খৈলানপালা : জীবন ও মানুষের শিল্প

মূল লিঙ্ক : খৈলানপালা : খোরশেদ আলম

খৈলান পালা : জীবন ও মানুষের শিল্প -খোরশেদ আলম

08 Dec 2022, 01:35 PM রঙ্গশালা শেয়ার:   
খৈলান পালা : জীবন ও মানুষের শিল্প -খোরশেদ আলম

আমরা সবসময় দাবি করি একটা মানবিক পৃথিবীর। সেই মানবিক পৃথিবী তৈরির জন্য বহু মানুষ শ্রম-সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার নজির রেখে গেছেন। বর্তমান পৃথিবীতেও এসব দৃষ্টান্ত গ্রহণ করে কেউ কেউ মানবিক-চর্চার অংশীভূত হচ্ছেন। নাট্যশিল্প এক্ষেত্রে বড়ো নিয়ামকের একটি। শিল্পের বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাম্য ও মানবতার পৃথিবী সৃষ্টি করা। শিল্পের জন্য শিল্প নয় শুধু; শিল্প মানুষের জন্য।

পৃথিবীতে সেই সভ্যতার শুরুর দশা থেকে আজ-অবধি বহু কাঠামো খোদ্ শিল্পের মধ্যে তৈরি হয়েছে। কখনো নিরীক্ষাপ্রিয়তাই শিল্পের উচ্চতম ভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিরীক্ষা আসলে সব জায়গাতেই কমবেশি কিছু না কিছু থাকে। তবে নিরীক্ষার চেয়েও বড়ো হয়ে দাঁড়ায় মানব-মুক্তির প্রসঙ্গ। নইলে মহারথী নাট্য-নির্মাতারা বারবার শেকড়ের টানে ফিরে যান কেন? নিশ্চয়ই সেখানে ভিন্নতর-গভীরতর চিন্তা-চেতনার নিবিষ্টতা রয়েছে। এর মধ্যে নিহিত মানুষ সম্পর্কে, মানুষের সমাজ সম্পর্কে অনেক বাঁক-বিভঙ্গতা আর তরঙ্গসঙ্কুল জীবনানুভবতা।

প্রসেনিয়াম থিয়েটার চার দেয়ালে আবদ্ধ। প্রগতির শক্তিমত্তা সেখানে থাকলেও সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ফলে একটি শূন্যস্থান থেকেই যায়। সেখানে গ্রিক-শেক্সপিয়রীয় প্রসেনিয়াম, বার্থোল ব্রেখটীয় ক্লাসিক এপিক থিয়েটার বা ইবসেনের আধুুনিক প্রয়োগ-নাট্যরীতি সবগুলোতেই প্রায় একই ঘটনা ঘটে। সবসময় সবার জন্য এই শিল্প ধারণযোগ্য হয়ে ওঠে না। সাধারণ মানুষের কাছে যাবার প্রকৃষ্ট রাস্তা অনেকেই তাই খুঁজতে চেয়েছেন। কিন্তু শক্তিশালী জনমাধ্যম হিসেবে সরাসরি মানুষের কাছে যাবার বিকল্প কিছু তৈরি হয়নি। এমনকি রেকর্ডকৃত টেলিভিশন নাটকের দৌরাত্ম্য বা আজকের ওয়েব-সিরিজও সরাসরি মানুষের কাছে যাবার প্রক্রিয়াকে থামাতে পারেনি। ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগতে মানুষ অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলে। সেই হারানোটা আবার ফিরে পেতে উদগ্রীব থাকে প্রত্যক্ষ প্রদর্শনীয়তার সন্নিকটে এসে।

এমনিতেই নাটক নামক ধারণাটা বলা যায় সকল শিল্পের মিলনবিন্দু। ফলে মানবজীবনের নানা উপাদানের মিশ্রণ এখানে অনায়াসে ঘটে যায়। আর সরাসরি পরিবেশনের ফলে মানুষের সবচেয়ে কাছে তা চলে আসে। এখন প্রশ্ন হলো এই মানুষ কারা? সেখানে শ্রেণি-পেশা-বৃত্তি অধ্যুষিত নানা জটিলতা রয়েছে। তবুও সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশাগোষ্ঠীর মানুষের, বিশেষত নিম্নবিত্ত কিংবা গ্রামে বসবাসকারী মানুষের শিক্ষা ও বিনোদনের চাহিদা পূরণ করতে পারে এই নাটক। আগের দিনে যাত্রা, অপেরা, পালা ইত্যাদি নামে সেগুলোর প্রচলন ছিল, এখনো আছে।

আমরা এখন যেটাকে আধুনিক নাটক বা থিয়েটার বলি তা পাশ্চাত্য চিন্তাচেতনার রূপ-রূপায়ণ। কিন্তু দেশীয় কাঠামোতে শিল্প-নির্মাণ করতে হলে দেশের মধ্যে ফিরতে হয়। এই ফেরাটা নানাভাবে ঘটে। অতীত পুনরুদ্ধার, মানুষের কল্পনার জগতকে একটু অন্যদিকে ঘোরানো, পরিচিত জগতের ভিন্নতর উপস্থাপনা- এসবই সেখানে ভূমিকা পালন করে। একদিকে জনমানুষের সংস্কৃতি-জগৎ, অন্যদিকে রীতি বা নিয়মের দ্বারা পরিচিত শৈল্পিক কাঠামো-সবকিছুর মধ্য দিয়েই শিল্পকে জাগিয়ে রাখতে হয়।

এতো কথা বলার উদ্দেশ্য ‘খৈলান পালা’ নামক নাট্য-শিল্পরীতি। এটি ঐতিহ্যবাহী পুরনো পালা ও আধুনিক নাটকের মিশ্রণ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এ-বিষয়ে লেখালেখির মাধ্যমে হয়ত খানিকটা জেনে গেছে। এরমধ্যেই এলাকার নানা জায়গায়, বিভিন্ন জেলায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত এই পালার পরিবেশনারীতি পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রায় অর্ধশত প্রদর্শনীও সম্পন্ন হয়েছে। 

গাইবান্ধা জেলা শহরের অদূরে দারিয়াপুরে অবস্থিত ‘সারথি থিয়েটারে’র মধ্য দিয়ে পালাটি (‘খৈলান পালা’) বেশ কিছুদিন ধরে পরিবেশিত হচ্ছে। নাট্যজন জুলফিকার চঞ্চল এই ‘খৈলানপালা’র অভিনয়রীতি-নির্দেশক ও স্ক্রিপ্ট নির্মাতা। বলা বাহুল্য, ‘সারথি থিয়েটার’কে শত প্রচেষ্টায় অজস্র বাধাবিঘ্ন ঠেলে বহুদূর বিস্তৃত করেছেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মহলে ইতোমধ্যে তিনি বেশ সুনামও কুড়িয়েছেন। এ-প্রসঙ্গে আরেকজন ব্যক্তির নাম আসে, তিনি ‘সারথি’র সিনিয়র সদস্য, নির্বাহী পরিষদের প্রথম সভাপতি নজরুল ইসলাম। কম বেতনের চাকুরি করেও ত্যাগ ও সময়ের বিবেচনায় পরিবার-সন্তানের মতো তিনি ‘সারথি’র পাশে সদাজাগ্রত। এসব কথা বলার কারণ- একটা শিল্পরীতি তৈরি, প্রচার ও পরিবেশনের কাজটা বাইরে থেকে যতটা সোজা ভাবা যায়, ভেতরে ঠিক ততটাই কঠিন। জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য, অপরিসীম ত্যাগ আর শিল্পের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে তা কখনোই সম্ভব নয়। নাট্যজন জুলফিকার চঞ্চলের মতো মানুষদের হার্দিক অভিবাদন যে, তাঁরা সে-কাজটাই বাস্তবে করে দেখাচ্ছেন।

এরমধ্যে আরও কথা আছে; তা হলো- অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের অবস্থা ও অবস্থান। তারাও এই ত্যাগ ও ভালোবাসার সমান অংশীদার। অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন। প্রধান গায়েন থেকে দোহার, রাম-রাবণ-ল²ণ থেকে ছোটো বেহালাবাদক শিশু অভিনেতা সবাই যে যার স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত দক্ষ শিল্পী। রাবণের চরিত্রে চণ্ডীচরণ বর্মণ সীতাহরণ করেন। তিনি একজন আন্তরিক শিল্পী। জীবনের বহু মূল্যবান সময় তিনি যাত্রা, পালা কিংবা তবলাবাদক হয়ে ব্যয় করেছেন। সংসার-উদাসীন মানুষটির রয়েছে শিল্পের প্রতি অসীম আত্মত্যাগ। আব্দুল হামিদ নামক আরেকজন মানুষের মধ্যে সংস্কৃতিবোধ অত্যন্ত প্রখর। অভিনয়-প্রক্রিয়ার মধ্যেই দর্শকসারি থেকে তাঁর কথা ভেসে আসে। এই মানুষদের জীবনের সিংহভাগ সময় শিল্পরস উৎপাদনকর্মে নিয়োজিত। স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তাঁরা আজীবনই নাটক বা শিল্পজগতের স্বেচ্ছাসেবী।

পালার প্রধান গায়েন ও শিল্পী যিনি, তাঁর পরিশ্রম ও গুণের কথা বর্ণনাতীত। তাঁর বাড়ির সন্নিকটে পালা উপস্থাপনা হয়। রিজু আহমেদ একজন সত্যিকার শিল্পী। পেশায় ভ্যানচালক এই ব্যাক্তির মধ্যে রয়েছে একটা বিরাট আলোকিত বিশ্ব। বহু মানুষ গ্রামে-শহরে জ্ঞানীগুণী হয়। কিন্তু এই ব্যক্তির ভেতরে অনন্য এক মানুষ বাস করে। গানের দরাজ গলা, বাদ্যবাজনা, অভিনয়, আত্ম-আবিষ্কার সবকিছু বিবেচনায় তিনি একজন কুশলী কারিগর। আমার সৌভাগ্যÑ স্বল্পতম সময়ের মধ্যেও তাঁর অন্তর্লোকে প্রবেশে কিছুটা সক্ষম হয়েছি। তাঁর ভেতরে লুকিয়ে থাকা মহিমাময় সত্তাকে অনুভব করতে পারঙ্গম হয়েছি। এটাকে বলব, সত্যিকারের সংযোগ তথা শৈল্পিক ‘এটাচ্মেন্ট’। শিল্প-অনুভবের জন্য এটা খুব জরুরি বলে মনে হয়েছে। একজন পালা-শিল্পীর জীবনের অন্তর্বেদনা, অক্ষমতা, দারিদ্র্য, সর্বোপরি সে-সব ছাড়িয়ে অন্তর্জ্ঞানের ছোঁয়া ও আলোকের প্রাণোচ্ছ¡টা-অনুভব যেন এক অমিত অভিজ্ঞতার জগৎ। এই জগৎ কোনো কিছুর বিনিময়ে ক্রয় করা যায় না; শুধু হৃদয় দিয়েই তা অনুভব করা যায়।

১৩ জুলাই ২০২২-এর দিবাগত রাত ছিল গুরুপূর্ণিমা। পৃথিবীর সকল গুরুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের আরম্ভ। মধ্য জুলাইয়ের প্রচণ্ড গরমে দরদর করা ঘাম উপেক্ষা করেই পালাটি সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে না নামতে শুরু হয়। আর শেষ হয় রাতের প্রায় মধ্যবর্তী সময়ে। তবে দিনের আলোতেও এই পালা অনুষ্ঠিত হতে পারে। কারো বাড়ির বড়ো উঠানে এই পালা অনুষ্ঠিত হওয়ার স্থান। অন্যদিকে গ্রামের বাড়িগুলোর সামনে এমনিতেই এক চিলতে উঠোন থাকে। দিনের সব কাজ সাঙ্গ হলে মহিলা পুরুষ শিশু বৃদ্ধ সবাই এই পালার দর্শক হয়ে ওঠে। ‘খৈলান পালা’র বৈশিষ্ট্যই তা-ই। বাড়ির খোলা আঙিনায় প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনদিক খোলা সমতল বা সামান্য একটু উচু মঞ্চে তা পরিবেশিত হবে।

পালা-নির্মাতা ও নাট্যনির্দেশক জুলফিকার চঞ্চলের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি- করোনার সময় আসলে এই ‘কনসেপ্ট’ তাঁর মাথায় এসেছে। সারা বাংলাদেশ কি বিশ্ব-পরিস্থিতি তখন মারাত্মক খারাপ। ঠিক সেই সময়ে শিল্পের প্রতি মহান দায়িত্ব-বশেই তিনি তাঁর দলবল নিয়ে নতুন ধরনের চিন্তা শুরু করেন। তাতে গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আরও নিবিড়তর হয়ে ওঠে। কারণ এর আগে প্রসেনিয়াম মঞ্চের আদলে তিনি বহু নাটক পরিবেশন করেছেন। তাঁর বর্তমান অবস্থা হলো প্রসেনিয়াম না করার ব্রত পালন। আদতে জনমানুষের হয়ে সত্যিকারের পরিবর্তনের কাজটা তাঁরা করতে চান।

করোনাকালে ‘সারথি থিয়েটার’-এর পালা সংঘটনের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। মানুষের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করে তারা নাটক শুরু করেন। স্বাস্থ্য-সচেতনতার মতো একটা সামাজিক দায়ভারকেও মিটিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে শিল্পের মৌল গুরুভার দায়িত্ব তো রয়েছেই। আসল কাজ মানুষের কাছে, বাড়ির দোরগোড়ায় শিল্পকে পৌঁছে দেওয়া। বিশেষত গ্রামের মহিলা-শিশুসহ অনেকের পক্ষে বাড়ি ছেড়ে মফস্বলে-গঞ্জে-শহরে গিয়ে আধুনিক থিয়েটার দেখা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। কিন্তু এই ‘খৈলান পালা’ যেহেতু বাড়ির ‘খুলি’তে বা খোলা আঙিনায় অনুষ্ঠিত হয়, সেহেতু শিল্পের গভীরতর স্বাদ তারা সহজেই উপভোগ করতে পারেন। আমরা নারীজাগরণের কথা শুনতে-বলতে পছন্দ করি। আমার কাছে মনে হয়েছে- এই ধরনের পরিবেশনারীতির মধ্য দিয়ে প্রায়োগিক অর্থে সেই জাগরণের দায়িত্বটি পালিত হচ্ছে অনেকখানি।

সংলাপ, গান, নৃত্য সর্বোপরি কাহিনি থাকার কারণে সব মিলে দর্শক-শ্রোতার কাছে ‘খৈলান পালা’ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষের মধ্যে সরাসরি সংযোগ ঘটছে। সংলাপ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অভিনেতা-দর্শকে তা স্থাপিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষায় সংলাপ উপস্থাপন ও অভিনেতা-দর্শকদের আন্তঃসংযোগের ফলে পরিবেশনা হয়ে ওঠে একান্তই প্রাণময়। অনেক সময় সরাসরি দর্শকসারির কাউকে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়, কিংবা দর্শকের মধ্য থেকেই অভিনেতা কথা বলে ওঠেন কিংবা তারা স্বয়ং দর্শকের সঙ্গেই কথা বলেন। এভাবে চমৎকার একটি প্রাণবন্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দর্শক নাটক থেকে বাস্তবে আবার বাস্তব থেকে নাটকে ফিরে যাবার প্রয়াস লাভ করে। এ-ধরনের পরিবেশ তৈরি প্রসেনিয়াম মঞ্চে কিংবা শহরের মঞ্চে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়ত সম্ভব হয় না। আনন্দঘন পরিবেশের ভেতর দিয়ে দোয়ারকি চরিত্র নাট্যমঞ্চকে গতিশীল করে। যেমন প্রসেনজিৎ রায় ভুতু নামক ছেলেটি দর্শকের মধ্যে সবসময় আনন্দ ও হাস্য-পরিহাসময় অবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে যারা ঠিক অভিনেতা নন কিন্তু বাদ্য-বাজিয়ে, তারাও পালার নেপথ্য অনুঘটক। শ্রী দীগেন্দ্রনাথ সরকারের মতো অনেকেই তাদের সাংসারিক শত কাজ ফেলে শিল্পের কাজে স্বনিয়োজিত। তাদের আনন্দ ও ত্যাগ জীবনের সমরেখায় অঙ্কিত।

সংগীত মানুষের আত্মার কথা বলে। গানের মধ্য দিয়ে পালা পরিবেশনের ফলে মানুষের তথা দর্শকের প্রাণচঞ্চলতা আরও বৃদ্ধি পায়। আর খৈলান-পালায় পরিবেশিত গানগুলো সাধারণত এলাকার ঐতিহ্য-ভিত্তিতে গঠন করা। ভাওয়াইয়া গানের অপরূপ ভঙ্গিটা এখানে অনায়াসে শিল্পরসের আকর হয়ে ওঠে। ‘কানিছাত্ গাড়িনু আকাশি আকালি/আকালি ঝুমঝুম করে রে বন্ধুয়া/বাতাসে হেলিয়া পড়ে।’ এভাবে গ্রামীণ জীবনের উপকরণগুলো গানের ভেতর দিয়ে নাট্য-অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।

অভিনয়শিল্পী শবনম নূপুর, বীথি সরকার, কেয়া রায় প্রমুখের সঙ্গে আলাপে অনেক কিছু জানতে পারি। আমার আগ্রহ ছিল গ্রামের নারীদের মধ্যে জাগরণ কীভাবে ঘটছে তা জানা। কাজকর্ম ও পারিবারিক নানা দায়ে পিষ্ট গ্রামীণ নারীসমাজের মধ্যে এ-পালার বিশেষ ভূমিকা টের পাওয়া যায়। অবশ্য তারা আগে থেকে কেউ কেউ বেহুলা, রূপবান, কোজাগরি গানের সঙ্গে পরিচিত। তবুও আধুনিক সময়ে প্রভূত উপকরণ ও মিডিয়ার দোর্দাণ্ড প্রতাপে অনেক কিছু প্রায় বিস্মৃতির অতলে। যদিও সেটা অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্ম যারা স্মার্টফোনে আসক্ত তাদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটছে। অন্য অর্থে, গ্রামীণ নারীরা আগের অবস্থানেই রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা যেন আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে। যেমন একসময় সিনেমা হলের রূপালি পর্দার জগৎ তাদের আবিষ্ট করত। কিন্তু পারিবারিকভাবে অদর্শনযোগ্যতা, অশ্লীলতা, বাণিজ্যিকীকরণের প্রতাপ প্রভৃতি সিনেমা-শিল্পের ধস নামিয়েছে, তাদের হল বিমুখ করেছে। একসময় আমরাও দেখেছি, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘রূপবান’ প্রভৃতি সিনেমার জন্য তাদের অসীম কৌতূহল, ঔৎসুক্য ছিল। অন্যদিকে থিয়েটার বা নাট্যমঞ্চগুলো শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামীণ নারীদের উপস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। ‘খৈলান পালা’ সেই শূন্যস্থানে পূর্ণতার আভাস। এ-পালা পুরনো ঐতিহ্যবাহী কালকে, একইসঙ্গে পরিচিত জগতের কথা তুলে ধরে। আর এর ফলে একটা মনস্তাত্তি¡ক ঐক্যবোধেরও ব্যাপার ঘটে। ‘খৈলান পালা’ দর্শনে গ্রামীণ মানুষের মধ্যে একটা নতুন চেতনার জোয়ার তৈরি হচ্ছে।

বাংলাসাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সকল উপাদানই সংগীত-নির্ভর। চর্যাপদ থেকে শুরু করে মঙ্গলকাব্য সবই মিশ্র পরিবেশনরীতির শিল্প। আর এসবই হচ্ছে গান। আধুনিকতা এই অকৃত্রিম জীবন থেকে সরিয়ে আমাদের মোড়কাবৃত্ত করেছে। ফলে এদেশের শেকড় খুঁজতে হলে ঐতিহ্যবাহী গানের দিকেই দৃষ্টি ফেরাতে হবে। ‘খৈলান পালা’র উদ্ভবও এক ধরনের গান থেকে। গোটা উত্তরবঙ্গ তথা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, শুধু তা-ই নয়, ভারতের কুচবিহার ও আসাম অঞ্চল কিংবা রাজবংশীদের সংস্কৃতিতেও এ ধরনের গানের প্রভাব রয়েছে। ‘খৈলান পালা’ হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। বরং এর একটি ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস রয়েছে।

কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট অঞ্চলে রামায়ণের কাহিনি-নির্ভর ‘কুশান’ নামক একপ্রকার গানের প্রচলন ছিল বহু বছর আগে থেকে। কৃষকদের জীবন থেকে এই কুশান-সংস্কৃতির উৎপত্তি। রাজা দশরথের পুত্র রাম-লক্ষ¥ণ ও রামের স্ত্রী সীতাকে রাবণকর্তৃক হরণ, এছাড়া রামপুত্রদ্বয় লব-কুশের কাহিনি-নির্ভরতায় গড়ে উঠেছে এই ‘কুশান গান’। ‘খৈলান পালা’য় এর খানিকটা পরিবর্তিত রূপ রয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণ নয় কিংবা অনুবাদের হাত ধরে সৃষ্টি কৃত্তিবাসী রামায়ণ নয় বরং অদ্ভূতাচার্যের রামায়ণ এই ‘খৈলান পালা’র অবলম্বন। বাড়ির উঠানই কৃষকদের মন্দির। সেখানেই তাদের ফসল তোলা, ফসল মাড়াই, গোখাদ্য সঞ্চয় ইত্যাদি। জীবনের অবসরগুলো গল্পগাথায় ভরে ওঠে এখানেই। উঠানকে নাট্যমঞ্চ করলে তাদের জীবনের ভেতরে প্রবেশ করা যায়। হয়ত এরকম দর্শন থেকেই কোনো এককালে কুশান গানের প্রচলন ঘটেছিল। তবে কালে কালে এই কুশানের রূপও পরিবর্তিত হয়েছে। একটা রূপের কথা বেশ প্রচলিত। তা হচ্ছে ‘ব্যানা কুশান’। হাতে বানানো সারিন্দা (বীণা) সহযোগে এই গান গাওয়া হয়। এই ‘কুশান গান’ থেকেই রামায়ণের কাহিনিরূপ এসেছে ‘খৈলান পালা’য়। পরিবেশিত পালায় ক্ষুদে অভিনয় শিল্পী সংগীত কুমার লিখনের হাতে একটা কাঠের বেহালা দেখা যায়। দলের ওপর আক্রমণ চালিত হলে সেই বেহালাটা ব্যাঙবাবুর ছেলেরা দখল করে। দেখা যায়- বাড়িতে তারা সেই বেহালা দিয়ে ক্রিকেট ব্যাটের মতো খেলছে। এভাবে কায়েমি স্বার্থবাদীদের বীজ একদিন চারাগাছ থেকে মহাবিষবৃক্ষ হয়ে ওঠে। লিখন নামক অভিনেতা বালক ছেলেটির কান্না আর আর্তস্বরের চিৎকার সমাজের কূপমণ্ডকদের সাজানো পৃথিবী ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে দেয়। 

‘খৈলান পালা’ নাট্য-নির্মাতার নিজস্ব চিন্তার আদলে তৈরি। খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, এতে বর্তমান জীবনস্পর্শ তথা সা¤প্রতিকতার মধ্য দিয়ে সামাজিক জীবনের গভীর ব্যাপ্তি ঘটেছে। সমাজে সবসময়ই উপস্থিত থাকে একটা সা¤প্রদায়িক, ধুরন্ধর ও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। এরাই সমাজের গোপন ও প্রকাশ্য পরিচালক, কুচক্রী ও ষড়যন্ত্রকারী। এ-পালায় যারা শিল্পী-কলাকুশলী, তারা বিভিন্ন সামাজিক প্লাটফর্ম থেকে এসেছে। স্কুল পড়ুয়া ছাত্র থেকে শুরু করে নানা পেশাজীবী মানুষের পদচারণায় মুখর ‘সারথি’ নাট্যদল। তাদের ত্যাগ ও আত্মঅভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে অভিনেতার বাইরেও তারা আত্মসচেতন মানুষ। সা¤প্রদায়িকতা দ্বারা বিভাজিত সমাজের এবং গ্রাম্য-রাজনীতি নামক বিষবৃক্ষের মূল উৎপাটন করতে তারা যেন বদ্ধপরিকর। কিন্তু নীতিবান হয়েও অর্থনীতির চাবিটি যেন তাদের হাতে ধরা নেই। ফলে তারা ভাঙনের শিকার হয়। এই ভাঙনের মূলে স্বার্থবাদী ও কামুক ব্যাঙবাবু নামক সমাজ-প্রতিনিধিরাই ক্রিয়াশীল। চন্দ্রকলা নামক নারী অভিনেত্রীর প্রতি তার কামনা-চোখের অগ্নিশিখা জ্বলজ্বল করে। লোভ, কামুকতা আর লাভের জালে ফাঁদ পেতে তারা মানুষের চরিত্র নষ্ট করতে চায়। পালাকর্তা তথা প্রধান অভিনেতার হাহাকারের বাণী আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে। কিন্তু সে কখনো কায়েমি স্বার্থান্ধ শক্তির কাছে মাথা নত করে না। এখানেই তার চরিত্রের ঔজ্জ্বল্য ও বিশেষত্ব। বস্তুত রামায়ণে লুকায়িত মানুষের অমর অনুভব তথা জীবনধর্মিতা এখানে স্পষ্ট। তারা যূথবদ্ধ জীবনের অংশীদার বলে হেরে গিয়েও হারে না, বরং জীবনজয়ী হয়ে ওঠে। স্বার্থবাদী মানুষরাই পরাজিত হয়।

‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’-এর মতো এপিকগুলো এ-অঞ্চলের মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। উঠতে-বসতে জীবনের সুখ-দুঃখের গল্পগুলো এইসব রচনার মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তরে প্রবেশ করেছে। জীবনের নীতিবোধের সঙ্গে প্রবল বিদ্রোহ-বিপ্লবে ভরা সংক্ষুব্ধ রক্তাক্ত জীবনটাও মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে-সব কারণে বহুযুগচর্চিত নীতি ও কাহিনি-বয়নের পেছনে যে শৈল্পিক নির্ভরতা, আজও তা কমে যায়নি। ‘খৈলান পালা’-ই এর স্পষ্ট প্রমাণ। এই পালার সঙ্গে আধুনিক জীবনের বোধ সঞ্চারিত হয়েছে। আসলে কোনো শিল্পই সা¤প্রতিকতা ছাড়া টিকতে পারে না। বহুবছরের প্রচলিত কাহিনি-ঐতিহ্যগুলো এভাবেই বারবার নতুন হয়ে ধরা দেয়। আর এ-ধরনের পালার মধ্যে দায়িত্ববোধের প্রসঙ্গটিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের গ্রাম থিয়েটারগুলো এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। নাট্যজন জুলফিকার চঞ্চলের মতো কর্ণধাররা নিজেদের জীবনের সহজপ্রাপ্য সুখের প্রাপ্তিসমূহ বিসর্জন দিয়ে কঠোর-কঠিন সাধনায় মানুষের থিয়েটার বা শিল্প-নির্মাণে সদা জাগ্রত হয়ে থাকছেন। তাঁরা শুধু নাট্য-নির্দেশক নন, সমাজেরও শিক্ষক। তাদের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অন্তর থেকেই আসে। আরোপিত কোনো কিছু দিয়েই এই শিল্পের কুশীলব ও নির্মাতাদের ধরাছোঁয়া যায় না। একান্ত হৃদয়ের গভীর থেকেই তা উঠে আসে, অন্তরেই সমর্পিত হয়ে থাকে। 

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

https://nattolok.blogspot.com/2022/11/blog-post.html

আমরা সবসময় দাবি করি একটা মানবিক পৃথিবীর। সেই মানবিক পৃথিবী তৈরির জন্য বহু মানুষ শ্রম-সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার নজির রেখে গেছেন। বর্তমান পৃথিবীতেও এসব দৃষ্টান্ত গ্রহণ করে কেউ কেউ মানবিক-চর্চার অংশীভূত হচ্ছেন। নাট্যশিল্প এক্ষেত্রে বড় নিয়ামকের একটি। শিল্পের বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাম্য ও মানবতার পৃথিবী সৃষ্টি করা। শিল্পের জন্য শিল্প নয় শুধু; শিল্প মানুষের জন্য। 


পৃথিবীতে সেই সভ্যতার শুরুর দশা থেকে আজ-অবধি বহু কাঠামো খোদ্ শিল্পের মধ্যে তৈরি হয়েছে। কখনো নিরীক্ষাপ্রিয়তাই শিল্পের উচ্চতম ভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিরীক্ষা আসলে সব জায়গাতেই কমবেশি কিছু না কিছু থাকে। তবে নিরীক্ষার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় মানব-মুক্তির প্রসঙ্গ। নইলে মহারথী নাট্য-নির্মাতারা বারবার শেকড়ের টানে ফিরে যান কেন? নিশ্চয়ই সেখানে ভিন্নতর-গভীরতর চিন্তা-নিবিষ্টতা রয়েছে। এর মধ্যে নিহিত মানুষ সম্পর্কে, মানুষের সমাজ সম্পর্কে অনেকগুলো বাঁক-বিভঙ্গতা আর তরঙ্গসঙ্কুল জীবনানুভবতা। 


প্রসেনিয়াম থিয়েটার চার দেয়ালে আবদ্ধ। প্রগতির শক্তিমত্তা সেখানে থাকলেও সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ফলে একটি শূন্যস্থান থেকেই যায়। সেখানে গ্রিক-শেক্সপিয়রীয় প্রসেনিয়াম, বার্থোল ব্রেখটীয় ক্লাসিক এপিক থিয়েটার বা ইবসেনের আধুুনিক প্রয়োগ-নাট্যরীতি সবগুলোতেই প্রায় একই ঘটনা ঘটে। সবসময় সবার জন্য এই শিল্প ধারণযোগ্য হয়ে ওঠে না। সাধারণ মানুষের কাছে যাবার প্রকৃষ্ট রাস্তা অনেকেই তাই খুঁজতে চেয়েছেন। কিন্তু শক্তিশালী জনমাধ্যম হিসেবে সরাসরি মানুষের কাছে যাবার বিকল্প কিছু তৈরি হয়নি। এমনকি রেকর্ডকৃত টেলিভিশন নাটকের দৌরাত্ম্য বা আজকের ওয়েব-সিরিজও সরাসরি মানুষের কাছে যাবার প্রক্রিয়াকে থামাতে পারেনি। ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগতে মানুষ অনেককিছুই হারিয়ে ফেলে। সেই হারানোটা আবার ফিরে পেতে উদগ্রীব থাকে প্রত্যক্ষ প্রদর্শনীয়তার সন্নিকটে এসে।


এমনিতেই নাটক নামক ধারণাটা বলা যায় সকল শিল্পের মিলনবিন্দু। ফলে মানবজীবনের নানা উপাদানের মিশ্রণ এখানে অনায়াসে ঘটে যায়। আর সরাসরি পরিবেশনের কারণে মানুষের সবচে কাছে তা চলে আসে। এখন প্রশ্ন হলো এই মানুষ কারা? সেখানে শ্রেণি-পেশা-বৃত্তি অধ্যুষিত নানা জটিলতা রয়েছে। তবুও সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশাগোষ্ঠীর মানুষের, বিশেষত নিম্নবিত্ত কিংবা গ্রামে বসবাসকারী মানুষের শিক্ষা ও বিনোদনের চাহিদা পূরণ করতে পারে এই নাটক। আগের দিনে যাত্রা, অপেরা, পালা ইত্যাদি নামে সেগুলোর প্রচলন ছিল, এখনো আছে। 


আমরা এখন যেটাকে আধুনিক নাটক বা থিয়েটার বলি তা পাশ্চাত্য চিন্তাচেতনার রূপ-রূপায়ণ। কিন্তু দেশীয় কাঠামোতে শিল্প-নির্মাণ করতে হলে দেশের মধ্যে ফিরতে হয়। এই ফেরাটা নানাভাবে ঘটে। অতীত পুনরুদ্ধার, মানুষের কল্পনার জগতকে একটু অন্যদিকে ঘোরানো, পরিচিত জগতের ভিন্নতর উপস্থাপনা—এসবই সেখানে ভূমিকা পালন করে। একদিকে জনমানুষের সংস্কৃতি-জগৎ, অন্যদিকে রীতি বা নিয়মের দ্বারা পরিচিত শৈল্পিক কাঠামো—সবকিছুর মধ্য দিয়েই শিল্পকে জাগিয়ে রাখতে হয়। 


এতো কথা বলার উদ্দেশ্য ‘খৈলান পালা’ নামক নাট্য-শিল্পরীতি। এটি ঐতিহ্যবাহী পুরনো পালা ও আধুনিক নাটকের মিশ্রণ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এ-বিষয়ে লেখালেখির মাধ্যমে হয়তো খানিকটা জেনে গেছে। এরমধ্যেই এলাকার নানা জায়গায়, বিভিন্ন জেলায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত এই পালার পরিবেশনারীতি পরিচিত হয়ে উঠেছে। প্রায় অর্ধশত প্রদর্শনীও সম্পন্ন হয়েছে।    


গাইবান্ধা জেলা শহরের অদূরে দারিয়াপুরে অবস্থিত ‘সারথি থিয়েটারে’র মধ্য দিয়ে পালাটি (‘খৈলান পালা’) বেশ কিছুদিন ধরে পরিবেশিত হচ্ছে। নাট্যজন জুলফিকার চঞ্চল এই ‘খৈলান পালা’র অভিনয়রীতি-নির্দেশক ও স্ক্রিপ্ট নির্মাতা। বলা বাহুল্য, ‘সারথি থিয়েটার’কে শত প্রচেষ্টায় বাধাবিঘ্ন ঠেলে বহুদূর বিস্তৃত করেছেন। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মহলে ইতোমধ্যে তিনি বেশ সুনামও কুড়িয়েছেন। এ-প্রসঙ্গে আরেকজন ব্যক্তির নাম আসে, তিনি ‘সারথি’র সিনিয়র সদস্য, নির্বাহী পরিষদের প্রথম সভাপতি নজরুল ইসলাম। কম বেতনের চাকুরি করেও ত্যাগ ও সময়ের বিবেচনায় পরিবার-সন্তানের মতো তিনি ‘সারথি’র পাশে সদাজাগ্রত। এসব কথা বলার কারণ—একটা শিল্পরীতি তৈরি, প্রচার ও পরিবেশনের কাজটা বাইরে থেকে যতটা সোজা ভাবা যায়, ভেতরে ঠিক ততটাই কঠিন। জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য, অপরিসীম ত্যাগ আর শিল্পের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে তা কখনোই সম্ভব নয়। নাট্যজন জুলফিকার চঞ্চলের মতো মানুষদেরকে হার্দিক অভিবাদন যে, তাঁরা সে-কাজটাই করে দেখাচ্ছেন।

 

‘খৈলান পালা’ নির্মাতা, অভিনেতা ও নাট্য-নির্দেশক জুলফিকার চঞ্চল (বামে) 


এরমধ্যে আরও কথা আছে; তা হলো—অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের অবস্থা ও অবস্থান। তারাও এই ত্যাগ ও ভালোবাসার সমান অংশীদার। অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন। প্রধান গায়েন থেকে দোহার, রাম-রাবণ-লক্ষ্মণ থেকে ছোট বেহালাবাদক শিশু অভিনেতা সবাই যে যার স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত দক্ষ শিল্পী। রাবণের চরিত্রে চণ্ডীচরণ বর্মণ সীতাহরণ করেন। তিনি একজন আন্তরিক শিল্পী। জীবনের বহু মূল্যবান সময় তিনি যাত্রা, পালা কিংবা তবলাবাদক হয়ে ব্যয় করেছেন। সংসার-উদাসীন মানুষটির রয়েছে শিল্পের প্রতি অসীম আত্মত্যাগ। আব্দুল হামিদ নামক আরেকজন মানুষের মধ্যে সংস্কৃতিবোধ অত্যন্ত প্রখর। অভিনয়-প্রক্রিয়ার মধ্যেই দর্শকসারি থেকে তার কথা ভেসে আসে। এই মানুষদের জীবনের সিংহভাগ সময় শিল্পরস উৎপাদনকর্মে নিয়োজিত। স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তাঁরা আজীবনই নাটক বা শিল্পজগতের স্বেচ্ছাসেবী।


(ডান দিক থেকে) রিজু আহমেদ, তাঁর পুত্র, লেখক, নাট্য-নির্দেশক, রিজু আহমেদের স্ত্রী।


পালার প্রধান গায়েন ও শিল্পী যিনি, তাঁর পরিশ্রম ও গুণের কথা বর্ণনাতীত। তাঁর বাড়ির সন্নিকটে পালা উপস্থাপনা হয়। রিজু আহমেদ একজন সত্যিকার শিল্পী। পেশায় ভ্যানচালক এই মানুষটার মধ্যে রয়েছে একটা বিরাট আলোকিত বিশ্ব। বহু মানুষ গ্রামে-শহরে জ্ঞানীগুণী হয়। কিন্তু এই মানুষটার ভেতরে অনন্য এক মানুষ বাস করে। গানের দরাজ গলা, বাদ্যবাজনা, অভিনয়, আত্ম-আবিষ্কার সবকিছু বিবেচনায় তিনি একজন কুশলী কারিগর। আমার সৌভাগ্য আমি স্বল্পতম সময়ের মধ্যেও এই মানুষটার অন্তর্লোকে প্রবেশে কিছুটা সক্ষম হয়েছি। তাঁর ভেতরে লুকিয়ে থাকা মহিমাময় সত্তাকে অনুভব করতে পারঙ্গম হয়েছি। এটাকে বলবো সত্যিকারের সংযোগ তথা শৈল্পিক এটাচ্মেন্ট। শিল্প-অনুভবের জন্য এটা খুব জরুরি বলে মনে হয়েছে। একজন পালা-শিল্পীর জীবনের অন্তর্বেদনা, অক্ষমতা, দারিদ্র্য, সর্বোপরি সেসব ছাড়িয়ে অন্তর্জ্ঞানের ছোঁয়া ও আলোকের প্রাণোচ্ছ্বটা-অনুভব যেন এক অমিত অভিজ্ঞতার জগৎ। এই জগৎ কোনও কিছুর বিনিময়ে ক্রয় করা যায় না; শুধু হৃদয় দিয়েই তা অনুভব করা যায়। 


প্রধান গায়েন ও অভিনেতা রিজু আহমেদ ও তার পরিবারের সঙ্গে লেখক


১৩ জুলাই ২০২২-এর দিবাগত রাত ছিল গুরুপূর্ণিমা। পৃথিবীর সকল গুরুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের আরম্ভ। মধ্য জুলাইয়ের প্রচণ্ড গরমে দরদর করা ঘাম উপেক্ষা করেই পালাটি সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে না নামতে শুরু হয়। আর শেষ হয় রাতের বেলা প্রায় মধ্যবর্তী সময়ে। তবে দিনের আলোতেও এই পালা অনুষ্ঠিত হতে পারে। কারো বাড়ির বড় উঠানে এই পালা অনুষ্ঠিত হওয়ার স্থান। অন্যদিকে গ্রামের বাড়িগুলোর সামনে এমনিতেই এক চিলতে উঠোন থাকে। দিনের সব কাজ সাঙ্গ হলে মহিলা পুরুষ শিশু বৃদ্ধ সবাই এই পালার দর্শক হয়ে ওঠে। ‘খৈলান পালা’র বৈশিষ্ট্যই তা-ই। বাড়ির খোলা আঙিনায় প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনদিক খোলা সমতল বা সামান্য একটু উচু মঞ্চে তা পরিবেশিত হবে। 


পালা-নির্মাতা ও নাট্যনির্দেশক জুলফিকার চঞ্চলের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি—করোনার সময় আসলে এই ‘কনসেপ্ট’ তাঁর মাথায় এসেছে। সারা বাংলাদেশ কি বিশ্ব-পরিস্থিতি তখন মারাত্মক খারাপ। ঠিক সেই সময়ে শিল্পের প্রতি মহান দায়িত্ব বশেই তিনি তাঁর দলবল নিয়ে নতুন ধরনের চিন্তা শুরু করেন। তাতে গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আরও নিবিড়তর হয়ে ওঠে। কারণ এর আগে প্রসেনিয়াম মঞ্চের আদলে তিনি বহু নাটক পরিবেশন করেছেন। তাঁর বর্তমান অবস্থা হলো প্রসেনিয়াম না করার ব্রত পালন। আদতে জনমানুষের হয়ে সত্যিকারের পরিবর্তনের কাজটা তারা করতে চান। 


করোনাকালে ‘সারথি থিয়েটারে’র পালা সংঘটনের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। মানুষের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করে তারা নাটক শুরু করেন। স্বাস্থ্য-সচেতনতার মতো একটা সামাজিক দায়ভারকেও মিটিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে শিল্পের মৌল গুরুভার দায়িত্ব তো রয়েছেই। আসল কাজ মানুষের কাছে, বাড়ির দোরগোড়ায় শিল্পকে পৌঁছে দেওয়া। বিশেষত গ্রামের মহিলা-শিশুসহ অনেকের পক্ষে বাড়ি ছেড়ে মফস্বলে-গঞ্জে-শহরে গিয়ে আধুনিক থিয়েটার দেখা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। কিন্তু এই ‘খৈলান পালা’ যেহেতু বাড়ির ‘খুলি’তে বা খোলা আঙিনায় অনুষ্ঠিত হয়, সেহেতু শিল্পের গভীরতর স্বাদ তারা সহজেই উপভোগ করতে পারেন। আমরা নারীজাগরণের কথা শুনতে-বলতে পছন্দ করি। আমার কাছে মনে হয়েছে—এই ধরনের পরিবেশনারীতির মধ্য দিয়ে প্রায়োগিক অর্থে সেই জাগরণের দায়িত্বটি পালিত হচ্ছে অনেকখানি। 


 

অভিনয়, নেপথ্যে গান ও বাদ্য 


সংলাপ, গান, নৃত্য সর্বোপরি কাহিনি থাকার কারণে সব মিলে দর্শক-শ্রোতার কাছে ‘খৈলান পালা’ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মানুষের মধ্যে সরাসরি সংযোগ ঘটছে। সংলাপ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অভিনেতা-দর্শকে তা স্থাপিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষায় সংলাপ উপস্থাপন ও অভিনেতা-দর্শকদের আন্তঃসংযোগের ফলে পরিবেশনা হয়ে ওঠে একান্তই প্রাণময়। অনেক সময় সরাসরি দর্শকসারির কাউকে মঞ্চে ডেকে নেয়া হয়, কিংবা দর্শকের মধ্য থেকেই অভিনেতা কথা বলে ওঠেন কিংবা তারা স্বয়ং দর্শকের সঙ্গেই কথা বলেন। এভাবে চমৎকার একটি প্রাণবন্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। দর্শকরা নাটক থেকে বাস্তবে আবার বাস্তব থেকে নাটকে ফিরে যাবার প্রয়াস লাভ করে। এ-ধরনের পরিবেশ তৈরি প্রসেনিয়াম মঞ্চে কিংবা শহরের মঞ্চে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়তো সম্ভব হয় না। আনন্দঘন পরিবেশের ভেতর দিয়ে দোয়ারকি চরিত্রটা নাট্যমঞ্চকে গতিশীল করে। যেমন প্রসেনজিৎ রায় ভুতু নামক ছেলেটি দর্শকের মধ্যে সবসময় আনন্দ ও হাস্য-পরিহাসময় অবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে যারা ঠিক অভিনেতা নন কিন্তু বাদ্য-বাজিয়ে, তারাও পালার নেপথ্য অনুঘটক। শ্রী দীগেন্দ্রনাথ সরকারের মতো অনেকেই তাদের সাংসারিক শত কাজ ফেলে শিল্পের কাজে স্বনিয়োজিত। তাদের আনন্দ ও ত্যাগ জীবনের সমরেখায় অঙ্কিত।

    

(বাম থেকে) দোহার, প্রধান গায়েন ও অন্যান্য শিল্পী

 

সঙ্গীত মানুষের আত্মার কথা বলে। গানের মধ্য দিয়ে পালা পরিবেশনের ফলে মানুষের তথা দর্শকের প্রাণচঞ্চলতা আরো বৃদ্ধি পায়। আর খৈলান-পালায় পরিবেশিত গানগুলো সাধারণত এলাকার ঐতিহ্য-ভিত্তিতে গঠন করা। ভাওয়াইয়া গানের অপরূপ ভঙ্গিটা এখানে অনায়াসে শিল্পরসের আকর হয়ে ওঠে। ‘কানিছাত্ গাড়িনু আকাশি আকালি/আকালি ঝুমঝুম করে রে বন্ধুয়া/বাতাসে হেলিয়া পড়ে।’ এভাবে গ্রামীণ জীবনের উপকরণগুলো গানের ভেতর দিয়ে নাট্য-অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।  

বাড়ির আঙিনায় ‘খৈলান পালা’র দর্শক


অভিনয় শিল্পী শবনম নূপুর, বীথি সরকার, কেয়া রায় প্রমুখের সঙ্গে আলাপে অনেক কিছু জানতে পারি। আমার আগ্রহ ছিল গ্রামের নারীদের মধ্যে জাগরণটা কীভাবে ঘটছে তা জানা। কাজকর্ম ও পারিবারিক নানা দায়ে পিষ্ট গ্রামীণ নারীসমাজের মধ্যে এ-পালার বিশেষ ভূমিকা টের পাওয়া যায়। অবশ্য তারা আগে থেকে কেউ কেউ বেহুলা, রূপবান, কোজাগরি গানের সঙ্গে পরিচিত। তবুও আধুনিক সময়ে প্রভূত উপকরণ ও মিডিয়ার দোর্দণ্ড প্রতাপে অনেক কিছু প্রায় বিস্মৃতির অতলে। যদিও সেটা অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্ম যারা স্মার্টফোনে আসক্ত তাদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটছে। অন্য অর্থে, গ্রামীণ নারীরা আগের অবস্থানেই রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা যেন আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে। যেমন একসময় সিনেমা হলের রূপালী পর্দার জগৎ তাদেরকে আবিষ্ট করতো। কিন্তু পারিবারিকভাবে অদর্শনযোগ্যতা, অশ্লীলতা, বাণিজ্যিকীকরণের প্রতাপ প্রভৃতি সিনেমা-শিল্পের ধস নামিয়েছে, তাদেরকে হল বিমুখ করেছে। একসময় আমরাও দেখেছি, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘রূপবান’ প্রভৃতি সিনেমার জন্য তাদের অসীম কৌতূহল, ঔৎসুক্য ছিল। অন্যদিকে থিয়েটার বা নাট্যমঞ্চগুলো শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামীণ নারীদের উপস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। ‘খৈলান পালা’ সেই শূন্যস্থানে পূর্ণতার আভাস। এ-পালা পুরনো ঐতিহ্যবাহী কালকে, একইসঙ্গে পরিচিত জগতের কথা তুলে ধরে। আর এর ফলে একটা মনস্তাত্ত্বিক ঐক্যবোধেরও ব্যাপার ঘটে। ‘খৈলান পালা’ দর্শনে গ্রামীণ মানুষের মধ্যে একটা নতুন চেতনার জোয়ার তৈরি হচ্ছে। 


বাড়ির আঙিনায় ‘খৈলান পালা’র দর্শক


বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সকল উপাদানই সঙ্গীত-নির্ভর। চর্যাপদ থেকে শুরু করে মঙ্গলকাব্য সবই মিশ্র পরিবেশনরীতির শিল্প। আর এসবই হচ্ছে গান। আধুনিকতা এই অকৃত্রিম জীবন থেকে সরিয়ে আমাদেরকে মোড়কাবৃত্ত করেছে। ফলে এদেশের শেকড় খুঁজতে হলে ঐতিহ্যবাহী গানের দিকেই দৃষ্টি ফেরাতে হবে। ‘খৈলান পালা’র উদ্ভবও এক ধরনের গান থেকে। গোটা উত্তরবঙ্গ তথা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, শুধু তা-ই নয়, ভারতের কুচবিহার ও আসাম অঞ্চল কিংবা রাজবংশীদের সংস্কৃতিতেও এই ধরনের গানের প্রভাব রয়েছে। ‘খৈলান পালা’ হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। বরং এর একটি ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস রয়েছে। 


কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট অঞ্চলে রামায়ণের কাহিনি-নির্ভর ‘কুশান’ নামক একপ্রকার গানের প্রচলন ছিল বহু বছর আগে থেকে। কৃষকদের জীবন থেকে এই কুশান সংস্কৃতির উৎপত্তি। রাজা দশরথের পুত্র রাম-লক্ষ্ণণ ও রামের স্ত্রী সীতাকে রাবণকর্তৃক হরণ, এছাড়া রামপুত্রদ্বয় লব-কুশের কাহিনি-নির্ভরতায় গড়ে উঠেছে এই ‘কুশান গান’। ‘খৈলান পালা’য় এর খানিকটা পরিবর্তিত রূপ রয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণ নয় কিংবা অনুবাদের হাত ধরে সৃষ্টি কৃত্তিবাসী রামায়ণ নয় বরং অদ্ভূতাচার্যের রামায়ণ এই ‘খৈলান পালা’র অবলম্বন। বাড়ির উঠানই কৃষকদের মন্দির। সেখানেই তাদের ফসল তোলা, ফসল মাড়াই, গোখাদ্য সঞ্চয় ইত্যাদি। জীবনের অবসরগুলো গল্পগাথায় ভরে ওঠে এখানেই। উঠানকে নাট্যমঞ্চ করলে তাদের জীবনের ভেতরে প্রবেশ করা যায়। হয়তো এরকম দর্শন থেকেই কোনো এককালে কুশান গানের প্রচলন ঘটেছিল। তবে কালে কালে এই কুশানের রূপও পরিবর্তিত হয়েছে। একটা রূপের কথা বেশ প্রচলিত। তা হচ্ছে ‘ব্যানা কুশান’। হাতে বানানো সারিন্দা (বীণা) সহযোগে এই গান গাওয়া হয়। এই ‘কুশান গান’ থেকেই রামায়ণের কাহিনিরূপ এসেছে ‘খৈলান পালা’য়। পরিবেশিত পালায় ক্ষুদে অভিনয় শিল্পী সংগীত কুমার লিখনের হাতে একটা কাঠের বেহালা দেখা যায়। দলের ওপর আক্রমণ চালিত হলে সেই বেহালাটা ব্যাঙবাবুর ছেলেরা দখল করে। দেখা যায়—বাড়িতে তারা সেই বেহালা দিয়ে ক্রিকেট ব্যাটের মতো খেলছে। এভাবে কায়েমি স্বার্থবাদীদের বীজ একদিন চারাগাছ থেকে মহাবিষবৃক্ষ হয়ে ওঠে। লিখন নামক অভিনেতা বালক ছেলেটির কান্না আর আর্তস্বরের চিৎকার সমাজের কুপমণ্ডুকদের সাজানো পৃথিবী ভূমিকম্পের মতো কাঁপিয়ে দেয়।

বেহালাবাদক ক্ষুদে অভিনেতা সংগীত কুমার লিখন


‘খৈলান পালা’ নাট্য-নির্মাতার নিজস্ব চিন্তার আদলে তৈরি। খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, এতে বর্তমান জীবনস্পর্শ তথা সাম্প্রতিকতার মধ্য দিয়ে সামাজিক জীবনের গভীর ব্যাপ্তি ঘটেছে। সমাজে সবসময়ই উপস্থিত থাকে একটা সাম্প্রদায়িক, ধুরন্ধর ও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। এরাই সমাজের গোপন ও প্রকাশ্য পরিচালক, কুচক্রী ও ষড়যন্ত্রকারী। এ-পালায় যারা শিল্পী-কলাকুশলী, তারা বিভিন্ন সামাজিক প্লাটফর্ম থেকে এসেছে। স্কুল পড়ুয়া ছাত্র থেকে শুরু করে নানা পেশাজীবী মানুষের পদচারণায় মুখর ‘সারথি’ নাট্যদল। তাদের ত্যাগ ও আত্মঅভিজ্ঞার ভেতর দিয়ে অভিনেতার বাইরেও তারা আত্মসচেতন মানুষ। সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা বিভাজিত সমাজের এবং গ্রাম্য-রাজনীতি নামক বিষবৃক্ষের মূল উৎপাটন করতে তারা যেন বদ্ধ পরিকর। কিন্তু নীতিবান হয়েও অর্থনীতির চাবিটি যেন তাদের হাতে ধরা নেই। ফলে তারা ভাঙনের শিকার হয়। এই ভাঙনের মূলে স্বার্থবাদী ও কামুক ব্যাঙবাবু নামক বিষবৃক্ষের প্রতিনিধিরাই ক্রিয়াশীল। চন্দ্রকলা নামক নারী অভিনেত্রীর প্রতি তার কামনা-চোখের অগ্নিশিখা জ্বলজ্বল করে। লোভ, কামুকতা আর লাভের জালে ফাঁদ পেতে তারা মানুষের চরিত্র নষ্ট করতে চায়। পালা কর্তা তথা প্রধান অভিনেতার হাহাকারের বাণী আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে। কিন্তু সে কখনো কায়েমি স্বার্থান্ধ শক্তির কাছে মাথা নত করে না। এখানেই তার চরিত্রের ঔজ্জ্বল্য ও বিশেষত্ব। বস্তুত রামায়ণে লুকায়িত মানুষের অমর অনুভব তথা জীবনধর্মিতা এখানে স্পষ্ট। তারা যুথবদ্ধ জীবনের অংশীদার বলে হেরেও গিয়েও হারে না, বরং জীবনজয়ী হয়ে ওঠে। স্বার্থবাদী মানুষরাই পরাজিত হয়। 


আসলে ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারতে’র মতো এপিকগুলো এ-অঞ্চলের মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। উঠতে-বসতে জীবনের সুখ-দুঃখের গল্পগুলো এইসব রচনার মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তরে প্রবেশ করেছে। জীবনের নীতিবোধের সঙ্গে প্রবল বিদ্রোহ-বিপ্লবে ভরা সংক্ষুব্ধ রক্তাক্ত জীবনটাও মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে-সব কারণে বহুযুগচর্চিত নীতি ও কাহিনি-বয়নের পেছনে যে একটা একটা শৈল্পিক নির্ভরতা, আজও তা কমে যায়নি। ‘খৈলান পালা’-ই এর স্পষ্ট প্রমাণ। এই পালার সঙ্গে আধুনিক জীবনের বোধ সঞ্চারিত হয়েছে। আসলে কোনও শিল্পই সাম্প্রতিকতা ছাড়া টিকতে পারে না। বহুবছরের প্রচলিত কাহিনি-ঐতিহ্যগুলো এভাবেই বারবার নতুন হয়ে ধরা দেয়। আর এ-ধরনের পালার মধ্যে দায়িত্ববোধের প্রসঙ্গটিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের গ্রাম থিয়েটারগুলো এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। নাট্যজন জুলফিকার চঞ্চলের মতো কর্ণধাররা নিজেদের জীবনের সহজপ্রাপ্য সুখের প্রাপ্তিসমূহ বিসর্জন দিয়ে কঠোর-কঠিন সাধনায় মানুষের থিয়েটার বা শিল্প-নির্মাণে সদা জাগ্রত হয়ে থাকছেন। তারা শুধু নাট্য-নির্দেশক নন, সমাজেরও শিক্ষক। তাদের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাটা অন্তর থেকেই আসে। আরোপিত কোনও কিছু দিয়েই এই শিল্পের কুশীলব ও নির্মাতাদেরকে ধরাছোঁয়া যায় না। একান্ত হৃদয়ের গভীর থেকেই তা উঠে আসে, অন্তরেই সমর্পিত হয়ে থাকে। 



খোরশেদ আলম, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।




গুরু পূর্ণিমার রাতে ‘খৈলান পালা’র উদ্বোধন


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন