ছোটোদের নজরুল

 

স্বপ্রতিভ ও স্বভাব কবি নজরুল। তিনি বড়োদের দ্রোহের অগ্নিজ্বালা কবি। আর ছোটোদের জন্য উচ্ছ্বল আনন্দের সম্ভার। শিশুর সম্ভাবনাকে তিনি বিস্ময়ভরা চোখে আবিষ্কার করেছেন।  সেই বিস্ময়কে গেঁথে দিয়েছেন তাদের গোপন গভীর জগতে। তিনি জানতেন‘তুমি নও শিশু দুর্বল, তুমি মহৎ মহীয়ান জাগো দুর্বার, বিপুল বিরাট অমৃতের সন্তান।’ বাংলা-সাহিত্যের শিশুতোষ শাখাটিকে তিনি পূর্ণ করেছেন শিশুদের বিচিত্র রচনায়। শিশুদের জন্য রচিত তাঁর ছড়া, কবিতা, গল্প, গান ও নাটক আজও সমান জনপ্রিয় এবং চিরায়ত শিশুসাহিত্য হিসেবে সমাদৃত। ঝিঙে ফুল’, ‘পুতুলের বিয়ে’, ‘পিলে পটকা ও পুতুলের বিয়ে’, ‘ঘুম জাগানো পাখি’ এমনি আরও কতো রচনা।

 

আহমাদ মাযহার বলেন,

“তাঁর শিশুসাহিত্য শিশু ও শিশুতা সম্পর্কিত দার্শনিকতার বিবরণ নয়, শিশুর মনোজগৎ ও বাস্তব-পরিবেশের সরল-সুন্দর উপস্থাপন। তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যকে প্রথাগত প্রবণতা থেকে মুক্তি দিয়ে বাস্তবমুখী চেতনার সঙ্গে যুক্ত করেছেন।”

 

শিশুরা যেন বহুমুখি, একইসঙ্গে অন্তর্মুখি। ‘খেলিছ বিশ্ব লয়ে’ এই শিশুর কৌতূহল জগৎ জোড়া। নীল আকাশ, সাদা মেঘ, সবুজ গাছপালা, ছোট্ট ফুলের সৌন্দর্যও শিশুকে বিমোহিত করে। ঘরের বিড়াল, কুকুরও তার দৃষ্টি এড়ায় না। এমনকি পাখি বা প্রজাপতি কেউই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয় না। শিশুর স্বাভাবিক ভালোবাসার এ প্রবণতাকে গভীরতা দেয় শিশুসাহিত্য। তাদের কল্পনাশক্তিকে করে তেজদীপ্ত, গতিময়। আর সৌন্দর্যকে দেয় নতুন অভিধা।

 

১৩৪৪ সালে মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন সম্পাদিত 'শিশু সওগাতে'র প্রথম সংখ্যায় 'শিশু সওগাত' কবিতায় ছিল এমনি ইঙ্গিত। বাধ ভেঙে ছুটে যাওয়া দস্যুর দল শিশুরা তো জগৎজয়ী। ডালে ডালে ঘুমজাগা পাখির কলতান তাদের মুখে মুখে।

ওরে শিশু, ঘরে তোর এল সওগাত/আলো পানে তুলে ধর ননী-মাখা হাত।/নিয়ে আয় কচি মুখে আধো আধো বোল,/তুলতুলে গালে ভরা টুলটুলে টোল।/চকচকে চোখে আন আলো ঝিকমিক/খুলে দে রে তুলে দে রে আঁধারের চিক।/বাঁধ ভেঙে ছুটে আয় দস্যুর দল,/মরা গাঙে নিয়ে আয় জোয়ারের জল।/ধরাতল টলমল পদভারে তোর,/লুঠ কর গুলবাগ নওল কিশোর।/তোরে চেয়ে নিতি রবি ওঠে পুরবে/তোর ঘুম ভাঙিলে যে প্রভাত হবে।/ডালে ডালে ঘুম-জাগা পাখীরা নীরব,/তোর গান শুনে তবে ওরা গাবে সব।

 

১৯০৮ সালে মাত্র আট বছর বয়সে নজরুল পিতৃহারা হলেন। ছিনিয়ে নিলো তার চির প্রদীপ্ত শৈশব। পিতার মৃত্যুতে তাঁর শিক্ষা লাভে ব্যাঘাত ঘটলো। জীবিকার তাগিদে বারবার বাধাগ্রস্ত হলো তাঁর শিক্ষাজীবন। শৈশবে হৃদয় দগ্ধ করা তীব্র আর্থিক অনটন। কখনও মাজারের খাদেম, মসজিদের ইমাম, কখনও রুটির দোকানে কাজ। কিন্তু শত দুঃখের মধ্যেও তিনি দুঃখ-কষ্টকে জয় করার স্বপ্ন দেখতেন। বর্ধমানের চুরুলিয়া, রাণীগঞ্জের শিয়ারসোল, ময়মনসিংহের দরিরামপুরযেখানেই কাটুক, কৈশোর ছিল দুরন্তপনায় ভরা। এ জন্য কোথাও টানা বেশিদিন থাকা হয়নি তাঁর। ময়মনসিংহের দারোগা সাহেব শিশু নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী নজরুলের দুরন্তপনা সহ্য করতে পারেননি। ফলে একসময় নজরুল সেখান থেকেও চলে যান। আসলে একটা মুক্ত আকাশের উদার হাতছানি ছিলো তাঁর মধ্যে। তিনি যেন রবীন্দ্রনাথের সেই তারাপদ, যাকে কোনও বন্ধনে কেউ আটকাতে পারে না। বন্ধন যেন তাঁর গলার ফাঁস। বন্ধন মুক্তির বাসনাই যেন তাঁর জীবনের সাধনা।

 

ছেলেবেলায় দারুণ দুষ্টু আর ডানপিটে নজরুলের কাজ ভরদুপুরে খোলা মাঠে ছুটোছুটি, রোদ্দুরে ডাংগুলি খেলা, পাখির বাসায় ঢিল ছোড়া, গাছ বেয়ে পাখির ছানা চুরি, এর গাছের আম, ওর গাছের লিচু সাবাড় করা। কখনও মনের আনন্দে সারাদিন মাঠেঘাটে বাঁশি বাজিয়ে ফেরা। বড়ো নজরুল ছেলেবেলার দুরন্তপনাকে ভোলেননি। তাই তো লিখে ফেলেছেন অসাধারণ কবিতা ‘লিচু চোর’।



 বাবুদের তাল-পুকুরে

হাবুদের ডাল-কুকুরে

সে কি বাস করলে তাড়া,

বলি থাম একটু দাড়া।

 

পুকুরের ঐ কাছে না

লিচুর এক গাছ আছে না

হোথা না আস্তে গিয়ে

য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে

গাছে গো যেই চড়েছি

ছোট এক ডাল ধরেছি,

 

ও বাবা মড়াত করে

পড়েছি সরাত জোরে।

পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,

সে ছিল গাছের আড়েই।

ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,

ধুমাধুম গোটা দুচ্চার

দিলে খুব কিল ও ঘুষি

একদম জোরসে ঠুসি।

 

আমিও বাগিয়ে থাপড়

দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়

লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,

দেখি এক ভিটরে শেয়াল!

 

সেকি ভাই যায় রে ভুলা-

মালীর ঐ পিটুনিগুলা!

কি বলিস ফের হপ্তা!

তৌবা-নাক খপ্তা!

 

এ কবিতায় শিশুর দুরন্তপনা অনন্যতায় চিত্রিত। কবিতার ছন্দও ব্যতিক্রমী। বিষয়বস্তুতে ও ছন্দমাধুর্যে ছড়াটি ছোটোদের খুব প্রিয়। এখনও আবৃত্তি করতে গিয়ে শিশুরা ছড়াটি সানন্দে বেছে নেয়। প্রতিযোগিতা কি আবৃত্তির আসরে ‘লিচু চোর’ খুবই জনপ্রিয়। সুহৃদ আকবর আলী সাহেবের অনুরোধে নজরুল লিখেছিলেন ওই ছড়া। নিপুণ ছন্দোবিন্যাসে দ্রুত ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিবরণ দ্রুততর করে তুলেছে ছড়াটি। বিস্ময়কর ব্যাপার যে, সর্বত্র তিনি পর্ব-গঠনে মাত্রার তারতম্য ঘটিয়েও প্রতি পর্বে স্বরায়নের দৈর্ঘ্য সমান রাখতে সমর্থ হয়েছেন। ছড়ায় এই নিরীক্ষার নৈপুণ্য বিরল, অনন্যসাধারণ।

 

নজরুল সহজেই শিশুদের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে তুলতেন। এভাবে তাঁর হারানো শৈশবকে খুঁজে ফিরতেন। ছোটোদের নিয়ে হৈচৈ করতেন, গান গাইতেন, শুনতেন ও শোনাতেন। শিশুতোষ ছড়া, কবিতা আবৃত্তি করতেন। আবার কাউকে কাউকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি শিশুদের মধ্যে মিশে নিজেকে প্রবলভাবে আবিষ্কার করতেন। নজরুল যেমন বিদ্রোহী কবির অভিধা পেয়েছেন, শেকল ভাঙার গান গেয়েছেন, তেমনি তাঁর লেখায় উঠে এসেছে শিশু মনের বিচিত্র ভাবনা। তিনি যেন তাঁর ছন্দের অপূর্ব খেলার যাদুতে তাদের মন ভরে তুলতেন। অন্যদিকে নজরুলের সৃষ্টি অদ্ভূতভাবে শিশুদের অসাম্প্রদায়িক হতে শেখায়। তাঁর রচনা সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি জাগায়। সমাজের শৃঙ্খলা আনতে নজরুলের শিশুতোষ লেখা অবশ্যপাঠ্য, অবিসংবাদিত।

 

১৯২১ সালে নজরুল কুমিল্লায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। অতিথি হয়েছিলেন ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। অঞ্জলি নামের ইন্দ্রবাবুর একটি মেয়ে ছিলো। এই ছোট্ট মেয়েটিও যেন কীভাবে নজরুলের বন্ধু হয়ে গেলো। একদিন দেখলেন, মেয়েটি একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আর  ওপরের দিকে তাকিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। তিনি কৌতূহলে কাছে যান। গিয়ে দেখেন, মেয়েটি একটি কাঠবিড়ালীর সঙ্গে কথা বলছে। তিনি অবুঝ মেয়েটির কাণ্ড দেখে বিস্মিত হলেন। লিখলেন, ‘খুকি ও কাঠবিড়ালী’। 


 

কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?

গুড়-মুড়ি খাও ? দুধভাত খাও ? বাতাবি নেবু ? লাউ ?

বেড়াল-বাচ্চা ? কুকুর-ছানা ? তাও?

ডাইনি তুমি হোঁতকা পেটুক,

খাও একা পাও যেথায় যেটুক!

বাতাবি নেবু সকলগুলো

একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো

তবে যে ভারী লেজ উঁঠিয়ে পুটুস্ পাটুস্ চাও?

ছোঁচা তুমি ! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার ! যাও !

 

এছাড়াও নজরুল রচিত ‘পিলেপটকা’, ‘খাঁদু দাদু’, ‘লিচু চোর’, ‘মট্কু মাইতি’ প্রভৃতি শিশুতোষ ছড়া অত্যন্ত মজার।

 

অন্তরের ভালোবাসা দিয়ে শিশুদের সাহিত্যকে তিনি করে তুলেছিলেন আবেগময় ও হৃদয়স্পর্শী। ছোটদের জন্য রচিত তাঁর প্রতিটি কবিতায় ফুটে উঠেছে শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম আবেগ। শিশুদের মধ্যে নজরুল দেখতে পেতেন অপার সম্ভাবনা। ছোটোদেরকে দেখলে তিনি ছুটে যেতেন, অবিচ্ছেদ্য মমতার সম্পর্কে বেঁধে ফেলতেন। নজরুল যেন তাঁর ছন্দের যাদু দিয়ে তাদের মনের কল্পনাকে জাগিয়ে তুলতেন। তাদের সম্ভাবনা উস্কে দিতেন। ছোটোদেরকে তিনি আগামীর স্বপ্ন দেখাতেন। কখনও তাদেরকে বদ্ধ ঘরে বন্দি করে রাখতে চাননি। তিনি নিজেও শিশুর খোলা পৃথিবীতে সব সময় ঘুরে বেড়াতে চেয়েছেন। চঞ্চল মন পাখি তার ঘরের বাইরে যাবার ইচ্ছায় চির ব্যাকুল।

থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে

দেখব এবার জগৎটাকে

কেমন করে ঘুরছে মানুষ

ঘুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।

 

নজরুল রচিত ‘ভোর হলো’ ঘুম থেকে জাগার ছড়া। এটি প্রতীকী অর্থে শিশুদের চৈতন্য জাগানিয়া ছড়া।



ভোর হলো দোর খোল

খুকুমনি ওঠো রে,

ঐ ডাকে যুঁই-শাখে

ফুল-খুকি ছোট রে।

খুলি হাল তুলি পাল

ঐ তরি চলল,

এইবার এইবার

খুকু চোখ খুলল।

আলসে নয় সে

ওঠে রোজ সকালে,

রোজ তাই চাঁদা ভাই

টিপ দেয় কপালে।

 

এ দেশের তরুণরা জেগে উঠলে ব্রিটিশদের তাড়ানো যে সহজ হবে, পুবের আকাশে স্বাধীনতার সূর্য উঠবে। কল্পনাবৃত্তির মধ্য দিয়ে শিশুসুন্দর জগতকে জাগিয়ে দিয়েছেন নজরুল। ছড়ায় প্রত্যক্ষভাবে বিদ্রোহের কথা নেই। কিন্তু নিয়মানুবর্তী শিশুই পারবে ভবিষ্যতের পৃথিবী গড়তে। ভোরের সৌন্দর্য উপভোগ তার চৈতন্যকে শানিত করবে। পরিবেশ চেতনায় ভরপুর নজরুলের ‘ঝিঙেফুল'। প্রকৃতি মানুষের কতটা আপন তা শিশুমনের অনুভব দিয়ে ধরেছেন তিনি। প্রকৃতির প্রতি মমতা সৃষ্টিতে ‘ঝিঙেফুল' ছড়াটি অনবদ্য ভূমিকা রাখতে পারে। সমকালের বিবেচনায় ‘ঝিঙে ফুল' শিশুসাহিত্যের এক বিস্ময়কর নাম। শিশু মনস্তত্ত্বকে সত্যিই তিনি ধরতে পেরেছিলেন গভীরতার সঙ্গে।

 

“ঝিঙে ফুল।/সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল/ঝিঙে ফুল।”এর মধ্যে যেন কী চমৎকার দৃশ্যকল্প, অপূর্ব রঙিন কল্পনা। মৃদু বাতাসে দুলতে থাকা সবুজ পাতার চাদরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফিরোজিয়া ফুল যেন চৈতন্যে ভেসে বেড়ায়। শুধু চোখের তৃপ্তি নয়, কানও তৃপ্ত হয় এর মধুর সুরে।

ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!

সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া   

ফিঙে-কুল

ঝিঙে ফুল।

গুল্মে পর্ণ

লতিকার কর্ণে

ঢল ঢল স্বর্ণে

ঝলমল দোলে দুল

ঝিঙে ফুল।

 

কাজী নজরুলের সেই ঝিঙ্গে ফুল দেখলেই মন আন্দোলিত হয়। চকিতে শৈশবে ফিরে যায় মন।

 

নজরুল রচনা করেছেন শিশুকিশোরদের নাটক। ‘পুতুলের বিয়ে’ চমৎকার একটি নাটক। যদিও এক মলাটে দু তিনটি ছড়া, কবিতা, ছড়া-নাটকও স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘পুতুলের বিয়ে’ (নাটক), ‘কাল জামরে ভাই’ (ছড়া), ‘জুজু বুড়ির ভয়’ (নাটক), ‘কে কি হবি বল’ (ছড়া নাটক), ‘ছিনিমিনি খেলা’ (নাটক) ‘কানামাছি’ (নাটক) ‘নবাব নামতা পাঠ’ (নাটক), ‘সাতভাই চম্পা’ (কাব্য নাটক), ‘শিশু যাদুঘর’ (ছড়া)। উল্লেখ্য, প্রত্যেকটা নাটকই শিশুকিশোর মনের দারুণ উপযোগী। প্রত্যেকটা নাটকেই রয়েছে চমৎকার সব গানের ব্যবহার। তবে, ছোটোদের জন্য নাট্য-আঙ্গিকে রচিত সৃষ্টির মধ্যে 'পুতুলের বিয়ে' সেরা। শৈশবে পুতুল ও পুতুলের বিয়ে একটি দারুণ অভিজ্ঞতা। প্রত্যেক শিশুরই থাকে এই পুতুলের জগৎ। পরবর্তী জীবনে সুমধুর স্মৃতি হয়ে বিরাজ করে এই পুতুল।

 

'পুতুলের বিয়ে' একাঙ্কিকা নাটক। কয়েকটি শিশু-চরিত্রের (কমলি, টুলি, পঞ্চি, খেঁদি, বেগম প্রমুখ) মধ্য দিয়ে গভীর জীবনবোধকে নজরুল শিশু-মনে সঞ্চার করতে চেয়েছেন। এতে আমাদের লোক-সংস্কৃতির পরিচয় যেমন মূর্ত হয়ে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বও রক্ষার প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছে। চিনে-পুতুল, জাপানি-পুতুল বা ডালিমকুমারের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি-সমন্বয়ের প্রয়াস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ নাটকে রয়েছে বেশ হাস্যরসের উপস্থাপনা, রয়েছে সিরিয়াস বিষয়ের অবতারণাও। যেমন সম্প্রীতির বন্ধন কামনায় কমলির একটি সংলাপ :

'বাবা বলেছেন, হিন্দু-মুসলিম সব সমান। অন্য ধর্মের কাউকে ঘৃণা করলে ভগবান অসন্তুষ্ট হন। ওদের আল্লাও যা আমাদের ভগবানও তা।'

 

কাজী নজরুল ইসলামের লেখায় দেশপ্রেমের সুগভীর ছাপ প্রকাশিত। ব্যক্তিজীবনের মতো সৃষ্টি জগতেও তাঁর দেশপ্রেমের শিখা প্রজ্বলমান। কবিতায়, গানে, কর্মজীবনে অনির্বচনীয় সৌন্দর্য ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী নজরুল। এ প্রসঙ্গে আরও স্মরণ করা যায়‘মাঙ্গলিক’, ‘মুকুলের উদ্বোধন’, ‘গরিবের ব্যথা’ প্রভৃতি কবিতার কথা। ‘নির্ঝর’ কবিতা-সংকলনের ‘গরিবের ব্যথা’ কবিতায় তিনি দরিদ্র শিশুর একান্ত সমব্যথী হয়েছেন।

এই যে মায়ের অনাদরে ক্লিষ্ট শিশুগুলি,

পরনে নেই ছেঁড়া কানি, সারা গায়ে ধূলি,

সারাদিনের অনাহারে শুষ্ক বদনখানি,

খিদের জ্বালায় ক্ষুণ্ণ, তাতে জ্বরের ধুকধুকানি,

অযতনে বাছাদের হায়, গা গিয়েছে ফেটে,

খুদ-ঘাঁটা তাও জোটে নাকো সারাটি দিন খেটে,

এদের ফেলে ওগো ধনী, ওগো দেশের রাজা,

কেমন করে রোচে মুখে মণ্ডা-মিঠাই-খাজা?

ক্ষুধায় কাতর যখন এরা দেখে তোমায় খেতে,

সে কী নীরব যাচ্‌ঞা করুণ ফোটে নয়নেতে!

তা দেখে ছিঃ, অকাতরে কেমনে গেলো অন্ন?

দাঁড়িয়ে পাশে ভুখা শিশু ধূলিধূসর বর্ণ।

রাখছ যে চাল মরাই বেঁধে, চারটি তারই পেলে,

আ-লোনা মাড়-ভাত খেয়ে যে বাঁচে এসব ছেলে।

পোশাক তোমার তর-বেতরের, নেইকো এদের তেনা,

যে কাপড়ে মোছ জুতো, এদের তাও মেলে না।

প্যাঁটরা-ভরা কাপড় তোমার, এরা মরে শীতে,

সারাটি রাত মায়ে-পোয়ে শুয়ে ছাঁচ-গলিতে।

তোমরা ছেলের চুমো খেয়ে হাস কতই সুখে,

এদের মা-রা কাঁদেই শুধু ধরে এদের বুকে।

ছেলের শখের কাকাতুয়া, তারও সোনার দাঁড়,

এরা যে মা পায় না গো হায় একটি চুমুক মাড়।

তোমাদের সব খোকাখুকির খেলনার অন্ত নাই,

খেলনা তো মা ফেলনা এদের মায়ের মুখে ছাই

তেলও দেয়নি একটু মাথায়, চুল হল তাই কটা;

এই বয়সে কচি শিশুর বাঁধল মাথায় জটা!

টোটো করে রোদে ঘুরে বর্ণ হল কালি,

অকারণে মারে ধরে লোকে দেয় আর গালি।

একটুকুতেই তোমাদের সব ছেলে কেঁদে খুন;

বুক ফাটলেও কষ্টে তারা মুখটি করে চুন,

এই অভাগা ছেলেরা মা দাঁড়িয়ে রয় একটেরে;

কে বোঝে ওই চাউনি সজল কী ব্যথা চাপছে রে!

তোমাদের মা খোকার একটু গাটি গরম হলে,

দশ ডাক্তার দেখে এসে; এরা জ্বরে মলে

দেয় না মা কেউ একটি চুমুক জলও এদের মুখে,

হাড়-চামড়া হয়ে মরে মায়ের বুকে ধুঁকে!

আনার আঙুর খায় না গো মা রুগ্‌ন তোমার ছেলে;

এরা ভাবে, রাজ্যি পেলুম মিছরি একটু পেলে।

তোমাদের মা খোকাখুকি ঘুমায় দোলায় দুলে,

এদের ছেলের ঘুম পেলে মা ঘুমায় তেঁতুল-তলে

একলাটি গে’ মাটির বুকে বাহুয় থুয়ে মাথা;

পাষাণ-বুকও ফাটবে তোমার দেখ যদি মা তা!

দুঃখ এদের দেউ বোঝে না, ঘেন্না সবাই করে,

ভাবে, এসব বালাই কেন পথেই ঘুরে মরে?

ওগো, বড়ো মুদ্দই যে পোড়া পেটের দায়,

দুশমনেরও শাস্তি যেন হয় না হেন, হায়!

এত দুখেও খোদার নাকি মঙ্গলেচ্ছা আছে,

এইটুকু যা সান্ত্বনা মা, এ গরিবদের কাছে।

 

নজরুলের জীবনের বড়ো বেদনা মায়ের সঙ্গে একরকম ছাড়াছাড়ি। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর চাচাকে মা বিয়ে করলে নজরুল যেন চির অভিমানী হয়ে ওঠেন। বাবার স্নেহবঞ্চিত হবার পর মায়ের স্নেহের বঞ্চনা নজরুল জীবনের একটি গভীর ক্ষতের অধ্যায়। তবুও ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যে মায়ের অনুভবকে তীব্র আবেগে ধারণ করে কবিতা লিখেছেন তিনি। মা তো শিশুর সোহাগ ঘরের আগরবাতি। নিত্যদিন তার বাবুকে কীভাবে যত্নে রাখা যায়, আনন্দে রাখা যায়, করে যে সেই ছলচাতুরি। আর অসুস্থ হলে নাওয়া খাওয়া ভুলে হাসিমুখ দেখার জন্য যেন রাতজাগা পাখি।


যেখানেতে দেখি যাহা

মা-এর মতন আহা

একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,

মায়ের মতন এত

আদর সোহাগ সে তো

আর কোনোখানে কেহ পাইবে না ভাই।

হেরিলে মায়ের মুখ

দূরে যায় সব দুখ,

মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,

মায়ের শীতল কোলে

সকল যাতনা ভোলে

কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।

কত করি উৎপাত

আবদার দিন রাত,

সব সন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!

আমাদের মুখ চেয়ে

নিজে রন নাহি খেয়ে,

শত দোষে দোষী তবু মা তো ত্যাজে না।

ছিনু খোকা এতটুকু,

একটুতে ছোটো বুক

যখন ভাঙিয়া যেত, মা-ই সে তখন

বুকে করে নিশিদিন

আরাম-বিরামহীন

দোলা দিয়ে শুধাতেন, ‘কী হল খোকন?’

আহা সে কতই রাতি

শিয়রে জ্বালায়ে বাতি

একটু অসুখ হলে জাগেন মাতা,

সবকিছু ভুলে গিয়ে

কেবল আমারে নিয়ে

কত আকুলতা যেন জগন্মাতা।

 

লেখক :  শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন