মিলান কুন্দেরা সেই ধরনের লেখক যিনি আধুনিক মানুষের অন্তর-অনুভবকে উসকে দিতে পারতেন। শিল্পের ভেতর অনুভবের অতল প্রবাহকে ছড়াতে সক্ষম ছিলেন তিনি। তাঁর বিদায়ে শোক জানাই। ৯৪ বছরের দীর্ঘ একটা জীবন পাড়ি দিয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। কালের অগ্নিদাহ পরিস্থিতি মানুষের জীবনকে যেভাবে পর্যুদস্ত করে, মিলান কুন্দেরা যেন সেই দগ্ধ ক্ষতের চিকিৎসক। বিনম্র শ্রদ্ধা হে মহান লেখক!
মিলান কুন্দেরা নাকি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিল, লেখকরা তাঁদের কাজের মাধ্যমেই সবার সঙ্গে কথা বলেন। লেখকের কাজ বাহ্য শোভাবৃদ্ধি নয়, জীবনের গভীরে।
তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম ‘দ্য জোক’। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’ ও ‘দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’। ফরাসি দৈনিক ‘লে মন্ডে’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর লেখাকে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করার অভিযোগ তুলেছিলেন। বলেছিলেন,
“রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করে আমার লেখার ভার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি মনে করতেন একজন লেখক সমকাল ও রাজনৈতিক মতাদর্শকেও ছাড়িয়ে যাবার ক্ষমতা রাখেন। এতেই একজন প্রকৃত লেখককে খুঁজে পাওয়া যায়। না হলে তিনি হয়ে যান অস্পষ্ট। মহাকাল কাউকে ক্ষমা করে না। আর এমনি এমনিও কেউ কাউকে মনে রাখে না। তিনি এইসব সত্য মানতেন, বিশ্বাস করতেন। ক্ষমতা বা পাওয়ার সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি--
“ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের মানে হচ্ছে, ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।”
বস্তুত মানুষ তাদের জীবনকে অবিরত ভাঙছে গড়ছে। যেমন পৃথিবীর অন্যান্য বস্তু ও জীবেরা কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়ে আবার জন্ম নিচ্ছে।
নানা কারণেই চেক ভাষার লেখক মিলান কুন্দরা মানুষের অন্তর-অনুভবকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চেক ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফরাসি ভাষাতেও লিখেছেন। তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক স্যাটায়ারগুলো চিত্তাকর্ষক। সেই সঙ্গে কবিতাস্পর্শী গদ্য পাঠককে দারুণভাবে আপ্লুত করেছে। শিল্পের অভিনব পথ তাঁকে সারা বিশ্বের অনিবার্য প্রিয়তম লেখকে পরিণত করেছে।
‘আর্ট অব দ্য নভেল (১৯৮৬) তাঁর লেখা অন্যতম সমালোচনা-গ্রন্থ। আর্ট সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের চেয়েই আলাদা। জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও আমাদেরকে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। কুন্দেরার মতে,
“জীবন একটি অনন্য ফাঁদ।”
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সম্মতি না নিয়েই আমাদের জন্ম দেওয়া হয়। আর আমরা এমন একটা শরীর নিয়ে আটকা পড়ি যা আমরা নিজেরা পছন্দ করে নেইনি। কিংবা আমরা বাছাই করারই সুযোগ পাইনি। আমাদের একমাত্র নিয়তি হচ্ছে মৃত্যু। আর এই মৃত্যু এক ধ্রুব সত্য। যেখান থেকে আমরা কেউই পালাতে সক্ষম নই। তাই জীবন তো এক পরম কৌতুক বৈ কিছু নয়! জীবনে ভুল আছে ভুলের সংশোধনও আছে বলে আমরা ভাবি। কিন্তু কুন্দেরা ভাবেন, একবার ভুল করার পর মানুষের আর সংশোধনের সুযোগ নেই। কারণ জীবন খুব সংক্ষিপ্ত। আসলে জীবনের এই সংহত ছোট্ট তরিতে দু বার বসার সুযোগ কোথায়?
জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে এমন সব অনুভবই তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন সাহিত্য ও শিল্পের পাঁজরে, দেহে, রক্তে। ভাবনার অতলান্তিক জগতে তিনি টেনে নিয়ে গেছেন হিড়হিড় করে। নিদাঘ কালের উপস্থিতিকে নিয়ে গেছেন শিল্পের পরম অনুভবের জগতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন