অদ্বৈত মল্লবর্মণের রচনায় নদী ও উন্নয়নের ফাঁকি

 ডেইলি স্টার বাংলায় ছাপা : https://bangla.thedailystar.net

প্রকৃত শিক্ষার অভাবে উন্নয়নে অসমতা তৈরি হয়। মূল্যবোধ না বদলে মানুষের বাহ্যিক প্রকৃতি পাল্টে যায় মাত্র। এই উন্নয়ন কেবল সীমিত সংখ্যক তল্পিবাহক মানুষের কাজে লাগে।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১ জানুয়ারি ১৯১৪—১৬ এপ্রিল ১৯৫১), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ প্রান্তিক সমাজ থেকে এসেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে একসময় মধ্যবিত্ত সমাজে গণ্য হন। আমাদের দেশে নিম্নবিত্ত থেকে অর্থনীতির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠাকে সাফল্য বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু অদ্বৈত নিজে কী ভাবতেন? আমরা জেনেবুঝে তাকে চর্চা করতে পেরেছি কি? অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাহিত্যপাঠের পূর্বশর্ত হওয়া উচিত ছিল তা। যদিও সাহিত্য কোনও মতাদর্শের খোঁয়াড়বন্দি বিষয় নয়। তবুও প্রকৃত সত্য আড়াল করা সত্যিকার শৈল্পিক আচরণও নয়।

'তিতাস একটি নদীর নাম', 'সাদা হাওয়া', 'রাঙামাটি' উপন্যাস কি গল্পগ্রন্থ 'দল বেঁধে' যা-ই পাঠ করা যাক, একজন ন্যাচারাল শিল্পী ধরা পড়ে। কোনো ভান-ভণিতা ছাড়াই অদ্বৈত শৈল্পিকতার পথ খনন করেছেন। এর মধ্যেই স্পষ্ট হয় জীবনের জটিলতা, বাস্তব পরিবেশের ধারণা। তার উপন্যাসে মনে রাখতে হয় না—কে নায়ক আর কে প্রতিনায়ক। লেখা রোমান্টিক হলো, নাকি বাস্তবঘেঁষা হয়ে গেলো, অথবা বৈশ্বিক চিন্তায় থই পেলো কিনা, সেসবও মনে রাখতে হয় না। গল্পের স্বাভাবিক বুননে তার কাহিনি অগ্রসর হয়। এক্ষেত্রে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার তুলনা চলে। সংসারের তুচ্ছ কি ক্ষুদ্র, বড় না ছোট প্রভৃতি প্রশ্ন মাড়িয়ে জীবনের প্রকৃত রূপ ভাস্বর হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক বিষয়টি টের পেয়েছিলেন। সেজন্যই বলেছিলেন, "...এটি একটি সৎ লেখা। …এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলী, আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো—সব মিলিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করা যায়। অদ্বৈতবাবু অনেক অতিকথন করেন। কিন্তু লেখাটা একেবারে প্রাণ থেকে, ভেতর থেকে লেখা।" 
 
ঋত্বিকের কথায় এই যে নাটকীয় উপাদান, তা তো উপন্যাসে দুর্বলতার প্রমাণ! কিন্তু অদ্বৈতর লেখা বিচার করে সেকথা বলা যাচ্ছে না। আবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেও শৈল্পিক উনতা বলে ধর্তব্যের মধ্যে আনা যাচ্ছে না। অনাবিল আনন্দ-সৃষ্টিকে আর শিল্পের অত্যুচ্চ গুণ হিসেবে ভাবা হয় না। তবুও কেনো অদ্বৈত আজও প্রাসঙ্গিক? বিশ্বসাহিত্যে এমন অনেক লেখা রয়েছে, যেগুলো সরল শব্দমহিমা নিয়েও চিরজাগ্রত। কারণ শুদ্ধমাত্র সাহিত্য তৈরি নয়, প্রশ্ন রেখে রেখেই তিনি অগ্রসর হয়েছেন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর দিকে। আজ যাকে সামাজিক উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে দাবি করা হয়, অদ্বৈত বহু বছর আগে সেগুলো নাকচ করে দিয়েছেন। একে একে অসঙ্গতিগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রমাণ করা যাক।   

অদ্বৈত মল্লবর্মণ কলকাতায় আয়ের সমস্ত অর্থই ব্যয় করেছেন জনকল্যাণে। তার ফেলে যাওয়া গ্রামের মানুষকে তিনি কখনই অবজ্ঞা ও পরিত্যাগ করেননি। সামান্য খাবারও অপরের সঙ্গে ভাগ করে খেয়েছেন। এসব ব্যক্তিগত তথ্য ব্যতিরেকেও, শিল্পনির্মাণের সত্যে তিনি বিচার্য। সামাজিক ইতিহাসের একেবারে তলানিতে যে-ঐতিহাসিক উপাদান থাকে, তথাকথিত মূলধারার ইতিহাস তাকে চাপা দিয়ে রাখে। অদ্বৈত ইতিহাসের এই নির্মমতাকে জানতেন। বৃহত্তর কোনো উপাদান তার উপকরণ নয়, পৃথিবীর বৃহৎ বৃহৎ নদীপাড়ের সভ্যতাও তার বিবেচ্য নয়। বরং তিনি লিখতে চেয়েছেন প্রতিদিনের সামাজিক জীবনে তুচ্ছ, হারিয়ে যাওয়া মানবিক ইতিহাস। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার 'ইছামতি'-তেও সামান্য নদীকে অসামান্য করে তুলেছিলেন। মানুষের বাস্তুভিটার সঙ্গে, নদী ও জলের সঙ্গে মিশে থাকা অতি সাধারণ মূক-জনগণের জীবনকে তিনি 'আসল জাতীয় ইতিহাস' বলতে চেয়েছেন।

'তিতাস একটি নদীর নামে'র শুরুর দিকের বর্ণনা : "পুঁথির পাতা পড়িয়া গর্বে ফুলিবার উপাদান এর ইতিহাসে নাই সত্য, কিন্তু মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বৌ-ঝিয়ের দরদের ইতিহাস এর তীরে তীরে আঁকা রহিয়াছে। সে ইতিহাস কেউ জানে, কেউ হয়ত জানে না। তবু সে ইতিহাস সত্য।" শত বেদনার ইতিহাসে অঙ্কিত ছোটনদী তিতাস। অভিধানের পাতায় নাম নেই, কিন্তু এর অন্তর্গত সুখ-দুঃখের ইতিহাস, 'সত্যের মত গোপন হইয়াও বাতাসের মত স্পর্শপ্রবণ'। সে-ইতিহাস বাংলাদেশের নদীবিধৌত অগণিত জনপদের ইতিহাস। বর্ণনায় কোনো অতিরঞ্জনের চিহ্ন নেই, অবকাশও নেই। পরিবেশগত সততায় চিহ্নিত এই জনপদ। বিশেষত 'প্রবাসখণ্ড' যেন মালোদের দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্যপট। 

একটি দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান বিচার করে উন্নয়ন-অর্থনীতি। এই অর্থনীতি সর্বব্যাপী, আপামর মানুষের না হলে, তাকে উন্নয়ন বলা যায় না। 'তিতাস একটি নদীর নাম' অনাঘ্রাত জীবনের প্রশ্ন-সঙ্কুল—সুবল-কিশোর এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বাল্যকালেই তাদের লেখাপড়ার পাট চুকে যায়। জীবিকার জন্য অন্যের নৌকায় কাজ নেয়, যায় প্রবাসে। কোনো বৈদেশিক সীমান্তরেখা নয়, স্বদেশই তাদের প্রবাসজীবনের অপরবিশ্ব। সুবিধাবঞ্চিত স্ব-অঞ্চল তাদের চোখে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়। "এ গায়ের মালোরা গরীব নয়। বড় নদীতে মাছ ধরে। রেলবাবুদের পাশে থাকে। গাড়িতে করিয়া মাছ চালান দেয়। তারা আছে মন্দ না।" তাদের দৃষ্টিতে ভৈরবের মালোরা অগ্রসর। সেখানে গড়ে উঠেছে উন্নত যোগাযোগ-ব্যবস্থা। কিন্তু উন্নয়নের অসমতা সুবলদের জীবিকার পথে বাধা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি'তেও একই দৃশ্যপট হাজির। কুবের ও গণেশরা বড় মাছ ধরে, তা ধরলেও, মালিক নয়। সেই মাছের অধিকার শেতলবাবুদের। নিজেদের স্বাদ আহ্লাদকে তারা স্বল্পদামেই বিসর্জন দেয়। এই না-পাবার আকাঙ্ক্ষা থেকেই তৈরি হয় ক্ষোভ, অন্যায়। তারা মাছ চুরি করে উন্নয়ন অর্থনীতির ফাঁকিতে পড়ে। 

বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক'-এ দোবরু পান্নার বংশধর ভানুমতির প্রশ্ন—'ভারতবর্ষ কোনদিকে?' এ-প্রশ্নের জবাব দেবার ক্ষমতা কারো নেই। এ-ও এক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফাঁকি। নাগরিক সভ্যতা গ্রাম বিনাশ করে, গ্রামীণ সংস্কৃতিও নষ্ট করে। তিতাসপাড়ের সুবল-কিশোরের সঙ্গী বৃদ্ধ তিলকও তা বুঝতে পারে। মালোদের জায়গাজমি রেল-কোম্পানি অধিগ্রহণ করে। লেখকের কথায়—'বৃহত্তর প্রয়োজনের পায়ে ক্ষুদ্র আয়োজনের প্রয়োজন অগ্রাহ্য হইয়া গিয়াছে।' সুবলের কথায় আরও কষ্টের সংবেদনা জাগে। সে কিশোরকে জানায়, ভৈরবের মালোরা জামা জুতা ভাড়া করে নাকি রেল কোম্পানির বাবুদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে যায়। তাদের বাসার কাছ দিয়ে ঘুরঘুর করে। কিন্তু অশিক্ষিত মালোদের তারা অবজ্ঞাই করে। এদিকে বাবুরা মালোপাড়ায় বসে তামাক টানে আর বলে, "পোলাপান ইস্কুলে দেও—শিক্ষিৎ হও শিক্ষিৎ হও।"

শিক্ষিত হয়ে শ্রেণিবদল হয় মাত্র। এই শিক্ষিতরা তেমন কোনো কাজে আসে না। দুর্নীতি, স্বার্থপরায়ণতা, বিলাসিতায় গা ভাসায় তারা। বৃদ্ধ তিলকের প্রশ্ন হৃদয় ছেদ করে চলে যায়। সে ক্ষেপে উঠলে বলে—'হ' শিক্ষিৎ হইলে শাদি সম্বন্ধ করব কি না। আরে সুবলা তুই বুঝবি কি! তারা মুখে মিঠা দেখায় আর চোখ রাখে মাইয়া-লোকের উপর।' শুধু রোষ নয়, তাদের রসিকতার ভাষাও চরম আঘাত করে। তিলকের কথায় কিশোর হেসে বলে, 'না তিলকচাঁদ না। চোখ রাখে বড় মাছের উপর।'

অদ্বৈত তার উপন্যাসে জেলেদের পাশাপাশি চাষীদের অবস্থাও চিহ্নিত করেছেন। লোন কোম্পানির টাকা তারা কখনই শোধ করতে পারে না। ঘরে সামান্য ধান উদ্বৃত্ত থাকলেও তাদের পোষাক জোটে না। ঋণের ফাঁদে চাষীরা জমি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়। উন্নয়ন সর্বোতভাবে মানবমুখি আর অঞ্চলমুখি না হলে, তা সামাজিক বৈষম্যকে প্রকট করে। অর্থনীতির ভাষায় একে 'রিজিওনাল ইমব্যালান্স' বলা হয়। এটি শুধু অর্থ নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ, কৃষিব্যবস্থাসহ অনেক কিছুকে বোঝায়। বস্তুত একটি ছাড়া অপরটি ন্যুব্জ হতে বাধ্য।

জার্মানির সম্পদ শাস্ত্রকার ও অর্থনীতিবিদ এরিখ ওয়াল্টার জিমারম্যান পূর্বপ্রচলিত সম্পদের ধারণাকে নাকচ করেছিলেন। সম্পদের মানবিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর সদ্ব্যবহারের প্রতি তিনি তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি সম্পদের স্থিরতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রকৃতপক্ষে, সম্পদকে প্রয়োজনের সময় মানুষ কাজে লাগায়। মানবিক 'মূল্যায়ন' সম্পদের ধারণাকে বদলে দেয়। মানব-উন্নয়নকে সামাজিক-অর্থে কাজে লাগাতে না পারলে উন্নয়ন ব্যর্থ হয়। প্রকৃতিগত বাধা অতিক্রম করেই এই উন্নয়ন। আবার এর সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের চিন্তাও যুক্ত। নদী মরে গেলে সভ্যতা টেকে না। জল ও জীবনের প্রকৃত সঙ্গী না হতে পারলে পরিবেশ বিপর্যয়ে ধ্বংস আসে। 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে সে-বিষয়টা পলে পলে উপলব্ধ হয়। নদী শুকিয়ে গেলে জীবন ও জীবিকায় আঘাত আসে, মালোসমাজ ভয়াবহ দারিদ্র্যে সর্বস্বান্ত হয়। 

প্রকৃত শিক্ষার অভাবে উন্নয়নে অসমতা তৈরি হয়। মূল্যবোধ না বদলে মানুষের বাহ্যিক প্রকৃতি পাল্টে যায় মাত্র। এই উন্নয়ন কেবল সীমিত সংখ্যক তল্পিবাহক মানুষের কাজে লাগে। এ-উপন্যাসে লক্ষণীয়, উজানিনগরে হবু আত্মীয়দের একজন বলে—'আপনার দেশ নাকি সুদেশ। দেখতে ইচ্ছা করে। কায়স্থ আছে, ব্রাহ্মণ আছে, শিক্ষিত লোক আছে। বড় ভালো দেশে থাকেন আপ্নেরা।' তখন কিশোরের মনে তীব্র প্রশ্নের জন্ম হয়। তার অস্ফূট অভিব্যক্তি লেখক প্রকাশ করেন : 'শিক্ষিৎ লোকের দেশে থাকার যে কি কষ্ট, আর এদের মত দেশে থাকার যে কি সুখ, এ কথাগুলি যুক্তিপ্রমাণ দিয়া বুঝাইয়া দিবার কিশোরের সময় নাই।' তথাকথিত শিক্ষিত মানুষরা আজও আমাদের দেশে মানুষ হয়নি। তাদেরকে কেনো বিশ্বাস করবে সাধারণ মানুষ? ফাঁপা উন্নয়নই অবিশ্বাস তৈরি করে। উপন্যাসে দেখা যায় যে, কৃষক কাদির মিয়া এই শিক্ষিতদের সন্দেহ করে। ছাদির মিয়া তার পুত্র রমুকে মক্তবে পড়াতে চায়। কিন্তু দাদা কাদির মিয়া বাধা দেয়। অক্ষরজ্ঞানহীন কাদির মিয়ার কাছে মক্তবে পড়ানোর অর্থ শিক্ষিত হওয়া। 

"...কাদির বলিল, 'দে, তোর পুতেরে মক্তবে দে, কিন্তু কইয়া রাখলাম, যদি মিছা কথা শিখে, যদি জালজুয়া চুরি শিখে, যদি পরেরে ঠকাইতে শিখে, তবে তারে আমি কিছু কমু না, শুধু তোমার মাথাটা আমি ফাটাইয়া দিমু ছাদির মিয়া।" শিক্ষিত মানুষ ঘুষ খায়, দুর্নীতি করে—সর্বজনবিদিত সত্যটিই সামনে এসেছে। এই মর্মে কাদির মিয়া তার বেয়াই তথা ছেলের শ্বশুরকে ইঙ্গিত করে। বেয়াই মুহুরি অসৎ জাল জুয়াচোর নষ্ট খল। এই দেখে নাতিকে কৃষিকর্মে পাঠাতে, এমনকি নিরক্ষর করে রাখতেও কাদির রাজি, কিন্তু বিদ্যালয়ে পাঠাতে রাজি নয়। "আর ইস্কুলে পাঠাইলে, তোর শ্বশুরের মত মুহুরী হইতে পারিবে…ঘুষের পয়সা গুণিতে পারিবে। কাজ নাই বাবা অমন লেখাপড়া শিখিয়া।"— এই অবিশ্বাস ও সন্দেহ গালভরা উন্নয়নের গোপন কোঠরে আঘাত হানে। বর্ণমালা চেনা মানেই মানবিক হয়ে ওঠা নয়—অদ্বৈত স্পষ্ট করেন। 

উপন্যাসে আরও দেখা যায়—মালোরা ঘরের মালিক কিন্তু মাটির মালিক নয়। প্রজা-উচ্ছেদ হয়ে নতুন প্রজা আসে। অত্যন্ত কমসংখ্যক মানুষের হাতে বেশিসংখ্যক মানুষের পরাজয় ভয়ানক ট্রাজেডি। প্রতিবাদের স্বর শেষপর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে। কারণ, "তিতাসের মালিক জেলেরা। কাগজপত্রের মালিক আগরতলার রাজা।" ফলে 'মাথট' বা খাজনার মালিকও আগরতলার রাজা। সমাজ-পরিবর্তনের সূত্রেই সৃষ্টি হয় বাজার-ব্যবস্থা। ফলে মাছ বিক্রেতাদেরকে আবার নতুন মাশুল গুণতে হয়। আনন্দবাজারে মাছবিক্রি করতে আসা মালোদের কাছ থেকে ভারপিছু দু আনা করে মাশুল চায় জমিদার। পুঁজির নতুন আগ্রাসনে গরিব মালোরা আরও গরিব হয়ে যায়। এরপর আসে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। স্বনামে বাজার বসায় জগৎবাবু ও আনন্দবাবু নামক শহরবাসী দুজন গণ্যমান্য জমিদার। অন্যদিকে মালোরা প্রায় প্রত্যেকে টাকা ও ধুতির দামে বিক্রি হয়। আনন্দবাবুর বাজার ফুলে-ফেঁপে ওঠে।

আনন্দবাবু না থাকলেও, তার লোকেরা খাজনা চায়। এভাবেই সুবলরা কখনই নৌকার মালিক হয় না, যেমন হয়নি তার বাবা গগন মালোও। শুধু নৌকা নয়, জালের মালিকও তারা হয় না। এটাই তৃতীয়বিশ্বের উন্নয়ন অর্থনীতির চিহ্ন। সুবলরা সভ্য-সমাজকে মাছ খাইয়েছে শুধু, নৌকার মালিক হয়নি। তার বাবা গগন মালোও কোনোদিন নৌকা-জালের মালিক ছিল না। সুবলের মৃত্যু উন্নয়ন-অর্থনীতির ফাঁদে আক্রান্ত গরিব মানুষের অকাল মৃত্যু। নদী শুকিয়ে যাওয়া উন্নয়ন-অর্থনীতির চরম ফাঁকির ফল। পাগল কিশোর জনগোষ্ঠীর মস্তিষ্কবিকৃতির নামান্তর। 

অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেপথ্যের এই ভয়াবহতা যেন বিশ্ব-অর্থনীতিরই অন্যপাঠ। অর্থের কেলেঙ্কারিই শুধু নয়, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও চমৎকারভাবে তুলে আনেন অদ্বৈত। মালোপাড়ার তামসীর বাপ এই আগ্রাসনে সহায়ক শক্তি। ঔপনিবেশিককালে লক্ষণীয়, উপনিবেশিতরা নিজেদের কিছু লোকের মাধ্যমে শোষিত হয়। তামসীর বাপ ঔপনিবেশকদের বন্ধুগোত্রীয়। তার মাধ্যমে মালোপাড়ার নিজস্ব সংস্কৃতিতে (বাজারের কায়েতদের মাধ্যমে) আঘাত আসে। তামসীর বাপ নিজে তা বোঝে না, তা নয়। সেও জানে, কায়েতরা আলগা খাতির করলেও, মালোদের তারা আপন করবে না।

অপরাধবোধ কাজ করে তার মধ্যে: "এরা মালোদেরকে কত ঘৃণা করে। …তারা ছোঁয়ারও অযোগ্য। মালোরা মালো বলিয়া কি মানুষ নহে।" কিন্তু তাই বলে আগ্রাসন থেমে থাকে না। উপন্যাসের শেষের দিকে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এটাই হয়তো জগৎ-সূত্র—একবার যদি কেউ ক্ষমতাবানদের তল্পিবাহক হয়, সেখান থেকে ছুটে আসা মুশকিল। ক্ষমতা ও সম্পদের মালিক কালোবরণ নামক চরিত্ররা অর্থলগ্নিকারী মধ্যস্বত্বভোগী। ঋণকোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা যেন বেপরোয়া আইএমএফ। ঋণী মালো বিধুভূষণ পালকে তারা পানিতে নামিয়ে চুবিয়ে ধরবে স্বাভাবিক।

এমন অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় সবকিছু হারায় মানুষ। বঞ্চিতরা আরও বঞ্চিত হয়ে সর্বস্ব লুটায়। অনন্তবালাকে হৃদয়ে প্রেম নিয়ে অপেক্ষমান দেখা যায়। কিন্তু তাদের প্রেমকেও শোষণ করে চলে বিধিব্যবস্থা। অন্তসারশূন্য মধ্যবিত্তের ইঁদুরদৌড়ে শামিল হয়ে তাকে হারিয়ে ফেলে অনন্ত। উপন্যাসে অনন্ত চরিত্রটি  অদ্বৈত মল্লবর্মণের আত্মসত্তার প্রকাশ। তিতাস তীরের এক মালোপাড়া দেশের লাখো-কোটি অসহায় জীবনের প্রতীক। একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী সেখানে মুখ্য হলেও, উদ্দিষ্ট হয়ে ওঠে বিশ্বপরিপ্রেক্ষিত। ক্ষমতা ও উন্নয়ন-অর্থনীতির দণ্ডমুণ্ডকর্তাদের নির্লজ্জ বেসাতি উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে উদ্ভাসিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন