শব্দবোধ পত্রিকায় প্রকাশিত। লিঙ্ক : জীবনানন্দের গল্প : নামের প্রেমে
ভেবে দেখলাম কবিতা সম্পর্কে উৎসাহী কম নই আমি। কিন্তু কবিতাই তো লেখা হল না। আর লিখলেও প্রকাশযোগ্য মনে করিনি বলে কবিতা আমাকে বরাবরই দূর-আত্মীয় করে রেখেছে। বাংলা সাহিত্যের এমনকি অন্যভাষার সাহিত্যের অনুবাদ কবিতা পাঠ করি যখন-তখন। যখন ভাল লাগে পড়ি। জীবনানন্দ অনেক বড় কবি। এটা বললে কি আর না বললেই বা কি? বাংলা কবিতায় কী এনেছেন তিনি? যার জন্য ব্যতিক্রমী এক তিলক সাক্ষর তাঁর নামে অঙ্কন করতে হয়? যখন নিবিড় পাঠে নিজেকে হাজির করি মনে হয়, জীবনানন্দ আমাদের ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত শরীর-মনের কথা বলছেন। ক্রমাগতই বিপন্ন-বিহ্বলতার সায় দিয়ে যাচ্ছেন। জীবনের প্রবল নেতিবাচকতা যা-কিছু মানুষের চৈতন্যে ব্যাধি হয়ে আছে, যার নিরাকরণ বাস্তব পৃথিবীতে সম্ভব নয়, হয়তো সেখানেই হাত বাড়ান জীবনানন্দ। এক প্রবল বিমর্ষতা-নির্লিপ্ততার সঙ্গী হয়ে ওঠে তাঁর কাব্য। সেই সঙ্গে কোনো এক গভীর বোধের সঙ্গেও তা আমাদের মনকে সমীকৃত করে।
কিন্তু ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া বোধ হয় ঠিক নয়। কথা বলতে চেয়েছি জীবনানন্দের গল্প বিষয়ে। তাই সেখানেই প্রবেশ করতে চাই। কিন্তু শরীর ছাড়া মনের অস্তিত্ব কোথায়? তাই কবিতার কাছে ফিরে ফিরে চায় মন। কিন্তু জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাস যখন প্রথম পড়ি, তখনই তাঁর কথাসাহিত্য সম্পর্কে কতকগুলো ভাবনা গ্রাস করে। তিনি অবক্ষয়ী মানুষকে নায়ক করেন। তিনি দাম্পত্য-সম্পর্কের শিথিলতা-নির্বীর্যতাকে রূপায়ণ করেন। তিনি নাগরিক বৈদগ্ধ মন নিয়ে মধ্যবিত্তের অসারতাকে শিল্প করে তোলেন। হিমশীতল এক আচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো অন্তর্গত ক্ষয়ের প্রতিবেদক হয়ে ওঠে। এসব সত্ত্বেও জীবনানন্দের গল্প কেবলি এক বিধ্বস্ত নীলিমায় লীন করে দেয়; প্রাণ-মন ব্যাকুল করে তোলে। মানুষের নিরর্থকতাগুলো তিনি অবলীলায় ব্যক্ত করেন। বিপন্ন মানুষের স্বর বাংলা গল্পে অনুপস্থিত ছিল না। রবীন্দ্রনাথের কাব্যময় ভাষা আর কল্পনার কুহক ততদিনে কল্লোলগোষ্ঠীর নিন্দাবাদের স্মারক হয়ে উঠেছে। তবুও রবীন্দ্রনাথকে জিন্দাবাদ বলা ছাড়া উপায় যখন থাকে না, তখন জীবনানন্দের গল্প যেন নতুন কিছু নিয়ে আসতে পারে।
কথা হচ্ছে জীবনানন্দ দাশ মূলতই কবি। কবিতার আত্মা তাঁর কথাসাহিত্যিক সত্তায় বসতি করে। ‘কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময়’, ‘মাংসের ক্লান্তি’, ‘মেয়ে মানুষদের ঘ্রাণে’, ‘আকাঙ্ক্ষা কামনার বিলাস’, ‘শুধু সাধ শুধু রক্ত শুধু ভালবাসা’, ‘বাসর রাত’, ‘জামরুল তলা’, ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গ’, ‘ভালোবাসার সাধ’, ‘কথা শুধু— কথা কথা কথা কথা কথা’, ‘ছায়ানট’, ‘পৃথিবীটা শিশুদের নয়’, ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’ কিংবা ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’—এ-নামগুলোর প্রেমে না পড়ে উপায় নেই। একি শুধুই নামের প্রেম? এতো কবিতার মতো প্রহেলিকার জগতে পদার্পণ করা। কবিতা আর প্রেয়সী সেখানে সমানে সমান। প্রকৃতি আর পূজার নৈবেদ্য সেখানে একাকার। ভ্রমে-বিস্ময়ে ভাবিত পাঠক ভিরমি খেয়ে যায়। তবে কি কাব্য-জগতেরই কথন-ভঙ্গি! হ্যাঁ সব শিল্পই তো মাত্রা বিভেদে প্রহেলিকা হয়ে ওঠে। পর্দার আড়াল রচনা করাই তো শিল্পের সৌকর্য। জীবনানন্দ তাঁর গল্পে সেই পর্দার আড়ালটাই টেনে দিয়েছেন। ফলে কাব্যিক শব্দগুচ্ছই হয়ে উঠেছে তাঁর গল্প-শিরোনামের অনন্য ভঙ্গি।
এরপরও কথা থাকতে পারে—নামে কী আসে যায়? কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হলে আমরা সহসাই চমকে উঠি। না, জীবনানন্দের গল্পসত্তার নামে আমরা আঁতকে উঠি না। তাঁর কবিতাই তাঁর গল্পে ভিড় করে।
“জানি—তবু জানি
নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—”
এই প্রতাপান্বিত হতাশার বোধ বিপন্ন-বিস্ময়ের মতো মানব মনে ধরা পড়তে থাকে। তখন মনে হয়—জীবনানন্দ প্রকৃতই জীবনের গভীর ব্যাপক অসুখকে রূপায়ণ করতে চেয়েছেন গল্পের ভাষায়। কবিতায় যে-সংলাপ অনুচ্চারিত থাকে সেই সংলাপ তাঁর গল্প-দেহে নতুন বাসা বাঁধে। প্রেম সেখানে নিরন্তর আবেগঝরা কিছু নয়। অভ্যস্ত জীবনের উবে যাওয়া প্রেমের ফসিল একঘেয়ে হয়ে ওঠে। যাতনা ও বিষের কুণ্ডলী পাকিয়ে হিসহিস করা সাপ ক্রমাগত দংশন করে যায়। বহু ব্যবহৃত হওয়া ‘শুকরের মাংসে’র মতো জীবনে নেমে আসে ঘন অন্ধকারের আবহ। ‘কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময়’ গল্পে তারই প্রতিধ্বনি :
“অরুণাকে ভালবেসে জীবনটা আজও খেয়ে যাচ্ছে যেন, এরকম খরচ হয়ে যাচ্ছে। কেবলই দ্বিধা, কেবলই বাধা কেবলি যাতনা, অপচয়। কোনো শান্তি বা স্থিরতা না পেলে জীবনের কোন কাজই যে আরম্ভই হতে পারবে না। একটা অপচয়শীল অনিশ্চিত প্রেম জীবনটাকে ছাই করে দিয়ে চলে যাবে শুধু।” (জীবনানন্দ রচনাবলী, জীবনানন্দ জন্ম শতবর্ষ সংস্করণ, গতিধারা, পৃ. ১২)।
বহুবছর প্রেম করেও নিরস ও নিরর্থকতার মুক্তি ঘটে না প্রেমিক-প্রেমিকার। এ-যেন জীবনীশক্তির এক চরম অপচয়। নিরাবেগ অস্তিত্ব নিয়ে পুরনো প্রেমিক বিনোদ প্রেমিকা অরুণার বিয়েতে গিয়েছিল। অরুণাও গিয়েছিল বিনোদের বিয়েতে। যেন সহজ স্বাভাবিক সবকিছু। পরস্পর কারো কোনো কষ্ট নেই। এমন ঘটনার অনুভব মৃত্যুর মতই। তাই কুয়াশার ভেতর মৃত্যু এক তীব্র জটিল বাস্তবের কথকতা। যেন :
‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়—আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে।’
‘মাংসের ক্লান্তি’ গল্পটার ভেতরেও সেই বহু ব্যবহৃত জীবনের ক্ষয় করা প্রতিচ্ছবি। অভ্যস্ত দাম্পত্য আর অনভ্যস্ত অসহিষ্ণুতার মধ্যে বিবমিষার এক চরম অনুভব। ক্ষান্তিহীন-ক্লান্তিহীন একঘেয়ে সংসার যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। যেন মাংসের ওমের ভেতরে ডুবে যাওয়া নিরাসক্ত জীবন। আসক্তি না পেয়েই বোধ হয় এই অবস্থা। আমরা এই গল্পের নায়ক-নায়িকার সংলাপগুলো লক্ষ করি। “তুমিই তো, আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কাছে বসে থাকতে, হাজার খারাপ কথা বললেও তুমি রাগ করতে না, এখন তোমাকে এক মিনিটের জন্যও কাছে পাওয়া যায় না, এমন ছাড়া ছাড়া হয়ে যাচ্ছ কেন?” (পৃ. ৩১)। কিন্তু এসবই কেবল কথার কথা। ভেতরের অনুরাগ যখন থিতিয়ে যায়, তখন যেন অন্য কোনো কিছু দিয়েও তাকে আটকান যায় না। “হেমের সেই মাংস, সেই সৌন্দর্য কি করে এমন ধাঁ করে পড়ে গেল, কেনই বা একে কৃমির মত দেখায় আজ? মাকড়সার পায়ের মত? কুয়াশার পেতনির মত?” (পৃ. ৩১)। এভাবেই জৈব-জীবনের জড়ত্বকে গল্পের পরতে পরতে তুলে ধরেন জীবনানন্দ। অবসাদ-ক্লান্তি-ঘৃণা সবকিছু মিলেমিশে এক তীব্র বিবমিষার পৃথিবী।
‘আকাঙ্ক্ষা-কামনার বিলাস’ গল্পে লক্ষণীয়—মাংসের ভাজে ভাজে এক ক্লান্তিকর নিরর্থক জীবন। “জীবনে প্রেম থাকবে না তখন আর; আকাঙ্ক্ষারও কোনো নিগূঢ় গাঢ়তা থাকবে না; স্থূল একটা ক্ষিদে মাঝে মাঝে জেগে উঠে নিভে যাবে মাত্র; সৌন্দর্যকেও তখন মেদ বলে মনে হবে শুধু; সে বাতাসে ভালবাসা বেঁচে থাকতে পারে না।” (পৃ.৫১)। ‘বিবাহিত জীবন’ গল্পেও এক অসাড় দাম্পত্যের জটিলতা। অন্যদিকে যা-কিছু হতচ্ছাড়া প্রেম, মানুষের হারিয়ে যাওয়া, তার জন্য বেদনা তার চিরকাল। ফসকে যাওয়া সেই প্রেম মানুষের বোধকে খুঁচিয়ে বেড়ায়। যেদিন বরযাত্রা সুপ্রভাকে আনতে চলেছিল সেদিন ছিল উন্মুখর-উন্মুক্ত আনন্দ। কিন্তু সেদিনও যদি পূর্ব-সম্পর্কের কথা জানা যেতো, তাকে বিয়ে করত না অজিত। বিয়েকে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রবোধ উপশমের জিনিস জেনেও অজিত-সতী কেউই বিয়ে করত না। এখনো অজিতের মনে হয় সে হয়তো এখনো ভালবাসে সতীকে। সতীর মাত্র তিনদিনের সন্তান মারা যায়। এ-বেদনার কাছে পৃথিবীর অন্যকিছুর আগ্রহের অর্থ নেই আজ। তবু সতীর জীবনে নতুন বেদনার সময় উপস্থিত। নতুন সাধ আর উপলব্ধির সময়। অন্যদিকে অজিতের ভেতরেও কাজ করে সমানানুভূতি। বউভাতের রাতের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে সতীর চলে যাওয়ার রাত। সুপ্রভার সঙ্গে দাম্পত্য-শিথিলতার এ-এক অন্য পরিণাম। জীবনানন্দের এই হতাশার সুর শোনা গিয়েছিল তার কবিতাতেই। ‘বোধ’ কবিতার উদাহরণ টেনেই আমরা বলতে পারি—“ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,/ অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে/ ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;”
এই ঘৃণার বাইরে অন্য এক জগত সক্রিয় হয়ে ওঠে ‘গ্রাম শহরের গল্পে’। দাম্পত্যজীবন কেন্দ্রিক এই ভিন্নমাত্রার গল্পে নির্বিকার দাম্পত্যের জটিল বুনন সত্ত্বেও শচীর কাছে মুক্তির এক ফালি আকাশ সোমেন। এটা এজন্যই বলা যে, শচীর ব্যস্ত স্বামী বিজনেস ম্যাগনেট। পূর্ব-প্রেমিক সোমেন চাকরিহীন। তার জন্যই শচী একটা চাকরির আবদার করে স্বামীর কাছে। সামান্য বেতনের ছোট চাকরি সোমেন করতে চায় না। শচীই বা কী করে বলে—সোমেন অমন ছোটলোক নয়! সোমেন সারাটা কাল জীবন-জুয়াড়ি। সোমেন ‘জীবনব্যবসায়ে অবিশ্বাসী’। জীবনকে সে শুধু চায় খড়গের মতো তীক্ষ্ণ কঠিন। ‘চোখা বিচারবোধটাকে কল্পনার রেশমী কাপড়ের জালে জড়িয়ে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে’ ভালবাসে সে। শচীরও এই জীবনকে তামাশা বোধ হয়। সোমেনের অবাধ গতায়ত তাকে চূড়ান্ত আবেগ-মুহূর্তের কাছে বন্দি করে। শচীর টাকাওয়ালা নির্বিকার স্বামীর অন্তরালেই থাকে অন্য এক পৃথিবী। শচী ভাবে :
“শীতের রাত—শীতের গভীর রাত—বাংলার শীতের গভীর রাত প্রকাশ আর তাকে নিয়ে যেন কোন বাংলার মাঠে আমনের ক্ষেতের পাশে টুপুর-টাপুর শিশিরের ভেতর কোন মধুমতী কর্ণফুলী আরিয়াল খাঁ নদীর কিণারে প্রোথিত করে রাখে।—হা ভগবান, প্রোথিত ক’রে রাখে যেন।” (পৃ. ৬৪২)
অন্যদিকে সোমেনের ভাবনা-রাজ্যেও এক গভীর তোলপারের শব্দ :
“সে পাড়াগাঁর জীবন তুমি কোন দিন ফিরে পাবে না—অন্ততঃ তেমন করে কিছুতেই না; না শচী কিছুতেই না। আমিও সেই গাঁয়ের পথে আর ফিরে যাই না, ভাবতেও চাই না পাড়াগাঁ কেমন—সেই তেলাকুচা ফণীমনসা বনধুঁধল কোন অন্ধকারে কোন জ্যোৎস্নায় কত দূরে চলে গিয়েছে।... আমরা আর সেখানে নেই... কি হবে সে সব দিয়ে? কলকাতার মেসের জানালার ভিতর থেকে তাকিয়ে যখন দেখি একটা পাতাশূন্য শিমুলগাছের লাল ফুলগুলো সবে ফুটল তখন যে আক্ষেপ যে গ্রামলোলুপতা আমাকে পেয়ে বসতে পারত নতুন জীবনের প্রয়োজনের কাছে সেসবকে উপহাসাস্পদ ক’রে তোলাই ঠিক মনে করি।”
জীবনানন্দের কিছু গল্প প্রেম-প্রণয়ের সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হলেও পরিণাম অপ্রেম। ‘বাসররাত’ এমনি একটি গল্প। এ-গল্পের নায়ক প্রেমনীহারের বাসর-অনুভূতি ‘পাইলাম ইহাকে পাইলাম’ জাতীয় হলেও মুহূর্তেই সে আবিষ্কার করে ফেলে মণিকা সম্পূর্ণরূপে তার বিপরীত ভাবের। কিছুদিন পর তার মনে হয়, “এ কেমন অদ্ভূত জীবন, সে চালাচ্ছে পদে পদে মণিকাকে খুশি করবার খুঁটিনাটি তুচ্ছ প্রয়াস নিয়ে? কিন্তু কি করবে সে? অশান্তি তার ভালো লাগে না। যখন দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেছে সে সেটা সার্থক করা কর্তব্য তার।”(পৃ.২৬০)। মেয়েটি সম্পূর্ণভাবে তার, এ-অনুভব তাকে ব্যতিব্যস্ত করেছিল বাসর রাতের প্রথমভাগে। প্রেমনীহারের অনুভব তখন দারুণ কাব্যিকতায় ঢাকা। তার জীবনের চরম নিরর্থকতা বোধের কাছে তা ছিল নতুন। প্রেমনীহারের অনুভব তুলে ধরেন জীবনানন্দ :
রূপকে রক্তমাংসের যেন একটা নিখুঁত দারুচিনি গাছের মতো পৃথিবীর পথে উৎফুল্ল হয়ে উঠতে দেখেছিল সে, কতবার দেখল, কত পথে, কখনো-বা টবে, কখনো-বা বাগানে, কখনো বনের প্রান্তে কিনারে, কিন্তু সবসময়ই কেমন একটা অহংকার ও নির্দয়তা মাখা, যেন কিসব জিনিসের মমতামধুর পরিচর্যার রূপের থেকে জন্ম, জীবন পেয়ে এরা গন্ধের বিলাসে পৃথিবীকে স্ফুরিত করে ফেলল। আভরণ ও রূপের গর্ব পেল শুধু, দয়া পেল না মায়া পেল না কিছু না। কেনই-বা পাবে? রূপসীর কাছ থেকে মায়া দাক্ষিণ্যও-বা কে চায়? প্রেমনীহার ওসব কিছু চায় নি, একজন রূপসীর হাত ধরে সে শুধু নিখিল চন্দ্রমল্লিকার গন্ধে জ্যোৎস্নায় অবশ হয়ে হারিয়ে যেতে চেয়েছিল। (পৃ.২৫১)
অনুভব হচ্ছে—উপরের বাক্যগুচ্ছে প্রেম-তাপিত হৃদয়-উচ্ছ্বাসের ভাষাকে রূপ দেয়া হয়েছে। কবিত্বের সহজ আনন্দ এর মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘মেয়ে মানুষের ঘ্রাণে’ গল্প থেকে উল্লেখ করা যাক :
“এমন একটা নিশ্চয়তা কি জীবনে পাওয়া যাবে না? হয়ত ভালবাসাও নয়, গৃহের ভিতর স্থিরতা একটা—সংসর্গ ও সমবেদনার একটা শান্তি, পৃথিবীর শীতের নিস্তব্ধতার ভিতর নক্ষত্র-নরম বনজঙ্গল, ছায়া, শিশিরের শব্দ, পাখির বাসা, দুটো সাদা ডানার নিরীহ নিবিড় গরমের আরাম, এই সব।” (পৃ.২০)
ওপরের উদ্ধৃতিতে ব্যবহৃত বাক্যগুচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে—কবিতা কতটা কার্যকরি ভূমিকায়। জীবনানন্দের অনেক গল্পই হয়ে উঠেছে এরকম কাব্যিকতার ছোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ছোটগল্পকে কেউ কেউ কবিতা বলতে চান। অর্থাৎ ছোটগল্পের ভাষায় নিরেট কাব্যিকতার সঞ্চার হতে পারে। তাকে কাব্যিক গল্পও বলা যায়। জীবনানন্দের ক্ষেত্রে ধারণা—যা ঘটেছে, এক আবেগ-সঙ্কুল কাব্যভাষার জারিজুরির কাছে তিনি গল্পের ভাষাকে ছেড়ে দেননি। বরং চরিত্রের মনোলোক আর ঘটনা-পরিবেশ সেখানে তাঁর সহজ কবিত্বের প্রকাশভঙ্গিকে আয়ত্ব করেছে। কখনো প্রকৃতিময়তার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ জীবনানন্দীয় আবহকে পুরোটাই আবিষ্কার করা যায়। ‘সঙ্গ, নিঃসঙ্গ’ গল্পটি এমনি কবিত্বের মোড়কে আচ্ছাদিত। প্রেম ও সাময়িক বিচ্ছেদের বেদনা সেখানে কাব্যকথার ধুম্রজাল তৈরি করেছে।
“এ-তুমিও নও—আমিও নই; এ শুধু দিন-রাত্রির গভীর রঞ্জনী ধ্বনি—অনন্ত অপরিসীমের দিকে চলিতে চলিতে নারিকেলের পাতায়, চিলের ধবল গলায় সোনালী ডানায়, ভোরের নৌকার রঙিন পালে, খর রৌদ্রে, মেঘনা-ধলেশ্বরীর স্ফীত স্তনের বন্যায়, মধুকুপী ঘাসে, কাশের সমুদ্রে, দ্রোণফুলের ভিড়ে, মৃত রূপসীর ললাটের সিন্দুরে, গোধূলীর মেঘে, শীতসন্ধ্যার কুয়াশায়, স্থবিরের বিষণ্ন চোখের নির্জন স্বপ্নতন্তুর ভিতরে, তাহার যে সুর বাজাইয়া যায়—এ শুধু তাহারই ধ্বনি।” (পৃ. ৫৭৬)
উপরে ধৃত শব্দকৌশলে কবি জীবনানন্দকে অনায়াস আবিষ্কার করা চলে। চিরপরিচিত প্রকৃতি-অনুভবের শব্দ-গাম্ভীর্যে স্পষ্ট হয় জীবনানন্দীয় চৈতন্য। অন্তর্মুখী জীবনের একরাশ বাস্তবতা ও সম্ভাবনা এখানে মূর্ত। এই উদ্ধৃতিটুকু সামান্য নমুনামাত্র। গল্পটির পরতে পরতে কবি-অনুভবের অতলান্তিক রহস্যমধুরতা ব্যাপকভাবে স্থান করে নিয়েছে। বিভ্রম হতে পারে কাব্যের জীবনানন্দই হয়তো গদ্যে হাজির। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ গল্পেও সেই কাব্যিক আবহ তৈরি হয়। এখানে কবির চিরপরিচিত শব্দ ব্যবহার জীবনানন্দীয় প্রেক্ষাপটকেই হাজির করে। ধানসিঁড়ি নদী, রাত্রির গহন স্তব্ধতা, কুয়াশা, কৃষ্ণচূড়া, পেঁচা, নির্জনতা এসব শব্দগুচ্ছ সে-কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। “পুরনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে/ এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে/ মাঠের মুখের ’পরে ;/ সবুজ ধানের নিচে—মাটির ভিতরে/ ইঁদুরেরা চ’লে গেছে—আঁটির ভিতর থেকে চ’লে গেছে চাষা ;/ শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা!” (‘অবসরের গান’, ধূসর পাণ্ডলিপি)। ধূসর খেরোখাতার মতোই প্রকৃতি ও জীবন একাকার হয়ে ওঠে। যেন নিরাবেগ পথিকের গান শোনা যাচ্ছে। অথচ তার স্বপ্ন আছে, আছে সাধ। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি গল্প’ও যে একই নাম কবিতার অন্তর্সূত্র। তবে একটার মাধ্যম কবিতা, আরেকটার কথকতা। অথচ উভয়েই পরস্পরের পরিপূরক। “সমস্ত অন্ধকার রাতটা তোমার নিজের জিনিস, জানালা খুলে রাখো, আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকো। রাতের বাতাস আস্বাদ করো, স্বপ্ন দেখো, কেউ তোমাকে বাঁধা দেবে না।” (পৃ. ৭৪১)। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র কবিতা আর গদ্যের সংযোগ-সূত্র তো এখানেই।
প্রেম-অপ্রেমের জটিলতার বাইরে এক ভিন্ন জগতের আবিষ্কার ‘কথা শুধু—কথা, কথা, কথা, কথা, কথা’। প্রথমেই গল্পটার নামের প্রেমে পড়া গেল। কিন্তু পাঠ করতে গিয়ে উন্মোচিত হলো অন্যকিছু। আমরা সবাই জানি—সমকাল সম্পর্কে জীবনানন্দের ভাবনা অনেকখানি আত্মগত। বৃহত্তর সময়কেও তিনি কাব্যিকতার অন্তর্জালে আটকে ফেলেন। ‘বনলতা সেন’ যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। অন্যদিকে সমকালীন রাজনীতি আর রাজনীতিকদের অপ্রতিশ্রুতিশীল আচরণ জীবনানন্দকে বারবার ব্যথিত ও রক্তাক্ত করেছে। কবির ব্যক্তিজীবনে যার বহুপ্রমাণ রয়েছে। এ-গল্পটি সেই প্রমাণের অন্যতম সংযোগ-সূত্র। হঠাৎ করেই নাম শুনে দু রকম অনুভূতি হতে পারে। যেমন: এই বহুবিস্তর কথা কোনো প্রেমিকার কাছ থেকে পাওয়া প্রগলভ প্রেমালাপ। অথবা হতে পারে দীর্ঘযাপিত অসার দাম্পত্যের হতাশ অভিব্যক্তি, যেখানে কারো কথাই আর কারো ভাল লাগছে না।
কিন্তু ব্যাপার তো মোটেও তা নয়। অ্যালবার্ট হলে মস্ত বড় পলিটিক্যাল মিটিং চলছে। এমন সময় ভবশঙ্কর এসে হাজির। কিন্তু বহুদিনের পুরনো রাজনীতিকের আবির্ভাব সভাস্থলকে ব্যস্ত করে তোলে না। রাজনীতিকদের সম্পর্কে তার মন্তব্য : “এরা নিজের কথা নিজের কানে বাজিয়ে নিতে খুব ভালবাসে বুঝি? এই-ই শুধু ভালবাসে, কথাই ভালবাসে, কথাই ভালবাসে শুধু, কথাই ভালবাসে; কথাই ভালবাসে।” মানুষের জীবনের সীমিত উদ্দেশ্যগুলো তার কাছে হঠাৎই নিরর্থক ও বিচ্ছিন্ন মনে হয়। তবুও অর্থকড়ির পেছনে ছোটে ভবশঙ্কর। জীবনের কোনোকিছুই তাকে তৃপ্তি দেয় না। তবু সে রাজনীতি করে। সে-রাজনীতি বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে বিচ্ছিন্নতায় ডুব দেয়ারই নামান্তর মাত্র। এদিকে তরুণ রাজনীতিকদের সম্পর্কে তার মন্তব্য :
“ন্যাশনালিজমের বড়াই করে? বটে! বিলেতি পাগলামিতে এদের মগজ ভরা; বিলেতি রিঙের ভাষা, টার্ম ক্লাবের উপমা, ফুটবল গ্রাউন্ডের অলঙ্কার এইসব জঘন্য সম্বল নিয়ে জীবনের সমৃদ্ধ মূল্যবান জিনিশগুলোর ওপর এরা শিশুর মত মন্তব্য করে— নিজেদের বৃদ্ধাতিবৃদ্ধ পিতামহ বলে ভাবে। ভাবে না কি? জানে না কি ভবশঙ্কর সব। ত্রিশ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন খবরের কাগজ পড়ে ন্যাশনালিজমের, বাঙালিয়ানার, সমস্ত জারিজুরি ধরে ফেলেছে সে।” (পৃ. ৩২০)
জীবনানন্দের গল্প সম্পর্কে আরো হয়তো না-বলা অনেক কথাই বাকি রয়ে গেল। তবুও কবির গল্পের অনন্যতা আর কাব্যের ঐক্যসূত্র সন্ধান করেও বলা যায়—একই শিল্পী, মাধ্যম তাঁর ভিন্ন কিন্তু ভাবনা তো একই। সমকালীন জীবন আর মানুষ তথা শহুরে মধ্যবিত্তের ভেঙে পড়া বোধের এক চিলতে আকাশ তাঁর গল্প। এক গণ্ডুষ জল নিয়ে নির্ণয় করা যায়-না সমুদ্র-ব্যাপকতা। জীবনানন্দের গদ্য-কবিতা-প্রবন্ধ বা সমগ্র রচনা পাঠ করেই হয়ত তাঁকে আবিষ্কার করা সম্ভব। তাও কতটা? যতটা তিনি প্রকাশ করেছেন ততটাই; তার বাইরে তো নয়। জীবনানন্দের কথাশিল্প কাব্যিক আবেগের সীমাহীন অদৃশ্য-রহস্য-কুহেলিকায় ঘেরা। নিশ্চেতন মানবের সচেতন আকুতির বয়ান সেখানে বাহ্যত ক্রিয়াশীল। যার অন্তঃশীল প্রবহমানতায় ‘সেন্সুয়াস’ তথা আবেগ-পরিস্রুত এক কবির অন্তর্দেশ। আর নামে কী আসে যায়? কিন্তু জীবনানন্দের গল্পগুচ্ছ এই নামেরই কারিকুরি। সচেতনভাবেই অবচেতন এক কবিমন সেখানে উপস্থিত। এই কাব্যিক হৃদয়-উপস্থিতি নামের প্রেমে ফেলে দেয় নিশ্চিত। যেখানে জীবনানন্দীয় কাব্যিক গন্ধটাই চারপাশে ভিড় করে। তবে জীবনানন্দের কথকতার নিরেট গল্পটা বাদ দিলে তা তো কবিতারই ফাঁদ—এতে সন্দেহ কী?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন