একজন মানুষের কতটা জমি দরকার
কিছু মানুষের প্রতিভার সঙ্গে জীবনের সত্য ও বোধের গভীরতা মাপতে বিস্মিত হতে হয়। রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক লিও তলস্তয় হচ্ছেন সেই ধরনের সাহিত্যিক। তিনি জীবনধর্মকে মহার্ঘ মেনেছেন, হৃদয়ের সত্যকে মেনে নিয়েছেন। সর্বোপরি মানুষের প্রাপ্তি ও প্রাপ্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সামন্তবাদী সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন “রুশ বিপ্লবের দর্পণ”। কারণ স্ব-সমাজের চিত্রকে তিনি নির্মাহ সত্যের আলোয় নির্মাণ করেছিলেন। আর জীবনের শেষ পর্বে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, “যে সম্পত্তি আমি নিজে অর্জন করিনি, তা ভোগ করার অধিকার আমার নেই।” সেজন্যই একদিন সমস্ত কিছু ছেড়ে ভিখারির বেশে বের হয়ে গিয়েছিলেন। বোধের গভীরতার জন্য তিনি বিশ্ব সাহিত্যেরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। ১৮২৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার টুলা প্রদেশে তিনি জন্মেছিলেন। তলস্তয়ের পুরো নাম কাউন্ট লেভ নিকোলায়েভিচ তলস্তয়। মানুষের চাহিদার শেষ নেই। এই বোধ আজকের নয়, পুরনো। তবুও মানুষের স্বভাব কেবল চাই আর চাই, আরও আরও চাই। এর নিবৃত্তি নেই, প্রবৃত্তি যতদিন জেগে আছে। আর মৃত্যু অবধি এর থেকে মুক্তি নেই। মুক্তি কেবল তাদের জন্য যারা লোভের জিনিস সামনে পেয়েও বিবেচনা করে— নেবে কি নেবে না, নেওয়া উচিত কি উচিত না। এভাবেই মানুষের মনুষ্যত্ব জেগে থাকে, নইলে তা মরে যায়। তলস্তয়ের একটা গল্প সেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থাকতে পড়েছিলাম ‘চিরায়ত গল্প’ হিসেবে। তবে এরপরও বারবার পাঠ করেছি, কিন্তু পড়ার স্বাদ কখনও পুরনো হয়নি। তাই বারবার গল্পটা পড়েছি, আজও পড়ছি। আমাদের আশপাশে অথবা আত্মীয়বৃত্তের মধ্যেও এমন অনেক লোক থাকে, লোভের লকলকে জিহবা তাদের জেগে থাকে সর্বক্ষণ। তারা নিজেরা কখনও সুখি হয় না, হবার চেষ্টাও করে না। পক্ষান্তরে অন্যদের ‘সুখের বাড়া ভাতে ছাই’ দিতে চেষ্টা করে। তারা প্রায়শই মানুষের মুখ ম্লান করে দেয়, লোভের বশবর্তী হয়ে, বাজে কথা বলে, মন্দ আচরণ করে। প্রাপ্য নয়, অথচ প্রাপ্যতা দাবি করতে করতে মুখে ফেনা তোলে। যৌতুক প্রাপ্তির মতো অন্যায় আচরণ করে। শেষে নিজের সম্মান হারায়, কালিমালিপ্ত হয়। তবুও লোভের জিহবা তাদের হাড়ির তলা চাটতে ভোলে না। তেমন কিছু মানুষের দেখা সবার জীবনেই হয়তো ঘটে। বলাবাহুল্য এটা দুর্ভাগ্য, তবুও অনস্বীকার্য সত্য।
যাই হোক, জীবনে নানা রকম অভিজ্ঞতা থাকবে। হরেক রকম মানুষও থাকবে। মেনে নিতে না পারলেও, এটাই পৃথিবীর স্থূল বাস্তবতা। এজন্যই হয়তো মহামতি তলস্তয় লিখে গেছেন তাঁর অমর গল্প :
“সাড়ে তিন হাত জমি”
গল্পটি রাশিয়ার এক লোভী লোক পাহমকে নিয়ে। জমি কেনার দিকে তার প্রবল ঝোঁক। কারো কাছে জমির কথা শুনলেই তার চোখ চকচক করে ওঠে। কম দামে জমি বিক্রি হলে সে তা কিনতে মরিয়া হয়ে ওঠে। জমির জন্য সে ছুটে যায় এখানে সেখানে। সস্তায় যেখানে জমি পাওয়া যায় সেখানেই গিয়ে পরিবারসহ হাজির হয় পাহম। সেখানে জীবনযাপনও শুরু করে।
এভাবে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকা ঘুরতে ঘুরতে পাহম এমন এক এলাকার সন্ধান পায় যেখানকার মানুষ খুবই সহজ-সরল। তাদের থেকে খুবই কম দামে জমি কেনা যায়। তারাও জমি দিতে খুব আন্তরিক। লোভী পাহম তার পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করে। সেখানকার উর্বর জমি থেকে তার আয় দিন দিন বাড়তেই থাকে। কিন্তু জমি নিজের করে নেয়ার যে লোভ, তা থেকে সে কোনোভাবেই বেরিয়ে আসতে পারে না। ক্রমে নিজেই নিজের কাছে একটা দুষ্টচক্রে পড়ে যায় সে। আরও আরও জমি লাগবে তার, আশ না মেটা প্রচুর প্রচুর জমি। জমির চিন্তায় রাতে সে ভালোভাবে ঘুমাতেও পারে না।
এমন সময় তার কাছে খবর আসে নতুন জমির। অনেক দূরে উর্বর এক এলাকা রয়েছে। সেখানে জমির দাম তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তা। সেখানে ফসলও বেশ ভালোই ফলবে। লোভী পাহম ভাবে—এতে করে আরও আরামের জীবনযাপন সে করতে পারবে। জমি নিয়ে তার এতো দুশ্চিন্তার হয়তো সমাপ্তি ঘটবে। অনেক চিন্তাভাবনা করে সে সিদ্ধান্ত নেয় সেখানে পাড়ি জমাবার। জমি যে তার দরকার। উর্বর জমি, অনেক অনেক জমি।
নতুন স্থানে গিয়ে কথা হয় কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে। জমির দাম একদিনে মাত্র এক হাজার রুবল। কিন্তু হিসাবটা বুঝে উঠতে পারে না পাহম। তার সত্যিই জানা নেই, দিনের হিসাবে কী করে জমি বিক্রি করা হয়। তারপর সে জানতে পারে যে, একদিনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতখানি জমি ঘুরে আসা যায় ঠিক ততখানিই জমি হবে তার ! এর জন্য তাকে দিতে হবে মাত্র এক হাজার রুবল। তবে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করা হয়েছে, সেখানে এসেই শেষ করতে হবে যাত্রা। সূর্য ডুবে যাবার আগে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে।
একথা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয় পাহম। তার মন যারপরনাই উৎফুল্ল। এতদিনে মনের মতো কম দামে জমি পাচ্ছে। তীব্র উত্তেজনায় রাতে ঘুমাতে পারে না পাহম। প্রফুল্ল মন শুধু আনন্দ করতে চায়। জমি পাওয়ার জন্য দেরি যেন আর কোনোভাবেই সহ্য হচ্ছে না। ভোরে তন্দ্রায় চোখ ডুবে যায়। স্বপ্নে নিজের মরদেহই নিজের চোখের সামনে ভাসে তার। ভড়কে যায় পাহম। কিন্তু এসব ভেবে এখন আর কোনো লাভ নেই। সকাল শুরু হয়ে যাচ্ছে। এখনি তাকে বেরুতে হবে কাঙ্ক্ষিত জমির জন্য।
পাহম পাহাড়ি সেই জমির মালিকদের কাছে গিয়ে হাজির হয়। তার মাথায় থাকা টুপিতে এক হাজার রুবল রেখে যাত্রা শুরু করে সে। যাত্রার শুরু থেকেই বেছে বেছে ফসলের জন্য উপযোগী জমিগুলোতে চিহ্ন এঁকে দেয়। মাঝে কিছুটা বিশ্রাম নিলেও কোথাও বসে পড়ে না। বসে পড়লে যদি ঘুম পায়, তাহলে তো সবই শেষ হয়ে যাবে। জমির লোভে এগোতেই থাকে পাহম। একটার পর একটা জায়গা তার নিজের জন্য চাই-ই চাই।
কিন্তু হায়! সূর্য তো পশ্চিম গগনে উপস্থিত প্রায়। অস্ত যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন তাকে যে করেই হোক ফিরতেই হবে। কিন্তু প্রাণপণ দৌড়েও সে টুপিটার কাছে ফিরতে পারবে কি? তার মনে হয় জীবন ওষ্ঠাগত। তবুও কষ্ট করে হলেও জোরে পা চালাতে থাকে পাহম। জীবন যে যায় যায়! হায়! কিছুই বুঝি করার নেই তার।
অবশেষে সবার উৎসাহ পেয়ে শুরুর জায়গায় ঠিকই এসে পড়ে পাহম। সবাই চরম বাহবা দিতে থাকে তাকে। অনেক জমি পেয়েছে সে। যা ছিল সত্যিই তার কল্পনার অতীত।
পাহম ওখানেই মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু তার মুখ তুলে দেখা যায় মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে। প্রাণবায়ু বের হয়ে গেছে পাহমের। প্রায় পেয়ে যাওয়া এতো এতো সস্তা দরের জমির মালিক সে হতে পারলো না।
তার জায়গা হলো মাত্র সাড়ে তিন হাত মাটি (ছয় ফুট।) এর থেকে বেশি যে পাবার অধিকার নেই তার!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন