কো উনের কবিতা


‘শিম চেয়ং-এর লোকগাথা’* উল্লেখযোগ্য পাঁচটি কোরীয় লোকগাথার একটি। নিচে লোকগাথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় রয়েছে। আমার আরেকটি অনুবাদ কবিতা “কো উনের কবিতা : খুলির নীরবতা” নামক বইয়ে স্থান পেয়েছে। সম্পাদনা করেছেন : ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ।
শিম চেয়ং-এর পরিচয়
কোরিয়ার লোকগাথার এক দুঃখী কন্যা শিম চেয়ং। অন্ধ বাবার চোখ ভালো করার জন্য সাধুর পরামর্শে গৌতম বুদ্ধকে বিপুল পরিমাণ চাল উৎসর্গ করতে চায় সে। সেই চাল জোগাড় করতে গিয়ে নিজেকে সে নাবিকের কাছে বিক্রি করে। নাবিকেরা সমুদ্রে ভাসার পর ঝড়-তুফান উঠলে শিম চেয়ংকে উৎসর্গ হিসেবে সমুদ্রে ফেলে দেয়। সমুদ্রের অতলে সমুদ্র-রাজার প্রাসাদে আশ্রয় মেলে তার। রাজা তাকে পদ্মের কুঁড়িতে স্থাপন করে নিজ দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দেন। আবার তাকে পায় ঐ নাবিকেরা। তারা তাকে নিয়ে যায় তাদের রাজার কাছে। রাজা সেই পদ্মে ছুঁয়ে দিতেই জেগে ওঠে অপূর্ব সুন্দরী কন্যা শিম চেয়ং। রাজা সেই কন্যাকে বিয়ে করেন। রানি শিম চিয়োং পরে তার বাবাকে ফিরে পায়। বাবাও ফিরে পান তাঁর দু চোখের আলো।
ইনদাংসু সাগর
রূপকথার মেয়ে শিম চেয়ং অন্ধ বাবার চোখে আলো ফেরাতে ঝাঁপ দিয়েছিলো যে সাগরে, তারই নাম ইনদাংসু সাগর। ‘শিম চেয়ং-এর লোকগাথা’ উল্লেখযোগ্য পাঁচটি কোরীয় লোকগাথার একটি।

শিম চেয়ং-এর লোকগাথা
(অনুবাদ : খোরশেদ আলম)
গভীর নীলে আচ্ছাদিত ইনদাংসু সাগর,
গর্জন করছে যেন মেঘে মেঘে আঘাত।
জানে সমুদ্রের জল, জানে সমুদ্রের নাবিকেরা
পৃথিবীর কালো দুঃখের এক অধ্যায়
অতীতে মিশে আছে যে পথ, কখনো ওঠে ভেসে
পৃথিবীতে জন্মানো শিশুর কান্নার বিলাপ,
নাবিকেরা জানে আমার কন্যার পথ।
ধরা বিনা থাকে না জলের অস্তিত্ব
শুধু ভীতি এখন এ বিশ্বের চাওয়ার উপাদান,
আমার মেয়ের কান্না পদ্মের পাপড়ির ওপর যেমন;
ভালোবাসা দিতে পারে উজ্জ্বল পৃথিবী
কিন্তু অন্ধকারে চোখ ডুবে যায়
কন্যা, এখন জলই তোমার মাতা,
জলের ওপর দিয়ে বয়ে যাও,
জলের ওপর দিয়ে বয়ে যাও
জলের ওপর বাষ্প যেভাবে পতিত হয়।
কন্যা আমার, এগিয়ে যাও ভ্রমণ কর পৃথিবীময়।
ইনদাংসুর উজ্জ্বল নীল, কাঁদো গভীরতায়।

কোরিয়ার কবি কো উনের এই তিনটি কবিতার অনুবাদ সর্বপ্রথম সপ্তসিন্ধু দৈনিক ডেসটিনিতে প্রকাশিত হয়েছিল। 

ভালোবাসা দিতে পারে উজ্জ্বল পৃথিবী
দক্ষিণ কোরিয়ার কবি কো উন ১৯৩৩ সালের ১১ এপ্রিল এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান উত্তর জিওলা প্রদেশের কুনসান নামক এক নিসর্গভূমিতে। ১৯৪৫-এর যুদ্ধে এটি বিধ্বস্ত হয়। কোরিয়া যুদ্ধের সময় তিনি কুনসান মিডল স্কুলের ছাত্র। কোরিয়া যুদ্ধ কো উনের শারীরিক-মানসিক জগতে তীব্র প্রভাব ফেলে। এ যুদ্ধে এসিড দিয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার শ্রবণযন্ত্র। ১৯৭৯ সালে পুলিশ কর্তৃক প্রহারে তার শ্রবণযন্ত্রের অবস্থা হয় আরো শোচনীয়। ১৯৫২ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই তিনি একজন বৌদ্ধ সন্ন্্যাসীতে পরিণত হন। প্রায় দশ বছর ধরে বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরাগী থেকে তিনি সন্ন্যাসব্রত পালন করেন। তবে ১৯৬২ সালেই এ জগৎ থেকে একরকম বিদায় নিয়ে সেক্যুলার মনোভাব নিয়ে তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ সক্রিয় আন্দোলনকারী হিসেবে সংগ্রামী জীবনে প্রবেশ করেন। সংগ্রামী চরিত্রের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার একজন আধুনিক কবি হিসেবেও তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। একযুগ আগে ঘটে যাওয়া যুদ্ধে শারীরিক-মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত কো উন তীব্র যন্ত্রণায় আত্মহত্যা করতে যান ১৯৭০-এ, ফিরে আসেন। হতাশাকে ঝেরে ফেলে, নানা প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে তিনি জীবন ও মৃত্যুর সমীকরণ তৈরি করতে পারেন। ১৯৭২-এর পর থেকে এক দশক তার সংগ্রামী জীবনের উত্তুঙ্গ সময়। দফায় দফায় জেলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে তার সংগ্রামমুখর জীবনে। ১৯৭২ সালের পর মোট চারবারের মতো তিনি জেল খেটেছেন। ১৯৮০ সালে চুং ডু হুয়ানের নেতৃত্বে 'ক্যু ডি'ট্যাট'-এর ফলে বিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ পান তিনি। ১৯৮২-র এক সাধারণ ক্ষমায় তার দ- মওকুফ হয়। এরপর থেকে অধ্যাপনা ও লেখালেখি তার জীবনের পেশা ও নেশা। ২০০৭ সাল থেকে সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাব্যতত্ত্ব ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে তিনি নিয়োজিত আছেন। কো উন মূলত একজন কবি। কবিতা ছাড়াও উপন্যাস, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ লেখক ও অনুবাদক হিসেবেও তিনি পরিচিত। প্রায় ১৫টি দেশে তার লেখা অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে। কো উন বর্তমান এশিয়ার প্রভাবশালী লেখকদের একজন। প্রায় একযুগেরও বেশি সময় ধরে নোবেল পুরস্কারের তালিকায় নাম উঠলেও নোবেল পাওয়া হয়নি তার। যেবছর উনের-ই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মো ইয়ান নোবেল পেলেন তখনও সংক্ষিপ্ত তালিকায় তার নাম অন্তর্ভূক্ত ছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন