হাসান আজিজুল হকের সব উপন্যাসই ব্যক্তিচৈতন্য উৎসারিত। ধ্যান-জ্ঞান-খেয়ালে তিনি একজন নিবিষ্ট কথাশিল্পী। তিনি কবিতা লেখেননি, কিন্তু উপন্যাসের ভাষা কবিতার মতো হৃদয়স্পর্শী। সৃজন-মননের অনন্যতায় জীবন-সময়-অভিজ্ঞতা সবকিছু দিয়ে তা পাঠককে আবিষ্ট করে। তার অপ্রকাশের ভারনামক গ্রন্থেও রয়েছে এই আবিষ্টতার প্রমাণ। আসলে মানবজীবনে নিঃশব্দে ঘাত-সংঘাত চলছে বিরামহীনভাবে। দেশে-সমাজে বহু কোটি মানুষের সেই নিঃশব্দ বিস্ফোরণের সংবেদ সাহিত্যিকের কাছে থাকতে হয়। হাসান আজিজুল হকের উপন্যাসে তা গভীর প্রত্যয়ে উপস্থাপিত।…
হাসান আজিজুল হক তখনো পরিপূর্ণ উপন্যাস লেখেননি, দু-একটি ঔপন্যাসিকা রচনা করেছেন। সাহিত্যিক অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তাকে জানালেন, ‘হাসান আজিজুল হক, আপনার একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস কবে পড়তে পাব? আপনার কথায়, গল্পে উপন্যাসে আপনি জলজ্যান্ত আঁকতে পারেন, এবং আপনার সব বৃত্তিকে কাজে লাগাতে পারেন। ...একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস কবে পাঠককে উপহার দেবেন?’ একসময় তার নিজেরও নাকি আশঙ্কা ছিল- উপন্যাস লেখা সম্ভব হবে কি না! কিন্তু একে একে সাবিত্রী উপাখ্যান, বিধবাদের কথা, আগুনপাখি, শিউলি, বৃত্তায়ন ও শামুক তার কলমে উঠে আসে। উভয় বাংলার অবিসংবাদিত গল্পকার হিসেবে খ্যাত এই মানুষটি জন্মেছিলেন বর্ধমানের কঠোর আনুশাসনিক সমাজে। সেই সঙ্গে তা ইতিহাসের জটিল এক সময়পর্ব। কালের নির্জলা বাস্তব প্রতিফলিত হয়েছে তার কথকতায়। প্রবল অনুভব আর তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার সামনে দাঁড়ানো তার চরিত্রগুলো। বহমান জীবন, সংগ্রাম আর কালের সত্য সেখানে মিলেমিশে একাকার। হাসান আজিজুল হকের বেশির ভাগ শিল্পই ব্যক্তি-প্রভায় স্নাত। কোনো লেখকই বোধহয় শূন্যস্থান থেকে সাহিত্য নির্মাণ করেন না। কথাসাহিত্যের কথকতায়ও তার এই অনুভব ব্যক্ত হয়েছে। এমনকি তার জীবনস্মৃতি, ব্যক্তিকথন, সাক্ষাৎকার কী বক্তৃতায় ঘুরেফিরে যেন সমান প্রতিধ্বনি।
আগুনপাখি ও সাবিত্রী উপাখ্যান লেখকের শৈশব ও কৈশোর স্মৃতিঋদ্ধ। আখ্যানে সচেতনভাবে গ্রামজীবনকে সঙ্গী করেন তিনি। আন্তরিক ও প্রাঞ্জল ভাষা তার শৈল্পিকবৈশিষ্ট্য। মানুষের অন্তর্লোক উন্মোচনে এই লেখকের দক্ষতা বারবার প্রমাণিত। জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল ও দ্বিতীয় সমরোত্তর কি ভারতের স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তীকালের লেখকদের সঙ্গে তার যেন সমিলবন্ধন। মানবমনের রহস্য ও জটিলতা উন্মোচনে নৈপুণ্য তার অনায়াস; তবে কখনো বেশি অন্তর্মুখী, অতি সূক্ষ্ম, সাংঘাতিক ব্যঙ্গবক্র। ষাটের নিরীক্ষাপ্রবণ কথাসাহিত্যের কর্ণধারদের একজন তিনি। দেশভাগোত্তর সমাজের সংখ্যাতীত বিষয় তার শিল্পের উপজীব্য। তার বক্তব্যে, ‘সাহিত্য কখনো বিচ্ছিন্ন দ্রব্য নয়, কারখানা থেকে গড় গড় করে বেরিয়ে আসে না, সমাজ-কাঠামোর সঙ্গে তার গাঁটছড়া এতই শক্ত যে সেটাকে ছিঁড়ে ফেলার কথাই ওঠে না।’
সাবিত্রী উপাখ্যানে সাবিত্রীর বৈধব্যদশার চিত্র সামান্য। এর পরিপূর্ণতা রয়েছে বিধবাদের কথায়। উপন্যাসিকা হলেও এটি উপন্যাসের সহোদর। অধুনা বড় গল্প, বড় ছোটগল্প ও উপন্যাসের প্রকৃতি দ্বন্দ্ব-বিতর্কের সবই আসলে আখ্যান। চিহ্ন-প্রতীক-সংকেত ভাঙতে ভাঙতে বিধবাদের কথা হয়ে ওঠে প্রামাণ্য ঐতিহাসিক আকর। ধর্ম-জাতিসত্তা, রক্তাক্ত কাল, শিহরণকারী হিংসা-প্রতিহিংসা এতে রূপায়িত। পিতা-পুত্র, ভাই-ভাইয়ের আদিম সংঘর্ষ যেন নারকীয় অন্ধকারের মুখোমুখি করে। নির্মমতা-জিঘাংসার রক্ত-ক্লেদ-পুঁজ মাখা শিশুদেশটি যেন বিধ্বংসী বাস্তবতা। ট্রাজিক অনুভব আখ্যানটিকে বিশিষ্ট করে তোলে। রাহেলা-সালেহা সহোদর দু-বোনের গায়ের রং ভিন্ন- এ বিরোধাভাস ইতিহাসের মতোই জটিল। অসীম ধৈর্যের নারী এতে জীবন্ত হয়েছে ‘মা’ নামক এক বিরাট সত্তায়, যারা এখন বিধবা। প্রতীকী ছোট আখ্যানটি যেন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন।
২০০৬ সালে প্রথম প্রকাশিত আগুনপাখির পটভূমি দেশভাগ। নারীর জবানে তা বাস্তুভিটার প্রতি মমত্ববোধের মানবিক আখ্যান। এতে রয়েছে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, ব্রিটিশ-বিদ্রোহ, ভারত-স্বাধীনতা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ। ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হলেও, আধুনিক ব্যক্তিসত্তার উদ্বোধন ঘটেছে এতে। ফিরে যাই ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত কিংবা এই পুরাতন আখরগুলি- এই তিন আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথার জগতের সঙ্গে এর অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষণীয়। বর্ধমানের উপভাষায় উপন্যাসটির বর্ণনা চলিষ্ণু। লেখক-চৈতন্যের সঙ্গে উপভাষা-সংযোগে তৈরি হয় ভিন্নতর এক আখ্যানবিশ্ব।
যৌথ পরিবার-উদ্ভুত চেতনা হাসান আজিজুল হকের মজ্জায়-শিরায়। কথক মেজোবউয়ের নস্টালজিক স্মৃতির ভাষা তীব্র বেদনাদায়ক। স্বশিক্ষিত গৃহস্থ এ নারী তো কালের প্রতিক্রিয়া। বহমান বাংলায় নারী কর্ত্রী হলেও, সংসারের কর্তা নয়। এ ছাড়া আগুনপাখি-তে বাবা চরিত্র, আত্মীয়-স্বজনরা ঘুরে ফিরে এসেছে। আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যও রয়েছে এতে। এ রকম উপন্যাসের পরিবেশ ও চরিত্রে লেখকের আত্ম-উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব। ডেভিড কপারফিল্ড পড়লেই যেমন ডিকেন্সের কথা মনে পড়ে, ফিলিপ মনে করিয়ে দেয় সমারসেট মমকে, তেমনি অপু চিনিয়ে দেয় বিভূতিভূষণকে, শ্রীকান্ত শরৎচন্দ্রকে। এ প্রসঙ্গে দেবেশ রায়ের কথা স্মরণযোগ্য, ‘উপন্যাসের ফর্মের প্রয়োজনেই ঔপন্যাসিককে কোনো না কোনোভাবে উপন্যাসের ভেতরে উপস্থিত থাকতে হয়।’ এই থাকাটাই একটি উপন্যাসকে সত্য ও বাস্তব করে তুলতে পারে।
শামুক উপন্যাসসমগ্রে নেই, আলাদাভাবে ২০১৫ সালে প্রকাশিত। তবে শামুকই হাসান আজিজুল হকের প্রথম উপন্যাস- হাত মকশোর সময়ে লেখা। এটিও কৈশোরিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ। প্রধান চরিত্র গ্রামের ছেলে মুনীর সেখানে লেখক হয়ে উঠতে চায়। এ আখ্যানে প্রকৃতির বর্ণনা ও মুনীর যুগপৎ বিভূতি-হাসানের মিলিতস্থল। জীবনের গভীর সম্ভাবনা ও পরিণতির ইঙ্গিত এই মুনীর। হাসান আজিজুল হকের পরিণত বয়সের লেখায় প্রেম অনুপস্থিত। কিন্তু শামুক উপন্যাসে প্রেম এসেছে। তবে সে-প্রেম রোমান্টিক স্বপ্নের নয়, বিষাদের অশ্রুরেখা। পাখির মতো ডানা থাকলেও যন্ত্রণাদগ্ধ তেলাপোকার শাপগ্রস্ত ঘৃণ্যজীবন মুনীরের। শামুকের বর্ণনায়, ‘তেলাপোকা পাখি নয়। ...ডানা থাকলেই পাখি হয় না, উড়তে পারলেও না। বোধহয় ওড়ার ইচ্ছাটাই পাখির। ...কিন্তু তার পক্ষচ্ছেদ হয়েছে, উড়তে গেলেই মাটিতে পড়ে।’ পুরো কাহিনিজুড়ে অশুভ ছায়া ঢেকে রাখে একটি বৃহৎ জনপদ। ঔপনিবেশিক সমাজ, ইংরেজি শিক্ষা, কেরানির জীবন, প্রেমের অপরিণতি সবই বিদ্ধ করে নায়ককে; যেন শামুকের খোলসে নিবদ্ধ এক জীবন। ব্যক্তি-যন্ত্রণা, পরিবার, বিকাশ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, অচরিতার্থতা সব মিলে সুতীব্র সমাজ-সংকট।
চল্লিশের উত্তাল সময়, দেশভাগ ও বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতির বেদনা শিউলি আখ্যানে চিত্রিত। শিউলির ছত্রিশ বছরের নিরুৎসব নিঃসঙ্গ, নিষ্ঠুর জীবন-সংগ্রামের জন্য দায়ী দেশভাগ। কেরানি পিতার ভয়াবহ দৈন্য, অপূর্ণতা-অতৃপ্তির বুকফাটা আর্তনাদে প্রকম্পিত আকাশ-বাতাস। বৃত্তায়ন আখ্যানটি হাসান আজিজুল হকের আত্মপ্রতিকৃতি কি না, তা স্পষ্টভাবে বলা কঠিন। তবে এর মধ্য দিয়েও কালের অমোঘ সত্য প্রকাশিত। তরুণ বয়সে রাজশাহী পদ্মাপারের জীবনের অভিক্ষেপ রয়েছে এতে। জীবনের উত্তাল আবেগ, পদ্মাপারের শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার সৌরভ, তীব্র গভীর দার্শনিক অনুভব আর পঠনের ব্যাপকতায় সতৃষ্ণ জ্ঞানের জগতে লীন তিনি। হেমিংওয়ের দি স্নোজ অব কিলিমানজারো, দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি, হুসার্ল-এর ফেনোমেনলজি, হাইডেগারের বিয়িং অ্যান্ড টাইমের দর্শন ও সাহিত্যবোধে তা আলোকিত। প্রাগৈতিহাসিক যৌন-আকাঙ্ক্ষায় চালিত জীবনের গূঢ়-অন্ধকারকে তিনি সামনে এনেছেন। সমগ্র মানবজগতের গভীর নিয়তি-সন্ধান, অসভ্যতা, জিঘাংসা, অনাঘ্রাত কামনা-অন্বেষা দার্শনিক অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে। জিদ ও মরিয়কের উপন্যাসের মতো দার্শনিকসত্তার প্রকাশ বৃত্তায়ন। কিন্তু মরিয়কের মতো আদিপাপ নয়, অন্যদিকে ব্যক্তিপ্রধান ইউরোসেন্ট্রিক আখ্যানের আভিজাত্য থেকেও হাসান আজিজুল হক স্বতন্ত্র। সে অর্থে তার অন্বিষ্ট- রম্যাঁ রল্যাঁ, জ্যুল রম্যাঁ, দু হামেলের মতো আত্মজিজ্ঞাসু, সমাজমুখী, বলিষ্ঠ ও প্রগতিশীল ঐতিহাসিক দৃষ্টি। আত্মকেন্দ্রিক মনোবিশ্লেষণ নয়, বৃহত্তর সমাজের গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের আখ্যান রচনায় তিনি বেশি আগ্রহী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন