বেশ্ব-বিদ্যালয় সন্দেশ

বিদ্যা-বিরাগী সুবিন্যস্ত (অ)ধী-পতি। পরিধেয় বস্ত্র ও অলঙ্কারে ধোপদুরস্ত। তার ময়ূর-আসনটি সুউচ্চ তাই নিম্নজন অন্তরাল থাকে। সদ্য পাওয়া ক্ষমতায় তিনি বেহুঁশ! মশহুর বিদুষকের দল আঠার মতো লেগে রইল। তেতে উঠলো স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল। ত্রিলোক কম্পিত হলো থরথর। ময়ূরচিহ্নিত আসনটির আশেপাশে কয়েকজন গো-বিদ্যান। তারা গবেষক, তাই ব্যস্ত, গো নিয়ে গো গো করছে।জেদেরও নাকি গো আছে! আর তা যদি গবেটের হয়, তো অন্যদের কপালে শনি। 


একজন বাজখাঁই, কণ্ঠনালী ও মন যার অঙ্কশাস্ত্রীয় মতে চলে। তিনি পণ্ডিতন্মন্য ও সাক্ষাৎ নিমাই। আপন বড়াই প্রকাশে বাড়াবাড়ির চোটে কপাল কোঁচকানো। স্বল্প চুলের কার্বন চশমায় তাকে সবচে পণ্ডিতপ্রবর বলে ভ্রম হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি শৃগাল শ্রেণির। প্রতিষ্ঠানের মস্তিষ্কলোকে সর্ববিদ্যার মালিশ-প্রলেপে তিনি সুমহান আতেলেকচুয়াল। তার কথা কিঞ্চিৎ পরে আসুক। 

বরাহমুখো মহা-(অ)ধী-পতি সিংহাসনে। মহারাজার আদেশে বৈশ্ব বিদ্যাগৃহের কর্ণধার। সদ্য-প্রসবিত গো-বৎসের মতো তিড়বিড় করা স্বভাব। তার আশপাশ মধুলোভী ভোমরার গুঞ্জন মুখর। তাদের পরামর্শক্রমে মহাবিদ্যাগৃহের অচল দেয়ালে জন্মানো বৃক্ষরাজি আবেশরত। মহামতী বটবৃক্ষসমূহ তখন বনসাইয়ের আকার ধারণ করেছে।


তেড়ে কেটে মার হয়ে মহামতী হাঁক দিলেন, “আমি যাহাদিগকে খাবারের বন্দোবস্ত করতাছি তাহারা আমার আপন সন্তান।” সন্তান-জন্মদানের সংকট সম্পর্কে তিনি আনপাড়হ। কেননা তারাই তো যুদ্ধে লিপ্ত হয়। 


মহাধিপতির নিকট অন্যেরা কৌরবপক্ষীয়। কিন্তু কথা আছে। ইহারা অন্যায় রাজত্ব দখল করতে চায়নি। অন্যদিকে তার সুযোগ্য সন্তানরা তারই আজ্ঞাবহ ভূমিদাস। মহাবিদ্যাগৃহের সবজে-ঘাসি জমিতে সস্তা-গরু চড়াবার মতলব। ভাবুকরা টের পেলো বরাবর। 


বরাহমুখো বিদ্যাপতি আসন অলংকৃত করেছেন আগেই। এবার অনাত্মীয় অন্বেষণ। নেশায় বেতাল হলেন কান কথায়। উদ্দেশ্য আগাছা পরিষ্কার। উদ্দিষ্ট পরের জমি, নিজের নয়। কথায় বলে, “ক্ষমতা পাইলে পিপেস্ট্রেল বাদুড়ও হস্তী হয়।”


অমূলক ভয় মানুষের কী না করতে পারে! 


এদিকে দিবস-যামিনী চিন্তিত বরাহমুখো। তার সঙ্গে আপতকালের মহামূর্খরা গোলটেবিল বৈঠকে ব্যতিব্যস্ত। কার্যালয় কক্ষ ছেড়ে সে-বৈঠকের বিস্তার বহুদূর। চতুর্দিক মোড়ানো সোফা টিপয় ঝাড়বাতি সজ্জিত অন্দরমহল পর্যন্ত। এ কালের মোঘল সম্রাট বলে অতিরঞ্জিত ক্রিয়াকর্মে তিনি ধ্যানী প্যাঁচা। সর্বদা শিকার মারার অপেক্ষায় রত। শ্যেনচক্ষু তার সর্ব অঙ্গে। 


বাসর রাতে বিড়াল মারা ফরজে আইন। তাই বরাহমুখো গুটিকয় দুর্বল হাড্ডিসার বেড়ালের পিছু ধাওয়া করলেন। উদ্দেশ্য, সুন্দরবনীয় শিকার-পদ্ধতিতে বাঘের আত্মীয়কে খাঁচাবন্দি করা। সারমেয় যজ্ঞ করলে ঘেউ ঘেউ শব্দ হবে। তাই বিড়াল যজ্ঞ করা। জনতা বিপদ-আশঙ্কা টের পেলে হবে মহা হট্টোগোল! 


চামাধিপতির বিশাল গো বিদ্যাভার কোনো পাত্রেই আঁটছে না। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তাদের অনন্ত দিনসমূহ গাঁথা। পাঠক এগিয়ে গেলেই হৃদয়ঙ্গম করবেন—পঞ্চবার্ষিক ত্রিবার্ষিকীতেই ক্ষান্ত হয়। ত্রিলোকের বাইরে আর কোনো মোক্ষধাম নাই। বাদবাকি দ্বিবার্ষিকী কাল অতিক্রম করা হলো না।


আপসোস কি বাত! গো বিদ্যায় আপসোস মানায় না। জনগণতন্ত্রের অন্ন-যোগানদাত্রী প্রতিষ্ঠানের সূত্রধর হলে বাধা নেই। তা তো সুসম্মানিত!

 

পাঠক আখ্যানের প্রথমদিকে ফিরে দেখুন। সুবিন্যস্ত মাকাল-ফল বিদ্যাধর উপরিউক্ত মহা গো-বিদ্যানদের গোলটেবিলের একজন মহামন্ত্রী (মন্ত্রণাদানকারী অর্থে)। সম্প্রতি পল্টি-পূর্বক আপন দল বগলদাবা করে সাহারা মরুভূমে যাত্রা করেছেন। আশা, মরুদ্যান খুঁজে পেলেই আবার পানীয়জলে চাঙ্গা হতে পারবেন। নাঙ্গা হয়ে বগল বাজানো তখন ছোষট্টিকলার একটি। 


গো বিদ্যাগৃহ-রূপ রাজচক্রের মর্মভেদ করা বড়ই কঠিন। 


শত্রুই মিত্র আর মিত্রই শত্রু। যাহাই হউক, সুবিন্যস্ত মাকাল ফলরা আছেন মন্দ নয়। সুসংবাদটি পাঠকের পূর্বাহ্নেই জানতে হয়। আপসোস বহুত কি বাত হলেও ধৌতবস্ত্র মাকালদের মেলাই দাম, মেলাই খাতির। সুপুষ্টু সুদৃশ্য বদন সৌন্দর্য অধিকারে থাকলে আর ভাবনা কী? 


বিদ্যাগারটি একটি সুউচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত খোঁয়াড়। সেখানে বাঘও বন্দি হয় ঘাস ভক্ষণে এসে। ইঁদুররাও সিঁদকাটি সঙ্গে করে রাখে। 


এক্ষণে একটি গল্পাংশ রয়েছে। সারাংশ তার ইন্দুর-বিলাই দৌঁড়ের মধ্যাংশ। এখন গল্পটি শুরু করা যাক। চাপা জিনিসটি বস্তার তলায় বন্দি থাকিবার কোনও মানে নাই। 


পাঠক দয়া করে ক্লান্ত হবেন না। মর্মপীড়ক অসভ্যতার বহুর মধ্যে একটি ঘটনা আপনাদের জানা দরকার। সাধু-চলিত ভাষার সুনিয়ন্ত্রিত পাকা খালে জলযান চালানো যাইবে আর! আমরা মিশিয়াই বলিব। কারণ ভারতচন্দ্রের উত্তরসূরি। কহতব্য বিষয় সাংঘাতিক গোলমেলে, যেমন স্বেচ্ছাচারী তার ভাষা, তেমন আর কি! 



গল্পের প্রারম্ভভাগ : বিলাই মারা

যাহা কহিতেছিলাম, বিদ্যাগারের বরাহমুখো মহাধিপতি দুর্বল নিরীহ বিড়ালকে কড়িকাঠে উষ্টা খাওয়াইলেন। অপরিমেয় বায়ুশক্তির বৈশাখি তাণ্ডবে হতচ্ছাড়া মহাতাণ্ডব। সেই মহামতীর কার্যালয় দেখিয়া ভাবিয়া থৈ কূল কিছু পাই না-- ইহার মধ্যে এত্ত ‘পাওয়ার’। কীসের নিমিত্ত! বুঝিবা চৌদ্দ হাজার ভোল্টেজের সরকারি বিদ্যুতের লাইন। জ্বলিয়া-পুড়িয়া খাক হইবার জোগাড়। পূর্বাহ্নেই স্থিরিকৃত সিদ্ধান্ত। তাই নড়নচড়ন ঘটে না। নিষ্পাপ মুখও পাপিষ্ঠ আহা! 


প্রথমত একটি উষ্টা মারা কোয়েশ্চেন। তাহার পর থাবড়া মারিয়া মুখবন্ধন। নিম্ন বিশ্ববিদ্যা-খোঁয়াড় হইতে বহির্বতীর্ মহানটগুরু আগত। সুবেশী গো বিদ্যান কর্তৃক ষড়যন্ত্র পূবীর্কৃত। থাবড়া মারিয়া স্টান্ট করিয়া দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এই পারঙ্গমতায় অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠলো বরাহ মহাপতির মুখমণ্ডল। সুবিন্যস্ত মাকাল ফল মজা পাইয়া উঠিলেন। বদনমণ্ডলে তার বিজয়ের রেখা। বরাহমুখো মজা পাইয়া ছন্দ না জানিয়াই ধেই ধেই চৌষট্টিকলায় ভাসিলেন। 


এর আগে কোনো ফলাফল প্রকাশের চাপিয়া রাখার ইতিহাস নাই। বাইরে প্রকাশিতব্য না হলেও, অভ্যন্তরে জানিবার কোনো পাপও নাই। ফলাফল বাহির হইলে বড়াই মশগুল ঘাগু পণ্ডিত কহিয়া উঠিলেন—“মহাবিদ্যাপতির কীবা দুষ! পাঁচ মিনিটখণ্ড কালের মধ্যেই তিনি লোক চিনিয়া লইলেন। আর খড়গহস্ত হইলেন। সর্বোপরি তানি আর কীই বা করিতে পারিতেন? তাহার খোঁয়াড়ের হইলেও বুঝিতে পারা যাইত ইত্যাদি ইত্যাদি।” 


আপন খোঁয়াড়ের অশ্ব-গর্দভও প্রমোটেড হইয়াছে। বহির্বর্তী বেশ্বালয়ের অপপণ্ডিতটি তখন হাজির নাই। কিন্তু তাকে ছাড়াও ‘রাত্তির অন্ধকারে’ প্রমোটেড করিতে সুবেশীদিগের শরমিন্দা হয় নাই। 


যাই হোক, আমাদের উদ্দেশ্য শজারু শ্রেণির আপাত ভদ্রবেশী কাহারেও গালমন্দ করা নহে!  


কথিত যে, সুবিন্যস্ত অধিপতি বিদ্যাগৃহের পাঠদান কক্ষে প্রবেশিতে কুণ্ঠিত হইয়া থাকেন। দেশোদ্ধার থুক্কু বেশ্বগৃহের কল্যাণ আদর্শ ধারণ করতে হলে সময়ক্ষেপণ চলে না। তাই পাঠ-প্রস্তুতি সম্পন্ন করিতে পারেন না। পাঠদান কক্ষে আপনাপন কণ্ঠস্বরকে গেরুয়া বস্ত্রখণ্ডে ঢেকে রাখেন। স্বাস্থ্যবান নোটবহি বা গ্রন্থিকা উন্মোচিত করিয়া থাকেন।


অভাজনরা বিদ্যা উজাড় করিয়া দেয়। কদাপি তাহাদের খোঁজখবর কেউ রাখেন না। কবে কী হইয়াছিল, কাহার সঙ্গে কাহার কি খামচা-খামচি! এইসকল খোস-পাঁচড়া প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কলহের কারণ। 


ইহাই বেশ্ববিদ্যারূপ প্রেক্ষাগৃহের খবর; যাহা সিনেমেটিক। পরন্তু বিদ্যাগৃহরূপ খোঁয়াড়ের প্রপিতা-প্রমাতাগণের কাণ্ডকারখানা। তাহা হতাশাব্যঞ্জক। যেহেতু বিদ্যার্থীরা তাহাদিগের চর্বলেহ্যপুষ্ট হাড়হড্ডি লইয়া কুকুর দৌঁড়ে অব্যাহত। বিভিন্ন বেশ্বাগৃহে তাহারা সযত্ন রক্ষিত, পিতৃমাতৃগণের আশীর্বাদ।


যারা একটু বোধসম্পন্ন, তারা মেঠোরাস্তাতেই সযত্নে পদব্রজে চলেন। তারা প্রাপ্তির ভেলায় অনুকূল বাতাসে পাড়ি দেয় না। অধিকন্তু তাহারা পরিষ্কার নভোমণ্ডল দেখিতে পায়। এমনকি তা বিদ্যাকক্ষের বাহিরে বসিয়াও। 


প্রকৃত গুরুগণ তাহাদের পাঠাভ্যাসকে বিচিত্র স্থানে ছড়িয়ে দেন। তাহাদিগকে চপেটাঘাত করিতে পারিলে খোঁয়াড়ের হর্তাগণ বাঁচিয়া-বর্তিয়া যান। তাহারা মূর্খদিগকে বিদ্বান ভাবেন। তাহাদেরকে লইয়া গর্ব করেন।


অন্যের মঙ্গল দেখিলে তাহাদের আবার গর্ভপাত হইবার সম্ভাবনা। তাহাই সত্য কেননা, গ্যাঁড়াকল পাতিয়া তাহারা শিকার ধরেন। আপন-আপন খোঁয়াড়ের বাসিন্দাবর্গকে লইয়া মহাজোটে ঘোঁট পাকাইতে থাকেন। সুবিধামতো গর্ভেষণা (গর্ভ+এষণা) করিবার ফয়সালাও বাতলাইয়া দেন।


অন্যেরা উপায়হীন। বেশ্বগৃহের দেয়ালে প্রণিপাত করিয়া শবাধার আগলাইয়া পড়িয়া থাকেন।  

    

(প্রথম পর্বের সমাপ্তি)


উল্লেখ্য : ইহা বিদ্যাগৃহের নির্মম ইতিবৃত্তের একটি। তথা, তাহা কিছুকালের পুরোনো প্রতিবেদন!

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন