কথাশিল্পী শামিম আহমেদের জন্মদিনে না-বলা কিছু কথা!

 মূল পত্রিকায় পাঠের লিঙ্ক : https://wp.me/p46zKa-2j2


ছবিতে কথাশিল্পী শামিম আহমেদ

লেখক শামিম আহমেদের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের সালার নামক স্থানে। বিচিত্রমুখি ও বহুপ্রজ প্রতিভা তার। একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, গবেষক, চরিতকার এবং পেশাগত জীবনে দর্শনের শিক্ষক। আমার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছিল খুবই নাটকীয়ভাবে। আকস্মিক পরিচয়ের সূত্রেই তাকে চেনাজানা, কথাবার্তা তারপর আন্তরিকতা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের পরিচালক কবি শামীম রেজার আমন্ত্রণে শামিম আহমেদ এসেছিলেন বছর তিনেক আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্টহাউসে রাত্রিযাপন করছেন। পরদিন শামীম রেজা ভাই বললেন, “আমি তো আজ ঢাকা যাবো, তুমি একটু সঙ্গ দিও।” যাই হোক, তখনো জানি না যে, তিনি সেই ব্যক্তি যার উপন্যাস নিয়ে আমি আগেই লিখেছি। তবে শামিম আহমেদ নামটা শুনে বেশ পরিচিত বোধ হচ্ছিল, এই যা। উপন্যাসটার নাম ‘বিষাদবিন্দু’। তা আবার আমাকে পাঠ করতে দিয়েছিলেন আমার পূর্বতন একজন কলিগ। তিনি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সাইফুজ্জামান। জামান ভাই বলে তাকে ডাকি। তখন তিনি শান্তিনিকেতনে ডিগ্রি করছেন নাটক বিষয়ে। 

শান্তিনিকেতন থেকে ফাঁকে ফোকরে দেশে এলে জামান ভাই আমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে যেতেন। ‘বিষাদবিন্দু’ উপন্যাসটা হাতে দিয়ে শুধু বললেন, ‘পড়ে দেখবেন’। কৌতুহলবশত আমি বইটা মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করি। পাঠ করতে গিয়েই ধরা পড়লো বিপত্তি। প্রচলিত কাহিনির সঙ্গে এর মিল নেই। বইটা তিনি লিখেছেন ‘কারবালা’র বিষাদমূলক ঘটনা-অবলম্বনে। এজিদ চরিত্রের উপস্থাপনা আলাদা, তথ্য যা ছিল, তা একেবারেই অজ্ঞাত। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসটা আমার খুব ভালো করে পাঠ করা। ফলে এই দুটো উপন্যাসের তুলনা করা তখন আমার দারুণ আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হলো। কারণ মীর মশাররফ হোসেনের ইতিহাসের সঙ্গে এ-উপন্যাসে বর্ণিত ইতিহাসের তেমন কোনো মিল নেই। বরং প্রচুর বৈপরীত্য রয়েছে। সে-কথায় পরে আসছি। যথারীতি আমি ‘বিষাদ-সিন্ধু’ এবং ‘বিষাদবিন্দু’ উপন্যাস দুটোর তুলনামূলক একটা আলোচনা, ভালো বলতে, গবেষণামূলক প্রবন্ধই লিখে ফেলি। এটি পরে ছাপাও হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের জার্নালে। আর জামান ভাইয়ের দেখা হলে ‘বিষাদবিন্দু’ বইটা সম্পর্কে তাকে একটা ব্যক্তিগত রিভিউ দেই। তাকেও বইটা পড়তে বলি। তখনো শামিম আহমেদ নামক ব্যক্তিটা কে তা আমার অজানা।  

এবার ওই যে, কবি শামীম রেজার আমন্ত্রণে তিনি এলেন, আমি আর হামীম ভাই (লেখক হামীম কামরুল হক) দুইজন মিলে রেস্ট হাউসে গেলাম। শামিম আহমেদের সঙ্গে আলাপের শুরুতে বললাম, “আপনি কি সেই ব্যক্তি যিনি কারবালার কাহিনি অবলম্বনে ‘বিষাদবিন্দু’ লিখেছেন?” তিনি বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই তো!” 

“আপনি না মুর্শিদাবাদের লোক, বইয়ের শুরুতে লেখা ছিল! তা বেলুড় মঠে কী করেন?” বললেন, “রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াই।” সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এলো, “বেলুড়ের কথা কোথায় যেন লেখা ছিল?... ও হ্যাঁ। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায়। তাই না?” 

তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তা ঠিক!” তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “ওখানে একটা স্টিল মিল কারখানায় শ্যামলবাবু কাজ করেছেন জীবনের প্রথম দিকে! যেটা আবার ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসের কুবেরের জীবনচরিত!” উনি বললেন, “জি, সেটা এখনো আছে। মানে, ওই স্টিল কারখানাটা।” 

এভাবে চলছে আলাপ। কখন কী আলাপ হয়েছিল, তার কোনো দিকনিশানা ছিল না। কখনো ব্যক্তিগত, কখনো তার দর্শন সম্পর্কে, লেখা সম্পর্কে, ওখানকার পরিবেশ সম্পর্কে ইত্যাদি। আমার ধারণা ছিল, উনি সাহিত্যের ছাত্র। কিন্তু বললেন, “না আমি দর্শনের লোক।” বুঝলাম, এমন লোকের সঙ্গে আলাপ এবার জমবে ভালোই। দীর্ঘদিন দর্শন পড়ান, শুধু তা-ই নয়, জীবন সম্পর্কে তার ধারণা আমাকে বিস্মিত করে। পিএইচডি-র কাজ করেছেন আবার ‘মহাভারত’ নিয়ে। আরও কৌতূহল আমাকে চেপে বসে। মনকে প্রবোধ দিতে পারি না, জামান ভাই এই শামিম আহমেদ সম্পর্কে আমাকে কেন কিছু জানালেন না! তাহলে তার সম্পর্কে, তার লেখা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জেনে কথা বললে, না জানি কেমন হতো! 

যাই হোক, নিতান্ত অজ্ঞান আমার সঙ্গে তার আলাপচারিতা এতো জমে উঠলো যে, পরপর তিনদিন আড্ডাবাজিতেও কথার খই ফুরায় না—না আমার, না তার। এরপরও তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হলো। ওই একই অবস্থা! পুরাণশাস্ত্রে যিনি ঘূণ, তার কথার যে আগামাথা থাকবে না, বলাবাহুল্য। ভারতীয় দর্শন, ইউরোপীয় দর্শন, লেখালেখি, উপন্যাস, অনুভব, বাস্তবতা, জটিলতা, মহাভারত, সুফিবাদ, মানুষের জীবনরহস্য—সে এক মহাকোলাহল!

সে বার কবি ও কথাকার রায়হান রাইন, লেখক শামিম আহমেদ, কবি শামীম রেজা, কথাসাহিত্যিক হামীম কামরুল হক আর আমিসহ শুধু পাঁচজনই নয়, একদঙ্গল উৎসাহী ছাত্রছাত্রীর ভিড়ে রেস্টহাউসের রুমটা গমগমে। সবার আগ্রহ ‘মহাভারত’ বিষয়ে। এ প্রশ্ন, সে প্রশ্নে কান ঝালাপালা। আর তিনি উত্তরও দিচ্ছেন একের পর এক। এক্কেবারে বিরতিহীন ইন্টারসিটি ট্রেন। প্রশ্নও ফুরায় না, উত্তরও ফুরায় না। এদিকে একটার পর একটা উত্তর পুনরায় নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। আবার পাল্টা প্রশ্ন, ফের পাল্টা উত্তর। সময়ের জ্ঞানকাণ্ড হারিয়ে আমাদের দশা তথৈবচ। পরদিন কিন্তু এ বিষয়ে সেমিনার। যাই হোক ওনাকে বললাম, “এবার যাই, আপনার প্রস্তুতির দরকার আছে না!” উনি “ধুত্তোর!” বলে কথাটা ছাই উড়িয়ে দিলেন। “আরে বসুন, আরও খানিকক্ষণ থাকেন!” এ কী লোকের পাল্লায় পড়লাম! হামীম ভাই কোন ফাঁকে আগেই সটকে পড়েছেন। তার লেখালেখি মাঠে মারা যায়। আমি বেকার, তাই কোনো তাড়া নেই। 

‘মহাভারত’ সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, তারাই কেবল জানেন, ওটা মহাসমুদ্র। তলিয়ে গেলে ওঠা বড় ভার! সে রাতে সত্যিই কূলে ওঠা দায় হয়ে পড়েছিল। পইপই করে বললাম, “দেখুন, আপনি না হয় বিরাট লেখক, আমার একটু আরাম না হলে প্রেসারটা বেড়ে যাবে!” বললেন, “এই বয়সে!” যাই হোক, আমার কণ্ঠের সুর নাকি পশ্চিমবঙ্গে ঠিক মানিয়ে যাবে! আসলে ইচ্ছে করে ওনার টানে (অভিনয় করে) কথা বলছিলাম। আগে থেকে রপ্ত করা। তিনি তো একের পর এক সিগারেট খেয়ে চলছেন আর কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছেন! মনে ভাবলাম, লোকটা কেবল মহাজ্ঞানী নয়, মহা ধূম্রখোরও! 

পরদিন সেমিনার হলো। বাংলা বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক অনিরুদ্ধ কাহালি স্যারসহ আমরা কয়েকজন মঞ্চে। দর্শকসারিতে ছাত্রসহ গুণীজনেরা বসা। শামিম আহমেদ এই যে ‘মহাভারত’ নিয়ে কথা শুরু করলেন, আর তো থামার জো নেই। বললেন, “সময়?” কবি শামীম রেজা যা ইঙ্গিত করলেন, তার সারমর্ম, “যথা খুশি!” তবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ‘মহাভারত’ অভিজ্ঞান শোনা হলো। দর্শকের চোখেমুখে মুগ্ধতার চাদর। আর আমাদের বোধের অবস্থা— এ-আলাপ আগের আলাপের চেয়ে অন্যরকম। নতুন অনেক কথা! ‘মহাভারতে’র একেবারে গোড়ার দিকের জ্ঞানগুলোও তিনি এমনভাবে পরিবেশন করছিলেন, তার মধ্যে নতুন কিছু ভাবনার ছিল। ‘মহাভারতে’র ব্যাপ্তি ও ভার্সন নিয়ে যেসব কথা বললেন, সেগুলোও রীতিমতো চমকপ্রদ। আসলে শামিম আহমেদের অধীত জ্ঞান এক ‘মহাভারত’ সম্পর্কে অতলান্ত গভীর। পরে খোলা আড্ডায় পলাশ ভাই ওর প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, “দেখেছেন, যে কোনো বিষয় সম্পর্কে ওনার ক্লারিটি (স্পষ্টতা) অন্যরকম! জ্ঞান আহরণ করলে এরকমই করা উচিত।” ততক্ষণে শামিম আহমেদ ওয়াশরুমে চলে গেছেন। তিনি একথা শুনতে পাননি। তা না পেলেও, উষ্ণতা অনুভবের কমতি ছিল না। এটা সত্য যে, যে-কোনো বিষয়ে ভাসাভাসা জ্ঞান দিয়ে তেমন কোনো উপকার হয় না। ওয়াসিম পলাশ ভাই অন্যরকম ধ্যানী মানুষ। তিনি প্রকৃত জ্ঞানীর মর্ম বোঝেন। তার কথা শুনলে ভিন্ন জগতে মন চলে যায়। যাই হোক, ‘মহাভারত’ নিয়ে শামিম আহমেদের বোঝাপড়া বহুদর্শী। ‘মহাভারতে যৌনতা’, ‘মহাভারতে দ্রৌপদী’, ‘মহাভারতে নাস্তিকতা’, ‘মহাভারতের গুপ্তহত্যা’, ‘মহাভারতের বিবাহ’ প্রভৃতি তার একেকটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ। এটা বলতে বলতে মনে হাস্যরস উদয় হলো। “আগে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির মুরিদ ছিলাম। এখন জুটলো আরেক পির সাহেব।” যাই হোক, পাঠক বুঝবেন, জ্ঞানের জগতে বহুপির বহুগামিতা নয়!

এর পরের দিন আবার সেমিনার। সেটা আবার আমাকেই দায়িত্ব দিয়ে কবি শামীম রেজা ব্যস্ত রইলেন। বিষয়টা পরম আগ্রহের, তা হলো ‘সুফিবাদ’। আগের দিন ‘মহাভারত’ পরের দিন ‘সুফিবাদ’। ভাবলাম, এই যাহ্, লোকটা নিশ্চয়ই সুফিদর্শনের বারোটা বাজাবেন! একটা এলোমেলো ভাব নিয়ে বসে আছি সেমিনারে। 

কথা শুরু হলে তো বলা যাবে না। ভেবে, আগেভাগেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দিলাম, “বুঝলেন তো! অন্য বিভাগে এসেছি। (প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে) সময়ের একটা সীমারেখা আছে।” অধ্যাপক জয়ন্ত দা আয়োজনে সহায়তা করেছেন। আগের মতোই থামার তো সম্ভাবনা নেই। আবারও শামিম আহমেদের জ্ঞানের সৌন্দর্যে অভিভূত হলাম। পরে, যা জানলাম-বুঝলাম, তিনি আরবি-ফারসি শব্দ কি ভাষা বিষয়েও সিদ্ধাচার্য। শব্দ-প্রয়োগের প্রাবল্য আর পরিভাষার দাপটে কান খাড়া করে রাখতে হয়। একটু পিছলে গেলেই শব্দ আর অর্থ কর্ণকূহরের বাইরেই ঘুরপাক খাবে! ভেতরে ঢোকার সুযোগ পাবে না। 

মুসলিম জীবনের অন্দরমহল সম্পর্কে শামিম আহমেদের ধারণা বেশ পরিস্কার।  নারী ও পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে তার বোঝাপড়া সাহিত্যসৌন্দর্যে অতুল্য। নিজের মাতৃভূমির প্রতি ঋণ শোধ করতে চেয়েছেন ‘মুর্শিদাবাদ রহস্য’ নামক গ্রন্থে। দেশভাগের ওপর লিখেছেন ‘সাত আসমান’। অনেকে এ-উপন্যাসকে বাংলা সাহিত্যের এক নতুন ধারা বলে উল্লেখ করেছেন। দুই বাংলার জীবন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তার কথাশিল্পের বোধ। ‘আঠারো পর্ব’, ‘ফেয়ারলনে মধুবালা’, ‘শেফালি’, ‘বিলকিস বেগমের পতনজনিত আখ্যান ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থগুলোতে তো সেই কথাশিল্পীর সাক্ষর—জীবন যেখানে অনাঘ্রাত, পুষ্পের মতো সুবাসিত। 

অন্যদিকে জন্ম কি পড়াশুনার কারণে কলকাতা থেকে শরীরী দূরত্ব সত্ত্বেও শামিম আহমেদ তা অতিক্রম করেছেন স্বচেষ্টায়। কলকাতার জীবনের প্রতিও তার আগ্রহ প্রশংসনীয়। মোগল যুগের শেষচিহ্ন বাহাদুর শাহ্ জাফরের ফারসি কেতা হয়তো শামিম আহমেদের জানা। আর উর্দু গজলের যুগ-অতিক্রমী কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে লিখেছেন ‘কলকাতায় গালিব’। অন্বেষণের সঙ্গে হৃদয়াবেগের যোগে এই গালিব যেন অনন্য। 

মসনভি, গজল, মর্সিয়া, ঠুমরির লেখক ও অনন্য সুরকার রাজা ওয়াজিদ আলি শাহের জীবনকে কেন্দ্র করে শামিম আহমেদ লিখেছেন উপন্যাস ‘আখতারনামা’। ভারতের শেষ রাজা তিনি। অবধ তথা অযোধ্যার এই রাজা সিপাহী বিদ্রোহের আগে রাজমুকুট হারিয়ে রাজধানী লখনউ ছাড়েন। আর ব্রিটিশের পেনশনভোগী হয়ে কলকাতায় পদার্পণ করেন। তার ‘মেটিয়াবুরুজ’কে (অর্থাৎ মাটির কেল্লা) বানিয়ে ফেলেন রাজধানী ছোটা লখনউ। নাচ গান বাজনা থিয়েটারে মেতে উঠল তা। আক্ষরিক অর্থেই একে রীতিমত চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলেছিলেন, যার 'হাতিশালে হাতি আর ঘোড়াশালে ঘোড়া'। 

গীতিকার ও সুরকারই কেবল নন, ওয়াজিদ আলি বিশেষজ্ঞ ছিলেন কথক নৃত্যে। রচনা করেছেন ধ্রুপদী সঙ্গীতের ইতিহাস, তৈরি করেছেন পঞ্জিকাও। অন্যদিকে নির্মাণ করেছেন অজস্র ইমারত, ছাপাখানা, বাজার, ইমামবাড়া। কিসের অতৃপ্তি বা আকাঙ্ক্ষায় প্রভূত নারীসঙ্গ করেছেন রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ—তা যেন লা জবাব! সেই রহস্য খচিত আছে শামিম আহমেদের ‘আখতারনামা’ উপন্যাসে।  ‘আখতারনামা’ আসলে এমন এক জীবনালেখ্য যা রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ’র জীবনের আদলে লেখা কিসসা। যা হয়তো স্বয়ং তিনিই লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু লিখে উঠতে পারেননি। কথাশিল্পী শামিম আহমেদ তাকে পূর্ণতা দিয়েছেন। 

অন্যদিকে ইতিহাসজ্ঞানে শামিম আহমেদ পূর্ণ করতে চেয়েছেন চিরায়ত শিল্প। ‘বিষাদ-সিন্ধু; উপন্যাসে মীর মশাররফ হোসেন পুথিসাহিত্য মারফত যা উপহার দিতে চেয়েছেন, ‘বিষাদবিন্দু’ আখ্যানের মধ্য দিয়ে তা শামিম আহমেদ করতে চেয়েছেন ইসলামের ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ অভিজ্ঞানকে ধারণ করে। একদিকে ঔপন্যাসিকের রসবোধ, অন্যদিকে জীবনের বাস্তবধর্মে (বিশেষত) এজিদ চরিত্র অনন্য হয়ে উঠেছে। শিল্পী মনের সংঘাতে ধরা দিয়েছে তার রাজনৈতিক জীবন। 

সুফি দর্শন, মহাভারত, রাজনীতি, ইতিহাস, উপন্যাস, স্মৃতি, রহস্য— এতো কিছুর ভিড়ে রীতিমতো বুদ হয়ে আছি। এর মধ্যেই একদিন আলাপে আলাপে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হলে শামিম আহমেদকে প্রস্তাব দিলাম, “চলেন বিভূতিভূষণের অরণ্যে বেরিয়ে আসি।” অবাক হয়ে তাকালেন, ভাবলেন, কোনো ঐতিহাসিক কথা বলছি নাকি! আমার ইচ্ছে হলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের পেছনে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে তাকে বলবো, “এই হলো বিভূতিভূষণের অরণ্য।” সেদিকে আর যেতে হলো না। বিজ্ঞান কারখানার পাশ দিয়ে একটা চমৎকার রাস্তা চলে গেছে নিরেট বনভূমি হয়ে। সেখান থেকে ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের দিকে যাওয়ার পথে অরণ্যভূমিতে ঢুকে পড়লাম কয়েকজন। এরমধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছি। দিনের বেলাতেই সেখানে শেয়াল ডাকে। আর শুষ্ক দিনে পায়ের তলায় শুধুই পাতার মচমচ শব্দ শোনা যায়। একদিকে মৃদু ভয়, আরেকদিকে রহস্য। বেশ! বিমুগ্ধ চিত্তে ফিরে এলাম। ছবিটবিও কিছু তোলা হলো।   

লোকে ভাববে বৃথাই কথা বাড়াচ্ছি। এদিকে ‘পাকদর্শন’-এর কথা তো বলাই হলো না! একদিন সিরিয়াসলি বললাম, “তা পাকিস্তান-টাকিস্তান নিয়েও দেখি আপনার আগ্রহের কমতি নেই!” উষ্মা নিয়ে বললাম, “বলেন তো, পাকিস্তানের আবার দর্শন কী? আছে নাকি কিছু?” তিনি হো হো করে একচোট হাসলেন, তারপর বললেন, “আরে, ওইটা, ওটা তো রান্নার বই!” আমি ধপ করে আকাশ থেকে পড়লাম। একটা মৃদুমন্দ গালি দিয়ে বললাম, “তা, রান্নাও আপনাকে করতে হবে? এতো সময় আপনার!” বললেন, “পড়ে দেখেন, রান্নার স্পেশালিটিও জানার বিষয়, হা হা হা হা!” আসলে রান্নার বই তো শুধু রান্নার বই নয়। বরং তার মশলা হলো--পুরাণ, ইতিহাস আর আড্ডা। 

শামিম আহমেদকে নিয়ে এতো কথা মনে পড়ছে যে, তা এখানে সঙ্কুলান হচ্ছে না। ওনার পঞ্চাশতম জন্মদিন বেশ ঘটা করে পালন করা হয়েছিল। অবশ্য (হামীম-শামিম দুই নামে একইদিনে) তা বেশ উৎসবমুখরভাবে পালন করা হয়েছিল কবি শামীম রেজার বদান্যতায়। আমার বক্তৃতা দেবার কথা থাকলেও, সেদিন আমি আর মঞ্চে উঠতে পারিনি। একইদিনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান থাকায় তা শেষ করে সেখানে পৌঁছুলাম। তখন বেশ দেরি। ততক্ষণে গানের অনুষ্ঠানের পর্ব শুরু হচ্ছে। মন খারাপ করে হাত বাড়িয়ে শামিম আহমেদকে বললাম, “দেখুন, একেই ভাগ্য বলে! তা বিশ্বাস করি বা না করি!” হামীম কামরুল হক এবং শামিম আহমেদ দুজনকে নিয়েই আমার কিছু বলার কথা, আমি যা লিখেও রেখেছিলাম পূর্ব-প্রস্তুতি স্বরূপ, তা আর পাঠ করা হলো না! বাড়ানো হাতটা কিন্তু চেপে ধরাই আছে, শামিম আহমেদ নির্বিকারভাবে বললেন, “তাতে কি! এসেছেন এই তো বেশি! আবার হবে কখনও।” মুখ তার ভাবলেশহীন। আর আমি ভাবছি, এতোক্ষণ ধরে মঞ্চের লোকেদের প্রশংসা আর স্তুতিবাক্য শোনার পর আমার কথা তার ভালো লাগবে কোন যুক্তিতে!

আজ কথাশিল্পী শামিম আহমেদের জন্মদিন। এই বিশেষ দিনে তাকে না বলা কথাগুলো জানাতে ভীষণ ইচ্ছে হলো। আরও ইচ্ছে হলো অন্যদেরকেও তা জানাই! আসলে গুণীদের সাহচর্য পরম আনন্দের! অনেক কিছুই থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। কথায় আছে—জীবিত জ্ঞানীমানুষ একটি গ্রন্থাগারকেও ছাড়িয়ে যায়! 

০২.০৭.২০২৪ । রাত ২.১০ মিনিট


লেখক: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা। ওয়েব-সংযোগ : https://khorsed-alam.blogspot.com/

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন