্পনাপ্রবণ আর ঋষিত্বের (শশ্রুমণ্ডিত বলেই বেশি চোখে ধরে কীনা!) তিলক পরিয়ে দেয়া হয়। সেই ভাবপ্রবণ মানুষটাই জাতিক-আন্তর্জাতিক সঙ্কটে বুকভরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলেন। তার প্রমাণ বিভিন্ন সময়ে লেখা তাঁর ব্যক্তিগতপত্র ও ভ্রমণকাহিনি। সিএফ এন্ড্রুজ, রোমাঁ রোলাঁ, ইয়েটস্ প্রমুখ অনেকের কাছেই লেখা চিঠিপত্রে রবীন্দ্র মনের প্রবল হতাশা টের পাওয়া গেছে। তাঁর ইউরোপ ভ্রমণ নিয়ে লেখাগুলোতে ইউরোপের সামূহিক বিনষ্টি ও পাপকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন তিনি।   

জাতি-জাতীয়তা-রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে রবীন্দ্র-ভাবনা বর্তমান যুগসঙ্কটেও সচল বা সমসাময়িক। একজন রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনীতিবিদ না হয়েও তিনি আন্তরিক সমাধান দিতে চেয়েছিলেন মানুষে-মানুষে ভাল থাকার কৌশলী উপায় আবিষ্কার করে। একজন কবি বা সাহিত্যিক তো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তাঁকে যুগান্তরের মানব-সম্প্রদায় তাহলে স্মরণ করে কীসের ভিত্তিতে? যদিও সমাজ-রাষ্ট্র সবসময় (অপ)শক্তিমানদের নিয়ম ও দখলদারিত্বেই চলে। সাহিত্যিকের অস্ত্র তাঁর কলম। সময়-অসময় লাঠি উচানো তাঁর কাজ নয়, শোভনও নয়। তবু একজন সাহিত্যিক সমাজের সত্যদ্রষ্টা হেতু তার গোপন-প্রচালকও। রবীন্দ্রনাথ সত্যদর্শী। তিনি আমাদের সমস্ত মন অধিকৃত করে আছেন। মনের গোপন চাবিটি চুরি করার দায় থেকে তাই তাঁকে মুক্তি দিতে পারি না কেউই।
চলবে...

খোরশেদ আলম
গল্পকার, প্রাবন্ধিক
ই-মেইল : khorshed.ju.bngl@gmail.com


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন