খোরশেদ আলম
মান্না দের একটা গানের শুরু, “সবাইতো সুখি হতে চায়, কেউ সুখি হয় কেউ হয় না।” তিনি এ বলেই ক্ষান্ত হননি। বলেছেন, “জানি না বলে যা লোকে সত্যি কিনা, কপালে সবার নাকি সুখ সয় না।” যে সুখ কপালের, তা হয়তো সবার জন্য সমান নয়। শিল্পী যে সুখের কথা গেয়েছেন তা ব্যক্তিগত, বাইরের লোকের কিছু বলার নেই।
আসলেই তো যার যার ব্যক্তিগত বিষয়, সেই সেই সামলাবে। কিন্তু যখন সুখের বিষয়টা সামাজিক/রাজনৈতিকভাবে উত্থাপিত হয়, তখন একটা যৌথতার প্রসঙ্গ থাকে। এই যুথবদ্ধতার মধ্যে অনেকগুলো কমন আনকমন ফ্যাক্টর থাকতে পারে। তবে সামাজিক মানুষের কমন প্লাটফর্ম হচ্ছে মৌলিক চাহিদাপূরণ, যা সাধারণত অর্থ-ব্যবস্থার হাত ধরে আসে। আর অর্থ-ব্যবস্থায় ঝামেলা হলে মান্না দের প্রেমিক/প্রেমিকারা খরস্রোতা নদীতে হাবুডুবু খায়, কখনও তাল সামলাতে না পেরে ডুবে মরে যায়।
বহু মানুষই প্রতিষ্ঠা লাভের তরীতে উঠে রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পের মতো সুরবালাকে হারিয়ে ফেলে। একসময় দুঃখ করে বলে, “সুরবালা আমার কিনা হইতে পারিত।” অন্যদিকে শিল্পীর কফিহাউসের সুজাতারা লাখপতি স্বামী নিয়ে সুখের সংসার করে। এখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই শিল্পসত্য তো তৈরি হয়েছে প্রবল বাস্তবতার মধ্য থেকে। তাকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। আবার অনেকে ভাবতে পারেন, প্রেম হারিয়ে যায় বলে মানুষ তা মনে রাখে, মনোবেদনার কারণ ও স্মৃতি হয়ে থাকে। এরকম না হলে কীভাবে তৈরি হতো সুরবালা সুজাতারা, কি করেই বা তৈরি হতো শরৎবাবুর ‘দেবদাস’ উপন্যাস আর সুবোধ ঘোষের ‘জতুগৃহে’র মতো অবিনাশী গল্প! এই তর্কটা আপাতত থাক, মন আর আধ্যাত্মিক জগতটা অনেক সময়ই নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ ও রাজনীতি। তার নেপথ্যে থাকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা।
অধিক সংখ্যক মানুষের সুখি হওয়াটা একটা লক্ষ্য অর্জনের মতো, যা পুরো সমাজকেই পাল্টে দিতে পারে। বাংলাদেশে আজও বহুসংখ্যক মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত, বহু মানুষের সামান্য বেঁচে থাকার উপকরণটুকু নেই, ৩৫/৪০ লক্ষ শিশু রাস্তার শিশু হয়ে আছে। আমাদের কী করণীয়?
সুইডেনে জন্মগ্রহণকারী হেলেনা নরবার্গ-হজ অর্থব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপকভাবে ভেবেছেন। শুধু তাই নয়, যে পরিবেশ আমাদেরকে নানা রসদ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে, সেটাও তাঁর ভাবনায় অনন্য হয়ে ওঠে। তিনি “লোকাল ফিউচার” নামক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। অতীতে এ-প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল International Society for Ecology and Culture (ISEC)। হেলেনা নরবার্গের দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করলে কিছু বাস্তবধর্মী সত্য পাই। তিনি অত্যন্ত কার্যকরি কিছু তথ্যের মাধ্যমে সত্য হাজির করেন। তিনি গবেষণা করে দেখান যে, মঙ্গোলিয়াতে যে-পরিমাণ দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার দরকার তার চেয়েও অনেক বেশি গাভী সেখানে রয়েছে। তারপরও বিক্রয়কারী দোকানগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে বিদেশি মোড়কে ভরা কৃত্রিম প্যাকেটজাত দুধের ছড়াছড়ি। কিন্তু কেন এমন হবে? এটা একটা উদাহরণমাত্র। এরকম করে নিজের দেশের দোকানের সব ধরনের পণ্যগুলোতে নজর বুলিয়ে আসুন এবার। এতে যে সত্য বেরিয়ে আসবে, তা আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু বাস্তবে মানবো না, এই যা!
হেলেনা নরবার্গ একটি গবেষণা-প্রবন্ধ লিখেছেন, যার নামটা খুব চিত্তাকর্ষক। এর শিরোনাম হচ্ছে— ‘সুখের অর্থনীতি: বিশ্বায়নের বিপরীতে যা বলতে চায়’। এতে যা উল্লিখিত হয়েছে, তা সংক্ষেপ করে বলা যায়—
১. সত্যিকার আধুনিক শহর এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে, যা আশপাশের ৫০ মাইলের মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোর ওপর নির্ভর করবে।
২. ‘প্রযুক্তিতে মানবতার মুক্তি’— এই স্লোগানটি আসলে ফাঁকাবুলি। কারণ বর্তমান বিশ্বের নানা দেশে দৃষ্টান্ত আছে যে, এসব লোকে খাওয়ানো কথাবার্তার মধ্য দিয়ে নানান কায়দায় সরকারগুলো কর্পোরেশনগুলোকে ফুলে ফেঁপে উঠতে সাহায্য করে।
৩. উন্নত চাকরি আর জীবনযাপনের লোভ দেখিয়ে মানুষকে শহরে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের শহরজীবন হয় বস্তিতে যাপন করার মতো।
৪. আঞ্চলিক বাজারগুলো স্থানীয় অর্থনীতি, লোকপ্রযুক্তি ও ভোক্তাদের থেকে কৌশলে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।
হেলেনা নরবার্গ একটা সাংঘাতিক উদাহরণ দেন—
“১৯৭০ সাল থেকেই বৃহৎ পরিসরে ব্যবসা প্রসারের লক্ষ্য নিয়ে বিপুল অর্থ ভর্তুকি দিয়ে মোড়কজাত করার পূর্বে পরিষ্কার করার জন্য ট্রাকে ট্রাকে আলু পাঠানো হতো ইটালিতে। সেই ধৌত আলু আবার ফিরিয়ে আনা হতো সুইডেনের বাজারে বিক্রির জন্য। কি অদ্ভূত, তাই না?”
পণ্যসেবা পৌঁছে দেবার কৌশলের পেছনে স্বার্থ ও অপচয়ের যে দৃষ্টান্ত হেলেনা হাজির করেন তা মারাত্মক, বলা যায় আত্মঘাতি। উন্নত বিশ্বের সম্পদ আছে, প্রচুর পরিমাণ ভূমি ও টেকনোলজির দাপট রয়েছে। ফলে এসব অপচয় তাদের গা সয়ে যায়। কিন্তু আমাদের মতো গরিব দেশের জনগণকে তা গরিব করেই রাখে। সাধারণ মানুষকে খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিনোদন নামক উপকরণ খুঁজতে রীতিমতো হয়রান করায়। কেবল আমাদের দেশ নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই এই থিয়োরি খাটে। আর আমাদের মতো স্বল্পভূমি ও সীমিত সম্পদের আর অধিক সংখ্যক মানুষের দেশের জন্য বিদেশ-নির্ভরতা কমানো আরও বেশি দরকার। দেশে ভোগপণ্য, এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের জন্য অর্থনীতির সিংহভাগ বাইরে চলে যায়। এভাবে আমরা ক্রমশ পিছিয়েই থাকি। কিন্তু পেছন থেকে হাতছানি দেয় তথাকথিত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার আর উন্নত জীবনযাপনের লোভ।
বস্তুত মুক্তবাজার অর্থনীতি একটি প্রবল ফাঁকির নাম। যেখানে অপ্রয়োজনীয় উৎপাদন, অবাধ প্রতিযোগিতার নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, টেকনোলজির অপব্যবহারসহ বহু ধরনের অপচয়ের সম্মুখিন হয় দেশ। বিশ্বায়নের এ যুগে মানুষকে ঠেকিয়ে রাখাও কঠিন। তবে প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া, একটা সংস্কৃতি নির্মাণ করা, প্রবল স্পিরিট তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু সেটা করতে হবে যত্নে, আন্তরিকতার সঙ্গে। কেবল দৃশ্যমান অবকাঠামোর উন্নয়ন নয়। বরং প্রয়োজন টেকসই উন্নয়ন। যেখানে খাদ্য, কৃষি, লোকাল প্রযুক্তি, লোকমানসের জ্ঞান, এমনকি নিজস্ব উপাদানে গৃহনির্মাণ পদ্ধতি জানা ও প্রয়োগ করা জরুরি।
বিশ্বায়নের ফাঁদে পড়া মুক্তবাজার বিশ্বে মানুষকে ভিনদেশি পণ্য গ্রহণে ঠেকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব কাজ। কেননা সবার সামনেই আছে একটা উন্নত বিশ্বের তৈরি করে দেওয়া প্রকল্পিত ধারণা। আরও রয়েছে ইন্টারনেট ব্যবস্থার অতিদ্রুত প্রসারে সহজে ডাটাপ্রাপ্তির সুফল। এই ডাটা মানুষকে কখনও কখনও সাহায্য তো করছেই না, উল্টো মানুষের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারণা, বিশ্বাস ও জ্ঞানকে সন্দেহের মধ্যে ফেলছে। ফলে মানুষ অজান্তেই ফানুস এক অর্থব্যবস্থার গ্যাঁড়াকলে পতিত হচ্ছে। যা তারা নিজেরাও কখনও কখনও উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু অনেক মানুষের কাছে প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়— কী করবো! আমরা যে পরিস্থিতির শিকার!
কিন্তু এই ধরনের সকল পরিস্থিতির শিকার হওয়া থেকে মুক্তির পথ তো রচনা করতে হবে। নইলে গোটা জীবনটাই এক দুষ্টেচক্রে ঘুরপাক খেতে থাকবে। আজকের ঢাকাশহরের বিশাল জনস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধগতি, সেবামূলক খাতগুলোর ভগ্নদশার দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি, তা ভাবতে হবে মন দিয়ে। কেবল সমস্যা নির্দেশ করা নয়, কাজ করবে বা ফাংশন করবে এমন ব্যবস্থা নিতেই হবে। প্রত্যেক শ্রেণিপেশার মানুষকে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে, সরকারি বিধিব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে তা সফল করতে হবে।
মানুষের বাঁচাটা নিরাপদ ও সুখি করা জরুরি। আর এটাই সুখের অর্থনীতি। কোন সংস্থা জরিপ করে কোন দেশকে কত নম্বর সুখের তালিকায় রাখলো এগুলো নেহায়েৎ অন্ধের হাতি দেখার মতো। তবে যেভাবেই দেখা হোক, বাংলাদেশ ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে। একথা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দিকে না তাকালেও উপলব্ধি করা যায়। অন্যদিকে জটিল দুরারোগ্য রোগের পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী খাবার ও জীবনাচার। অথচ দূষণের শহরেই বহুতল হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। যেন দেশে আর জায়গা নেই। বসবাস করার উপযুক্ত জায়গাগুলো ছেড়ে দিয়ে অনুপযোগী স্থানে আমরা ভিড় করছি। আমরা এমন সব জিনিস ভোগের সংস্কৃতিতে পরিণত করেছি, যেগুলোর আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। আবার এমন সব ইন্ডাস্টি তৈরি হচ্ছে বাজে ধরনের ভোগের সংস্কৃতি অনুসরণ করে।
অন্যদিকে ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার হয়ে আমরা বসে আছি। বিদেশি পণ্য-বর্জনের ডাক দেওয়ার সুফল তখনি পাবে মানুষ, যখন দেশের অর্থ দেশেই কাজে লাগানো যাবে। নিজের ক্ষেত্র প্রস্তুত না করে অপরের সঙ্গে বিবাদ বিসংবাদে তেমন কোনো বাস্তব ফল নেই। কোমর বেঁধে ঝগড়ায় নামতে হলে কাপড়ের আঁচল থাকা চাই। নইলে দিগম্বর হয়ে লড়াই করবেন?
অনেকেই ভাববেন, এসব নিয়ে কথা বলা খুব একটা শৈল্পিক কাজ নয়। আপনার সামনে মানুষ না খেয়ে থাকবে, বিনা চিকিৎসা আর ভুল চিকিৎসায় মারা যাবে, আপনি বসে বসে নিরোর মতো বাঁশী বাজাবেন, সেটাই বা সঙ্গত হয় কি করে! সবাই আমরা খেয়ে বাঁচি, না খেয়ে থাকি না। আমাদের হাজারটা অনৈক্যের মধ্যে এটাই একটা ঐক্য— আমাদেরকে বাঁচার জন্য খেতে হয়। আর খাদ্যের পেছনে কারসাজি আসল কারসাজিতে পরিণত এখন আমাদের দেশে। খাদ্য জমিয়েও রাখা চলে না। এটা নদীর স্রোতের মতো, যে স্রোতকে অব্যাহত রাখা আমাদের সবার কর্তব্য। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ সুন্দর জীবনযাপন করুক, করতে শিখুক, অগ্রণী হোক— এগুলো আশাকরি সকল শিল্পিত/পরিশীলিত মনের দাবি।
লেখক: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন